আর কাউকে যেন বলতে না হয় 'মি টু'

অপরাহ্ উইনফ্রে
অপরাহ্ উইনফ্রে

গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে সম্প্রতি সেসিল বি. ডিমিল আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন অপরাহ্ উইনফ্রে। তাঁর মা ভার্নিতা লি ছিলেন একজন গৃহকর্মী। দারিদ্র্যের সবচেয়ে কঠিন রূপ দেখে বড় হওয়া অপরাহ্ আজ বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের একজন। টেলিভিশন-সিনেমায় অভিনয়, উপস্থাপনা আর টিভি চ্যানেল পরিচালনা—সব ক্ষেত্রে সফল এই নারী ৭ জানুয়ারি সেসিল বি. ডিমিল সম্মাননা গ্রহণের সময় একটি শক্তিশালী বক্তৃতা দিয়েছেন। বক্তৃতাটি আলোড়ন ফেলেছে সারা বিশ্বে

১৯৬৪ সালের কথা। ছোট্ট আমি মায়ের মিলওয়াকির বাড়ির মেঝেতে বসে ৩৬তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে অ্যান ব্যাঙ্ক্রফটের অস্কার তুলে দেওয়া দেখছি। সে খাম খুলল আর বলল সেই ঐতিহাসিক পাঁচটা শব্দ, ‘এবারের বিজয়ীর নাম সিডনি পটিয়ার।’ মঞ্চে উঠে এলেন স্মরণকালে আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। তাঁর টাই ছিল সাদা, চামড়া কালো—সেই ব্যক্তির বিজয়কে উদ্‌যাপন করা হচ্ছিল। আমি এর আগে এমনভাবে কোনো কালো মানুষকে ঘিরে সবার এত উচ্ছ্বাস আর উদ্‌যাপন দেখিনি। আমি অনেক চেষ্টা করেও কখনো বোঝাতে পারিনি যে, সেই মুহূর্তটা তখন আমার জীবনে কত প্রভাব ফেলেছিল। আমি তখন ছোট্ট একটা মেয়ে, যার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করত। আমি এখনো সেই অনুভূতিটা বোঝাতে পারব না।

১৯৮২ সালে সিডনি পটিয়ার গোল্ডেন গ্লোব আসরের এই সেসিল বি. ডিমিল আজীবন সম্মাননাটি গ্রহণ করেছিলেন। আজ আমি যখন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে এই সম্মান অর্জন করছি, আমি জানি আজও হয়তো সেই আমার মতোই কোনো ছোট্ট মেয়ে এই মুহূর্তটি দেখছে। এটা আমার জন্য খুবই সম্মানজনক মুহূর্ত, কারণ এই অর্জন আজ আমি তাঁদের সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। আমি আমার এই অর্জনের গৌরব তাঁদের সঙ্গেও ভাগ করতে চাই যাঁরা এত দিন আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, যাঁরা আমার দিকে নানা সময় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, যাঁরা আমার চলার পথে নানাভাবে আমাকে পরখ করেছেন, আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছেন। ডেনিস সোয়ানসন আমাকে প্রথম দেখেছিলেন এএম শিকাগোয়। তিনিই স্টিভেন স্পিলবার্গকে বলেছিলেন আমিই নাকি তাঁদের দ্য কালার পার্পাল-এর সোফিয়া। গেইলকে (টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব গেইল কিং) ধন্যবাদ, আমার বন্ধু হওয়ার জন্য। আর স্টেডম্যান (মিডিয়া মোগল স্টেডম্যান গ্রাহাম) তো আমার জীবনের খুঁটি।

হলিউড ফরেন প্রেসকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। ইদানীং গণমাধ্যম দারুণ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবুও সত্যকে উন্মোচন করতে তাদের অতৃপ্ত পরিশ্রম আর চেষ্টা দুর্নীতি ও অন্যায়ের ওপর থেকে সব পর্দা তুলে দিচ্ছে। আমি এখন গণমাধ্যমের ওপর আগের চেয়ে অনেক বেশি আস্থা রাখতে পারি। কারণ এই কঠিন সময়েও তারা আমাদের সত্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বলতে চাই, সত্য হলো মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। আমি সেসব সাহসী নারীদের নিয়ে গর্ব করি যাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের সত্য বলার সাহস দেখিয়েছেন, তাঁদের গল্প পৃথিবীকে জানিয়েছেন।

কিন্তু এই কঠিন সত্য গল্পগুলো শুধু যে বিনোদনজগতেই রয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। এমন অনেক না-বলা গল্প প্রতিটি জাতি, দেশ, ধর্ম, রাজনীতি আর কর্মক্ষেত্রেই আছে। তাই আজ আমি সেই প্রতিটি নারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, যাঁরা আমার মায়ের মতো নিজের সন্তানকে দুবেলা খাওয়ানোর জন্য, জীবন চালানোর জন্য, স্বপ্নপূরণের জন্য বছরের পর বছর মুখ বুজে নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে গেছেন। আমরা তাঁদের অনেকের নামই জানি না। তাঁরা হয়তো মানুষের বাড়িতে কাজ করেন, খেতে-খামারে-কারখানায় কাজ করেন, রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। তাঁদের অনেকে হয়তো বড় স্থপতি, চিকিৎসক কিংবা বৈজ্ঞানিক। অনেকে ব্যবসায় বা রাজনীতিতে জড়িত। তাঁরা হয়তো আমাদের অলিম্পিকজয়ী, আমাদের সেনাসদস্য। তাঁদের সবাইকে আমার হৃদয়ের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

আমি এমন আরও একজন নারীর কথা বলতে চাই আজ। তিনি রিসি টেলর। আমার মনে হয়, তাঁর কথা আমাদের সবার জানা উচিত। সময়টা ১৯৪৪ সাল। রিসি টেলর তখন একজন স্বল্প বয়সী স্ত্রী, নবজাতকের মা। অ্যাবেভিল অ্যালাবামার এক চার্চ থেকে প্রার্থনা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন ছয় শ্বেতাঙ্গ পুরুষ অস্ত্রের মুখে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁকে ধর্ষণ করে চোখ বেঁধে ফেলে রেখে যায় রাস্তার ধারে। তাঁকে হুমকি দেয় ধর্ষণকারীরা, মুখ খুললে প্রাণে মেরে ফেলবে। কিন্তু রিসির ঘটনা প্রকাশ পায় এনএএসিপিতে (দ্য ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালার্ড পিপল)। সেখানকার তরুণ কর্মী রোজা পার্কস প্রধান অনুসন্ধানকারী হিসেবে এ ঘটনা বের করে আনেন। এরপর রিসি ও রোজা দুজন মিলে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াই শুরু করেন।

কিন্তু জিম ক্রোর সেই সময়ে সত্যের কোনো ভিত্তি ছিল না। যারা রিসির জীবনকে ওলটপালট করে দিল, তারা শাস্তি পেল না। ১০ দিন আগে (২৮ ডিসেম্বর) রিসি টেলর মারা গেছেন। আর কটা দিন বাঁচলে, তার বয়স হতো ৯৮। তিনি আমাদের মতো করেই বেঁচে ছিলেন এত দিন; কিছু বর্বরের শৌর্য-বীর্যের কাছে নুয়ে পড়া এই সমাজেই। একটা সময় ছিল, সেই বর্বর পুরুষদের সত্য কোনো নারী সাহস করে তুলে ধরলে কেউ তাঁকে বিশ্বাস করত না, কেউ তাঁর কথা শুনত না। কিন্তু এখন আর সেই সময় নেই। সেই বর্বরদের সময় শেষ।

হ্যাঁ, তাদের সময় শেষ। আমি আশা করি, রিসি টেলর তাঁর সত্যকে, তাঁর মতো হাজারো নারীর চাপা সত্যকে একটা বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়ার আশা বুকে নিয়ে চিরনিদ্রায় গেছেন। এই বিপ্লবটাই হয়তো ছিল রোজা পার্কসের হৃদয়ে, রিসির ঘটনার ১১ বছর পর যখন রোজা মন্টগোমেরির সেই বাসের সিটেই বসে থাকার সাহস দেখালেন। এই সাহস এখন সেসব নারীর ভেতর প্রবাহিত হয়েছে, যাঁরা ‘মি টু’ বলতে পেরেছেন। এই সাহস সেসব পুরুষের মনেও আছে, যাঁরা এই সত্যগুলো শুনতে পেরেছেন, বুঝতে পেরেছেন।

টেলিভিশন হোক কিংবা সিনেমা, আমি বরাবরই আমার কাজের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করেছি নারী-পুরুষের স্বাভাবিক জীবনচিত্র তুলে ধরতে। আমরা কেমন করে একে অপরকে ভালোবাসি, কেমন করে লজ্জা পাই, কীভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করি, কীভাবে ব্যর্থ হই, কীভাবে ব্যর্থতা ঝেড়ে উঠে আসি—এসব বলতে চেয়েছি সব সময়। আমি এমন অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, এমন অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছি, যাঁরা জীবনের সবচেয়ে বাজে মুহূর্তেও হাল ছাড়েননি, আপস করেননি। তাঁদের সবার মধ্যে ঘুরেফিরে বারবার একটা বিশেষত্বই খুঁজে পেয়েছি আমি, তা হলো, সবচেয়ে অন্ধকার-অনিশ্চিত রাতেও তাঁদের সুন্দর ভোরের অপেক্ষা। তাই আজ যে মেয়েরা এখন আমাকে দেখছে, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, নতুন ভোরের সময় এসে গেছে। নতুন দিন আমাদের সামনে।

এই নতুন দিনটি আমরা পেলাম কিছু অসম্ভব সাহসী নারীর জেগে ওঠার কারণে। আর কিছু চমৎকার মনের পুরুষের কারণে, যাঁরা একনিষ্ঠভাবে চেয়েছেন যেন সমানতালে এগিয়ে যায় সবাই, যেন আর কখনোই কাউকে বলতে না হয় ‘মি টু’।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও