একজন পাঠকের হাজারটা জীবন থাকে: স্টিফেন কিং

স্টিফেন কিং
স্টিফেন কিং

স্টিফেন কিং একজন মার্কিন লেখক। তাঁকে বলা হয় ‘কিং অব হরর’, ভূতের গল্পের রাজা! তাঁর লেখা বই অবলম্বনে তৈরি হয়েছে বহু চলচ্চিত্র, যেগুলো পরে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। গত বছরও আলোড়ন তুলেছিল স্টিফেন কিংয়ের লেখা বই থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র ইট। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল বুক ফেস্টিভ্যাল’-এ নিজের লেখকজীবন নিয়ে বলেছিলেন তিনি বাপরে! এখানে তো দেখছি অনেক লোক!

একটু আগেই আমার জীবনের প্রথম বই বের করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হচ্ছিল। ক্যারি, আমার প্রথম উপন্যাস। মেইনের একটা বইয়ের দোকান একবার আমাকে আমন্ত্রণ জানাল। পাঠকদের সঙ্গে দেখা হবে, অটোগ্রাফ দেব, এই ছিল উদ্দেশ্য। একটা ঘরে টেবিল নিয়ে বসলাম। টেবিলের ওপর ক্যারির কয়েকটা কপি। আমার মনে আছে, সারা দিনে ৫ জন মানুষ এসেছিল। তাদের মধ্যে ৩ জন আমার কলেজের বন্ধু। মোটাসোটা একটা বাচ্চা ছেলেও এসেছিল। সে কুংফু-বিষয়ক বই খুঁজছিল। আমি তাকে বই খুঁজতে সাহায্য করেছিলাম, সম্ভবত কৃতজ্ঞতাবশত সে আমার এক কপি বইও নিয়েছিল।

আজ এখানে অনেক মানুষ। লেখকেরা অনেকটা ‘সিক্রেট এজেন্ট’-এর মতো। আমাকে আপনাদের দেখার কথা। আপনাদের আমাকে দেখার কথা নয়। অতএব আজকের অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন।

মজার ব্যাপার হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে বহু বছর আগেই আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম। একটা বই লিখেছিলাম, নাম দ্য ডেড জোন (হাসি)। তো, বইটা লেখার পর প্রকাশক আমাকে নিউইয়র্কে পাঠালেন। আমার হাতে পুরো একটা দিনের অবসর ছিল। অতএব চলে গেলাম নাথানস হট ডগসে। রেস্তোরাঁটার কথা সব সময় শুনেছি। তো, গেলাম সেখানে, কয়েকটা হট ডগ অর্ডার করলাম। আমার সঙ্গে সব সময় একটা বই থাকে। এক কোনায় বসে আমি হট ডগ খাচ্ছিলাম আর বই পড়ছিলাম। বলছি ১৯৭৯ কিংবা ১৯৮০ সালের কথা। আমার চুল তখনো কালো ছিল। মুখে লেখকসুলভ দাড়ি আর চোখে চশমা ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, আমাকে নিশ্চয়ই বেশ ভাড়িক্কি আর ভালো দেখাচ্ছে!

হঠাৎ লক্ষ করলাম, হেঁশেল থেকে একজন শেফ বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আবার আমি তাঁর দিকে তাকালেই চট করে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আমি আবারও পড়ায় মন দিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি একদৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। মনে মনে ভাবলাম, লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে চিনে ফেলেছেন! যাক, আমি তাহলে একজন বিখ্যাত লেখক হয়ে উঠছি! খাওয়া শেষে যখন চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘আপনি কি পরিচিত কেউ?’ আমি বললাম, ‘প্রতিটি মানুষই কারও না কারও পরিচিত।’ তিনি বললেন, ‘না, সেটা ঠিক। কিন্তু আপনি কি বিখ্যাত কেউ?’ আমি বেশ বিনয়ের সঙ্গে বলার চেষ্টা করলাম, ‘উমম...বলতে পারেন।’ তিনি বললেন, ‘আপনি কি ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ!’ আপনারা তো জানেন, লেখকেরা চরম মিথ্যাবাদী। মিথ্যা গল্প বানানোই আমাদের কাজ। এমনকি আমি লোকটাকে একটা অটোগ্রাফও দিলাম, তিনি খুশিমনে বিদায় নিলেন।

এ ঘটনাটা আমাকে সব সময় আরেকটা ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। একবার আমার বন্ধু জন গ্রিশামের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। জন খুব ভালো গল্প বলতে পারে। ব্রাডেনহাম পাবলিক লাইব্রেরির একটা অনুষ্ঠান শেষে আমরা একসঙ্গে ফিরছিলাম। হঠাৎ জন বলল, ‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? আমরা এমন একটা দেশে লেখালেখি করি, যেখানে মানুষ খুব একটা বই পড়ে না।’ কথাটা কতটুকু ঠিক আমি জানি না। তবে এটা ঠিক, আমাকে যে মানুষ কতবার অন্য লোক ভেবে ভুল করেছে, তার হিসাব নেই। অসংখ্যবার এমন হয়েছে, লোকে আমার কাছে ছুটে এসে বলেছে, ‘আপনি স্টিভেন স্পিলবার্গ না?’ আমি বলেছি, ‘আপনার ভুল হচ্ছে। আমরা দুজনই মানুষকে ভয় দেখাই, তবে আমরা একই মানুষ নই। তিনি ভয় দেখান হাঙর দিয়ে আর আমি ভয় দেখাই ভাঁড় দিয়ে।’ আবার অনেকে আমার কাছে এসে বলেন, ‘আমি আপনার একটা বইও পড়িনি। কিন্তু আপনার সবগুলো সিনেমা দেখেছি।’

ফ্লোরিডায় একবার একটা সুপারমার্কেটে গিয়েছি। এক বৃদ্ধা আমার কাছে এসে বললেন, ‘আমি আপনাকে চিনি। আপনি স্টিফেন কিং। যত সব ভয়ের সিনেমা, ওগুলো আপনার লেখা। অনেকে আপনার লেখা সিনেমা পছন্দ করে, কিন্তু আমি করি না। আমার ভালো লাগে রোমাঞ্চকর ছবিগুলো। যেমন শশাঙ্ক রিডাম্পশন!’ আমি রীতিমতো হতভম্ব! বললাম, ‘আরে, শশাঙ্ক রিডাম্পশনও তো আমারই লেখা।’ তিনি বললেন, ‘অসম্ভব, হতেই পারে না!’

পুরোদস্তুর লেখক হওয়ার আগে দুই বছর আমি ইংরেজির শিক্ষক ছিলাম। এই সময়টাতে দুই ধরনের ছাত্র দেখেছি। এক ধরনের ছাত্র নিজ তাড়নায় পড়ে। যা পড়ছে, আগ্রহ নিয়ে সেসব নিয়ে আলোচনা করে। আরেক দল আছে, যারা কখনো আনন্দ পাওয়ার জন্য পড়ে না। এরা টিভি দেখে বড় হয়েছে। যতটা সম্ভব কম লিখতে চেষ্টা করেছে। তাদের লেখার অভিজ্ঞতা কেবল খুদে বার্তা আর ই-মেইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি এদের ফেসবুক প্রোফাইলেও লেখার চেয়ে ছবি বেশি।

আমাকে ভুল বুঝবেন না। এরা প্রত্যেকেই কিন্তু ভীষণ মেধাবী। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু প্রতিভা আছে। এরা উচ্ছল, স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু কেন যেন আমার ক্লাসে এলেই ওদের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। আমি যা-ই করি না কেন, ক্লাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে অন্ধকার আর দূর হয় না। আমি ভেবে দেখেছি, এদের বাসায় হয়তো খুব অল্প কিছু বই আছে। বিপণিবিতান থেকে বিনা মূল্যে দেওয়া পত্রিকায় ওরা হয়তো একটু-আধটু চোখ বুলিয়েছে। ওরা পৃথিবীর খবর পায় টুডে শো, ফক্স নিউজ কিংবা রাশ লিমবো থেকে। টুকটাক কবিতা হয়তো পড়েছে, তা-ও কেবল কার্ডে লেখা শুভেচ্ছাবার্তায়।

এটা ছিল এক অ-পাঠকের দুনিয়া। আমার ক্লাসের এই ছাত্ররা হয়তো বই পড়তে চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। কারণ তাদের কাছে কাজটা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। তারা ভেবেছে বই পড়া কঠিন একটা কাজ, কিন্তু এই কাজের বিনিময়ে কোনো পুরস্কার নেই।

তখন ঠিক করলাম, ছয় কি সাত বছর বয়সেই ওদের কাছে পৌঁছাতে হবে। হয়তো ওই বয়সটাতে আমি ওদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারব। বোঝাতে পারব, বই তোমাকে চাকরির নিশ্চয়তার চেয়েও বেশি কিছু দেবে। অ-পাঠকেরা কেবল ‘একটা’ জীবনযাপন করে। হতে পারে একটা সুন্দর জীবন, চমৎকার জীবন, কিন্তু সে জীবন একটাই। অন্যদিকে একজন পাঠকের হাজারটা জীবন থাকে। আমি শিশুদের ভেতরে এই বিশ্বাসের জন্ম দিতে চেয়েছি।

সঠিক বইটা সঠিক মানুষের হাতে পড়লে, একটা আলোর জন্ম হয়। যে আলো একজন থেকে আরেকজনের হাতে ছড়িয়ে পড়ে। আমার অসম্ভব আনন্দ হয়; যখন কেউ বলে কিংবা চিঠি লিখে জানায়, আমার লেখা তার ভালো লেগেছে, তাকে অনুপ্রাণিত করেছে।

আজকে যে টি-শার্ট পরে আসব ভেবেছিলাম, সেটা পরা হয়নি। আবারও এই লাল টি-শার্ট পরেই আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। লাল হচ্ছে ক্ষমতার রং। ভেবে ভালো লাগছে, আমার টি-শার্ট আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের টাইয়ের রং এক। সে যাকগে, যে টি-শার্টটা পরতে চেয়েছিলাম, সেটার ওপর লেখা ছিল, ‘রিয়েল মেন রিড’। সুযোগ পেলেই আমি ওই টি-শার্টটা পরি। কারণ, ছোটবেলায় আমাকে অনেক টিটকারি শুনতে হতো। রাস্তার ওপারে একজন কৃষক থাকতেন। তিনি আমার দিকে আঙুল তুলে বলতেন, ‘ওই যে যায় স্টিভি। বোকাটা সব সময় বইয়ের মধ্যে নাক ডুবিয়ে থাকে।’ সম্ভব হলে আজ আমি সেই কৃষকের কাছে যেতাম। ট্রাক্টর থেকে নামিয়ে তাকে বলতাম, ‘দেখো, একদিন আমি বইয়ে নাক ডুবিয়ে থাকতাম। আর এখন একটা বিলাসবহুল মার্সিডিজের আরামদায়ক আসনে ডুবে থাকি!’

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও