মনে জোর রাখো, আশা রাখো

>
তাওয়াক্কল কারমান।  ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
তাওয়াক্কল কারমান। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ব্যস্ত সফরসূচির কারণে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমানের সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ডের ম্যারেইড ম্যাগুয়ার, ইরানের শিরিন এবাদি ও ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান-তিন নোবেল বিজয়ী গত ২৫ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের এবং বান্দরবান জেলার তমরু সীমান্তের শূন্যরেখায় আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাক্ষাৎকারের বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। তাওয়াক্কল কারমান বলেন, ‘এখানেই কাজটা সেরে নেওয়া যাক। যতটুকু সম্ভব হয়।’ সেখানেই কথা হলো তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশির মোড়ল

প্রথম আলো: আপনি তো একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মী। 

তাওয়াক্কল কারমান: তিনটি কাজই আমার পছন্দ। স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার হচ্ছে আমার পরিচিতি। নারীও আমার একটি পরিচিতি। স্বাধীনতা রক্ষায় ও উন্নয়নে নারী হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। তিনটি অবস্থান থেকেই মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করা যায়। আমি মানুষের অধিকার রক্ষায় সমর্থন দিতে চাই। সেটা সাংবাদিক হয়ে দেওয়া সম্ভব, রাজনীতিক হয়ে সম্ভব, মানবাধিকারকর্মী হয়েও সম্ভব। তিনটি ভূমিকায় থেকে মানুষের জন্য কাজ করতে চাওয়াও আমার অধিকার। এটা আমার দায়িত্বও বটে।
প্রথম আলো: কোন বিষয়ে আপনি রিপোর্ট করতে পছন্দ করতেন বা নিবন্ধ লিখতেন?
তাওয়াক্কল কারমান: আমি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বেশি লিখেছি। আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বাধা যা কিছু ছিল, আমি সেসব সম্পর্কে লিখেছি। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লিখেছি। একজন সাংবাদিক, নাগরিক ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমার সামনে যত বাধা এসেছে, আমি ভেঙেছি।
প্রথম আলো: আপনাকে এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে?
তাওয়াক্কল কারমান: আমার সামনে বিপদ এসেছে। আমাকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে আমার সামনে বাধা এসেছে। আমি দমিনি।
প্রথম আলো: ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে বের হওয়ার সময় আশপাশে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের আপনি বারবার বলছিলেন, ‘শক্ত হও’ ‘শক্ত হও’। আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছিলেন?
তাওয়াক্কল কারমান: আমি বোঝাতে চাইছিলাম যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মনে জোর থাকা উচিত। তারা যে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছে, এখন যে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে, তা যেন তারা ভুলে না যায়। এই অভিজ্ঞতার স্মৃতি তাদের এগিয়ে নেবে।
প্রথম আলো: রোহিঙ্গাদের জন্য আপনার বার্তাটা আসলে কী?
তাওয়াক্কল কারমান: আমি এটা বলতে চাইছি যে রোহিঙ্গাদের আশাহত হলে চলবে না। আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না। রোহিঙ্গাদের নিজেদের শিশুদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। এই শিশুরাই যেন বড় হয়ে রোহিঙ্গাদের এগিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করে।
প্রথম আলো: তিন দিনে একান্তে বেশ কিছু নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে আপনারা পৃথকভাবে কথা বলেছেন। অভিজ্ঞতা শুনেছেন, তথ্য নিয়েছেন। আপনারা তাদের কী বলেছেন?
তাওয়াক্কল কারমান: রোহিঙ্গা নারীদের হত্যা, ধর্ষণ, খুন, অগ্নিকাণ্ড-এসবের যে অভিজ্ঞতা তার সব বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না। এখনো দুঃসহ দুঃখ ও যন্ত্রণা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে। আমরা বলেছি, মনে জোর রাখো। মনে আশা রাখো। অন্যায়ের বিচার হবেই। একদিন অবশ্যই তোমরা তোমাদের সব অধিকর ফিরে পাবে। তোমরা সব অধিকার ভোগ করতে পারবে।
প্রথম আলো: কক্সবাজারে একাধিক বার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্পর্কে কথা বলেছেন। তাদের ভূমিকা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
তাওয়াক্কল কারমান: লজ্জার, লজ্জার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা লজ্জাজনক। তারা এখানে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। একবিংশ শতাব্দীতে গণহত্যা চলছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ করে আছে। জাতিগত নিধন চলছে, তাদের বিকার নেই।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশির মোড়ল