বিশ্ব যাঁর বিশ্ববিদ্যালয়

>

সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: খালেদ সরকার
সৈয়দ শামসুল হক। ছবি: খালেদ সরকার

সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে বলা হয় সব্যসাচী লেখক। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো হয়নি, তবে পৃথিবীর পাঠশালায় তিনি ছিলেন এক সফল ছাত্র

ছোট্ট মফস্বল শহর কুড়িগ্রাম। প্রায় গ্রামই বলা চলে। রিকশা ছিল না। সাইকেল সেখানকার চলতি বাহন। আর সৈয়দ শামসুল হকের মা, তিনি চলাফেরা করতেন গরুর গাড়িতে। ক্লাস নাইনে যখন উঠলেন শামসুল, সেই ১৯৪৮ সালে; বাবা বললেন, ‘পড়ালেখার জন্য তোমাকে বড় জায়গায় যেতে হবে।’ ১২ বছর ৩ মাস বয়সে প্রমত্তা ধরলার তীর থেকে এসে পৌঁছালেন বুড়িগঙ্গার তীরে, ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। দেশভাগের পর ঢাকা তখন নতুন রাজধানী। ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা, মীরজুমলার কামান, আহসান মঞ্জিল, কার্জন হল—কত কিছু!

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক সুকুমার বাবু ‘সে মারা গিয়াছে’—এর অনুরূপ বাক্য তৈরির পরীক্ষা দিলেন ছাত্রদের। সবাই সর্বোচ্চ ১৩-১৪টি বাক্য লিখে আনল। ক্লাস টেনের ছাত্র শামসুল লিখলেন ৫২টি অনুরূপ বাক্য। শিক্ষক সুকুমার বাবু বললেন, ‘আমার এক প্রাক্তন ছাত্র তোমার চেয়ে দুটি বেশি বাক্য তৈরি করতে পেরেছিল। তাঁর নাম বুদ্ধদেব বসু।’

১৯৫০-এ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে বছরই ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে, বিজ্ঞান বিভাগে। তবে বাবার ডাক্তার হওয়ার দাবিকে এড়াতে ১৯৫১-তে বোম্বে পালিয়ে যান। বোম্বে গিয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার কামাল আমরোহীর সঙ্গে সিনেমার রূপ ছবিময় জগতে কাজ শুরু করেন ১৯৫১-৫২ কালপর্বে; মহান ভাষা আন্দোলনের ঢেউ তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনে প্রিয় স্বদেশ সমুদ্রে। দেশে ফিরে ১৯৫২-তে ফের ঢাকায় এসে বিভাগ পাল্টে জগন্নাথ কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫৪-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ইংরেজি বিভাগে।

ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন টিউটোরিয়াল ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন জন মিলটনের প্যারাডাইস লস্ট, একদিন ওই কাব্যের একটি দিক নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে দিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীদের আর প্রবন্ধ লেখার জন্য সহায়ক বই সূত্রগুলোর তালিকাও করে দিয়েছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক শিক্ষকপ্রদত্ত সূত্রের পরোয়া না করে নিজের বোধবুদ্ধি ও পাঠ অবলম্বনে প্রবন্ধটি দাঁড় করিয়েছিলেন। সৃজনশীল মানুষ বলে কথা, তিনি তো বিধিবদ্ধ পাঠসূত্র অনুযায়ী চলার মানুষ নন। কিন্তু ফল হলো মারাত্মক। শিক্ষক খাতা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি আমার পরামর্শমতো সূত্র ব্যবহার করোনি, উদ্ধৃতি দাওনি, লিখেছ নিজের মতো করে।’ ক্লাসের চল্লিশজন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রথম শ্রেণি পাবেন বলে যে চারজনকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল, সেই চারের এক সৈয়দ শামসুল হককে বললেন, ‘...অ্যান্ড ইফ ইউ গো অন লাইক দিস, ইউ ক্যান নট হোপ টু গেট আ ফার্স্ট ক্লাস ইন ইয়োর ফাইনাল!’ (যদি এভাবেই চলতে থাকো, ফাইনালে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার আশা ছেড়ে দাও) শিক্ষকের এমন কথায় ছাত্র ইংরেজিতে তাৎক্ষণিক যে উত্তর দিয়েছিলেন, সেটির বাংলা অনুবাদ হয় এমন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ফার্স্ট ক্লাসের জন্য আসিনি। ক্লাস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে শেখায় না। অতএব স্যার, আপনার অনুমতি পেলে আমি কি এই মুহূর্তে আপনার ক্লাস এবং বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে পারি?’ এভাবে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৭-তে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি টানেন সৈয়দ শামসুল হক।

সৈয়দ হক তাঁর আত্মজীবনী তিন পয়সার জোছনাতে লিখেছেন, হয়তো সেদিনের সেই বক্তব্যের পেছনে তাঁর অগ্রজতুল্য দিকনির্দেশক প্রয়াত ফজলে লোহানীর ‘বিশ্বই তোমার বিশ্ববিদ্যালয়’ কথাটির প্রণোদনা ছিল।

না, এই নিয়ে কোনো গ্লানির কথা কখনো মনে আসেনি তাঁর, বরং আত্মজীবনীতে সদ্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় নিজের ইতি টানার পরবর্তী পরিস্থিতির ছবি এঁকেছেন এইভাবে, ‘আমাকে আর পায় কে!...সাহিত্যের তরঙ্গে নৌকো আমার, বাইরে আমাকে যা-ই দেখাক না কেন, ভেতরে আমি চিরকালের বোহেমিয়ান, খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসা চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম পৃথিবীর রোদ্দুরে।’ হ্যাঁ, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হিম ছড়ানো, তবু তখন থেকে পৃথিবীর রোদ্দুরেই যেন স্নান শুরু তাঁর। ড্রপআউট তাঁকে বিচ্যুত করেনি বরং বিস্তার ঘটিয়েছে অনেক। সাহিত্যমাঠে চাষাবাদে সক্রিয়তা বেড়েছে তাঁর—লিখেছেন কবিতার পর কবিতা, গল্পের পর গল্প। পরে সাহিত্যের সংসারে সম্পূর্ণ সমর্পণ; আশি বছর নয় মাসের জীবনে তাঁর পেশাগত পরিচয় দাঁড়ায় ‘সার্বক্ষণিক লেখক’।

১৯৫৭-তে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ইতি টানলেন আর এর পরপরই ১৯৫৯-এ প্রকাশিত হলো তাঁর উপন্যাস দেয়ালের দেশ, এক মহিলার ছবি। এস এম পারভেজ প্রস্তাব দিলেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার; নিজেরই গল্প অবলম্বনে তৈরি করলেন চিত্রনাট্য মাটির পাহাড়মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য বাবদ প্রাপ্ত আগাম টাকায় নভেম্বরের শীতে বাদামি রঙের বুকখোলা হাফ সোয়েটার গায়ে দিলেন, তাঁর ভাষায় ‘আরাম হলো শরীরে, আকাশটা দেখাল কী উজ্জ্বল!—পিঠের ওপর অনুভব করে উঠলাম উড়ে যাবার পাখা।’ এভাবে পৃথিবীর পাঠশালাই সৈয়দ শামসুল হককে দিয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিকের বিধিবদ্ধ গণ্ডি ছেড়ে শিল্পের বিশাল আকাশে উড্ডয়নের সাহস।