কুর্মিটোলা গলফ কোর্সে হাসিমুখে ঘুরছিলেন অরণি। তাঁর আরেকটি নাম সামাউন আঞ্জুম। ২৭ জানুয়ারি বিকেলে গলফার সিদ্দিকুরের ট্রফি জয়ের মুহূর্তে সুখবরের ঘোষণা এল মাইকে, ‘বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী গলফারের খেতাব পাচ্ছেন অরণি।’ স্বামী সিদ্দিকুর রহমান দেশসেরা গলফার। একটু আগেই জিতেছেন ‘ত্রিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ঢাকা ওপেন’। হাসিটা তাই বাঁধভাঙা অরণির। মুহূর্তটা যেন আরও স্মরণীয় হয়ে উঠল ছোট্ট একটি খবরে।
বাংলাদেশের অনেক মেয়ে অ্যামেচার গলফ খেলেন। কিন্তু পেশাদার জগতে এত দিন কেউ পা রাখেননি। বাংলাদেশ প্রফেশনাল গলফারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএ) থেকে এবার আনুষ্ঠানিকভাবে অরণির হাতে তুলে দেওয়া হলো ‘প্রো-কার্ড’।
স্কুলে কখনো কোনো খেলায় অংশ না নিলেও একসময় গলফে বুঁদ হয়ে পড়েন অরণি। ২০১০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর কুর্মিটোলা গলফ কোর্সে মা গুলনাহারের খাবারের দোকানে আসতেন। তখন গলফের অনুশীলন দেখতে দেখতেই খেলার প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। হাতে তুলে নেন গলফ স্টিক। এরপর গলফ ফেডারেশনের অধীনে হওয়া প্রাথমিক বাছাই শেষে জাতীয় অ্যামেচার ওপেনে খেলার সুযোগ মেলে। ২০১৩ বাংলাদেশ গেমসে সেনাবাহিনী দলের হয়ে জেতেন ব্রোঞ্জ। দলগতভাবে সোনা। তিনবার জাতীয় অ্যামেচার ওপেনে অংশ নিয়ে একবার হন রানার্সআপ।
২০১৫ সালে সিদ্দিকুরের সঙ্গে বিয়ে হয় অরণির। বিয়ের পর খেলাটা অনিয়মিত হয়ে পড়লেও কোচিং কোর্সে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গত বছর নয়াদিল্লিতে ভারতের জাতীয় গলফ একাডেমির অধীনে কোচিংয়ের ‘ডি’ লাইসেন্স করেন। এরপর চণ্ডীগড়ে গিয়ে করেছেন ‘সি’ লাইসেন্স। কোচিংয়ের পাশাপাশি পেশাদার গলফটাও খেলে যেতে চান অরণি।
বাংলাদেশের মেয়েদের পেশাদার গলফে খেলা বেশ চ্যালেঞ্জের। আগে ফেডারেশনের অধীনে টুর্নামেন্ট খেললেও, এখন সব দায়িত্ব নিজের। অরণি অবশ্য চ্যালেঞ্জটা হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন, ‘কাউকে না কাউকে তো প্রথম শুরু করতে হবে। আমি খেলছি দেখে হয়তো ভবিষ্যতে আরও মেয়েরা এখানে আসতে উৎসাহিত হবে।’
যদিও চাইলেই পেশাদার টুর্নামেন্টে খেলতে পারবেন না অরণি। এ জন্য পিজিটিআইয়ের (প্রফেশনাল গলফ ট্যুর অব ইন্ডিয়া) বাছাই স্কুলে খেলতে হবে। সেখানে টিকে গেলে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ মিলবে। বাংলাদেশের কেউ খেলেননি বলে মোটেও ভয় পাচ্ছেন না অরণি, ‘বছরে অন্তত ১৮-২০টি মেয়েদের প্রো-টুর্নামেন্ট হয় বিশ্বে। পেশা হিসেবে এটা যথেষ্ট ভালো। মেয়েরাও ভালো পর্যায়ে আছে। এখানে ভালো করার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’
অরণির প্রেরণার নাম সিদ্দিকুর রহমান, ‘বিয়ের আগে থেকেই সিদ্দিকুরের খেলা আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে। ও তো সবার জন্যই অনুপ্রেরণা। যে গলফ না বোঝে তার জন্যও। গলফ নিয়ে ওর যে সাধনা সেটা তো আমিই সবচেয়ে কাছে থেকে দেখেছি। ও সব সময় বলে, “তুমি পারবে। শুরু করো।” ওটা দেখেই আমি আরও বেশি উৎসাহ পাই।’
কোন টুর্নামেন্টে খেলবেন আপাতত সেটা জানেন না। বিপিজিএর অনুমতিটা মিলেছে এতেই খুশি। সিদ্দিকুরের ট্রফি জয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে সুখবর পেয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসলেন অরণি, ‘সিদ্দিক আগে থেকেই বলেছিল তোমাকে পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে থাকতে হবে। আমি বুঝিনি যে খেতাবটা পাব। একই দিনে দুটো আনন্দ, বলে বোঝাতে পারব না। এটা সত্যি স্মরণীয় একটা দিন।’
বাংলাদেশের গলফের অনেক প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিদ্দিকুরের নাম। প্রথম পুরুষ গলফার হিসেবে নাম লিখিয়েছেন পেশাদার সার্কিটে। প্রথম এশিয়ান ট্যুর জিতেছিলেন, প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ হিসেবে সরাসরি খেলেছেন অলিম্পিকে। আর এবার নতুন একটি প্রথমের মাইলফলকে নাম লেখালেন অরণি।