মেয়েটিকে নিজ দায়িত্বে নিরাপদে ঘরে ফিরতে হয়

বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়া, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে নানা উদ্যোগের কথা শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু রাষ্ট্র কি গণপরিবহণে নারীর নিরাপত্তা দিতে পারছে? ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, গণপরিবহনে ১৩ মাসে ২১ নারীকে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। সম্প্রতি গণপরিবহণে রুপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ও হয়েছে। মেয়েরা পারিবারিক সামাজিক বাধা পেরিয়ে নিজের যোগ্যতা, দক্ষতার প্রমাণ দিতে বাইরে যাচ্ছেন। সবার তো ব্যক্তিগত পরিবহন থাকে না, সেটা বাস্তবও নয়। লাখ লাখ মেয়ের জন্য গণপরিবহনই ভরসা। কিন্তু তা অনিরাপদ। যে মেয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন, তাঁকে নিজ দায়িত্বে ঘরে ফেরা নিশ্চিত করতে হবে!

এ বিষয়ে বিশিষ্টজনেরা তাঁদের মতামত দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌহিদা শিরোপা, ঢাকা

ফওজিয়া করিম
ফওজিয়া করিম

প্রয়োজনে সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে
ফওজিয়া করিম
সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

অ্যাকশন এইডের একটি প্রতিবদনে বলা হয়েছিল, গণপরিবহন ও জনসমাগমের জায়গায় (পাবলিক প্লেস) ৮১ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। রুপা ধর্ষণ ও হত্যার মামলার রায় দ্রুত হওয়ায় আমরা অবশ্যই খুশি। এটা বিজয়। কিন্তু এমন শত শত মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। নানা টালবাহানা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘসূত্রতার নানা কারণ দেখায়। একটা মামলায় দীর্ঘসূত্রতা থাকতে পারে, কিন্তু সব মামলায় থাকবে, সেটা তো হতে পারে না।

রুপার মামলা গণমাধ্যমে এসেছে, আলোচিত হয়েছে। তাই দ্রুত বিচার হয়েছে। এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় হলো, এটা যখন পেরেছি আমরা, তার মানে অন্য মামলার ক্ষেত্রেও এটা করা সম্ভব।

জেলা জজকোর্টে রুপার মামলা করার সময় জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি যুক্ত ছিল। নারীর নির্যাতন কোনো অবস্থাতে চাপা দেওয়া যাবে না। গণপরিবহনে নারীদের আরও সুবিধা দিতে হবে। প্রয়োজন হলে সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে। তাহলে বাসের চালক ও সহকারীরা ভয়ে থাকবে।

নারীর সমস্যা নারীরা সমাধান করবে, এই ভাবনা থেকে বের হয়ে পুরুষদের এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরও পাশে নিতে হবে।

আবিদা সুলতানা
আবিদা সুলতানা

এটা নারীর জন্য অসম্মানের
আবিদা সুলতানা
অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ।

গণপরিবহনে নারীরা যে চরম হয়রানির শিকার হন, এটা তাঁর জন্যও অসম্মানের। মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সম্মানটুকু পান না সেখানে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন হিসেবে বলতে পারি, বাংলাদেশ পুলিশ নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার।

আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে শক্ত আইন রয়েছে। না-জানা এবং লোকলজ্জার কারণে আইনের সুবিধাগুলো নিতে পারি না। কোনো নারী যদি গণপরিবহনে বা কোথাও নির্যাতনের শিকার হন, আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করলে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেব। আগেও নিয়েছি।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গণপরিবহনে নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পরিবারে পরিবারে কাজ করতে হবে। মানবিক মূল্যবোধ থেকে সরে
যাচ্ছি আমরা। সেটা নিয়ে কাজ করার আছে। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের প্রতিবাদ করা শেখাতে হবে।

তাসলিমা আখতার
তাসলিমা আখতার

বিচার তো দ্রুত করতেই হবে, শাস্তিও দ্রুত দিতে হবে
তাসলিমা আখতার
সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ও আলোকচিত্রশিল্পী

বাংলাদেশের নারীরা আর ঘরে বসে নেই। তাঁরা বেরিয়ে আসছেন, কাজ করছেন। গণপরিবহনে যাতায়াত করেন তাঁরা। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কতটুকু নাজুক—তা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়। বাসচালক, সহকারী—এরা ক্ষমতাসীন দলে বা তাঁদের ছত্রছায়ায় থাকলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা পার পেয়ে যান। আবার যাঁরা ক্ষমতাসীন না, তাঁরাও এটা দেখে অন্যায় করার, অপরাধ করার সাহস পান। সেজন্য অপরাধী যেই হোক, বিচার দ্রুত তো করতেই হবে, শাস্তিও দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। যাতে উচ্চ আদালতে গেলেও অপরাধী পার না পায়।

রুপার মামলার দ্রুত রায় হয়েছে, এটা ভালো। অপরাধীরা যেন দ্রুত শাস্তি পায়। গত বছর বা চলতি বছরে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের অন্যান্য মামলাও এই প্রক্রিয়ার মতো দ্রুত করতে হবে। সমাজের উচ্চশ্রেণির কেউ হলে দেখা যায় সেটা ধামাচাপা পড়ে যায়। সেটা হতে দেওয়া যাবে না। কোনোভাবেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেন প্রতিষ্ঠা না পায়। নারী আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। রাষ্ট্রের ওপর শুধু নির্ভর না করে এলাকায় এলাকায় নারী-পুরুষ মিলে সোচ্চার হতে হবে, সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী
মোজাম্মেল হক চৌধুরী

গণপরিবহনকে নারীবান্ধব করতে হবে
মোজাম্মেল হক চৌধুরী
মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি

গত ১৩ মাসের বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন ধরে আমরা এটি তৈরি করেছি। গণপরিবহনে নারীবান্ধব, তাঁদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে কাজ করি আমরা। বেশির ভাগ কর্মজীবী নারী গণপরিবহনে যাতায়াত করেন। দেখা যায়, গণপরিবহনের চালক ও তাঁদের সহকারীরা নারীর প্রতি সচেতন ও দায়িত্বশীল নন। বেশির ভাগ সময় তাঁরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন।

নারীকে বাদ দিয়ে তো সমাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু গণপরিবহনে নিরাপত্তা দিতে না পারলে নারীর কাজ করার হার কমে যেতে পারে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। রুপার ঘটনার মতো অনেক ঘটনা ঘটে। সহিংসতার সব খবর পত্রিকার পাতায় আসে না। গণপরিবহনকে নারীবান্ধব করতে হবে। রুপার ঘটনার পর আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। চালক ও বাসের অন্যান্য সহকারী এমনকি বাস টার্মিনালে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরও নারীবান্ধব করে তুলতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, জোরালো আইন এবং কেউ যদি এমন অপরাধ করেন, তাহলে দ্রুত কোনো শাস্তি হলে এ ধরনের অপরাধ কমানো সম্ভব।