মুক্তিযুদ্ধের চর্চা করুন: মাশরাফি

>

প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১ আয়োজিত ‘কুইজে একাত্তর’ অনুষ্ঠানে মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১ আয়োজিত ‘কুইজে একাত্তর’ অনুষ্ঠানে মাশরাফি বিন মুর্তজা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

বাংলাদেশ জাতীয় ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা একবার বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারাই এ দেশের নায়ক। সম্প্রতি প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১ আয়োজিত ‘কুইজে একাত্তর’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন আবারও। কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ ও সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর ভাবনা

যা ধারণা করেছিলাম, সেটাই। সবাই মোবাইল বের করে ফেলেছেন। আমাদের দেশটা মোবাইলে ঢুকে গেছে। আসলে কিছু জানতে হলে মোবাইল থেকে আপনারা কী জানবেন? আপা (শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী) বক্তব্য রাখলেন। তাতে কি আপনাদের কারও ভেতরে কোনো আবেগ সৃষ্টি হলো না? খুবই দুঃখজনক। আজকে দলে দলে এসে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানুন। এটা তো আমাদের কারও বলার কথা ছিল না।

কারও মনে আঘাত দিয়ে থাকলে আমি দুঃখিত, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানার কথা উঠলে আপনারা সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল বের করে ফেলবেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমিও তেমন কিছু জানি না। যাঁদের সম্পর্কে জানি না, তাঁদের সম্পর্কে বিস্তরভাবে আলোচনা না করে বরং বেশি করে জানার চেষ্টা করা উচিত। আমি যতটা জানি, নিজের ভেতরে যতখানি অনুভব করি, সেটুকু আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারি।

স্কুল থেকে যা শুনেছি, শিক্ষকদের কাছে যা শুনেছি, বাসার মানুষদের কাছে যা শুনেছি, সবার কাছে যা শুনেছি, বড় হয়ে আশপাশে যা শুনেছি, তা থেকে আমার মনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে একটা উপলব্ধি হয়েছে। আজ যাঁদের কারণে আমরা ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা বলতে পারছি, তাঁদের অবশ্যই সবকিছু থেকে আলাদা করে রাখা উচিত।

বাংলাদেশে যাঁরা সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তাঁরা তা পাচ্ছেন। নিজের দিকে তাকিয়ে আমি দেখছি যে আপনাদের কাছ থেকে আমি একটা সম্মান পাচ্ছি। অন্য যাঁরা বাংলাদেশের জন্য বিরাট অবদান রাখছেন, তাঁরাও অবশ্যই সম্মান পাচ্ছেন। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে আমরা তাঁদের নিয়ে আলোচনা করছি। সমালোচনাও করছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার জন্য যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেই মানুষগুলো কিন্তু আমাদের সবার ঊর্ধ্বে। তাঁরা যে অবদান রেখে গেছেন, সে রকম অবদান আমরা কেউ রাখতে পারিনি। যদিও তাঁদের যে সম্মান দেওয়া উচিত ছিল, শুধু শুধু আমরা সে রকম সম্মান বয়ে বেড়াচ্ছি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার জন্য যে কুইজ করতে হয়, এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু নেই। একাত্তর এমন একটা জিনিস, যার সম্পর্কে আপনি নিজে থেকেই জানতে চাইবেন। আমি বলেছি, আমি নিজেও অনেক কিছু জানি না। কিন্তু বাসায় যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো ছবি দেখি, তখন সেটা দেখতে মন চায়। মনে হয় দেখি। সত্যিকার যুদ্ধ আমরা দেখিনি। আমি জানি, এটা সিনেমা। তবু দেখতে ইচ্ছা করে, হয়তো এভাবেই তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন। এভাবেই হয়তো একজন মা তাঁর ছেলেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আপনারা ছবিগুলো দেখুন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু বই লেখা হয়েছে। বইগুলো আপনারা পড়ুন। আমার বিশ্বাস, আপনাদের ভেতরে অন্য রকম অনুভূতি তৈরি হবে।

প্রথম আলো একবার একটা আয়োজন করেছিল। পত্রিকাটির শেষ পৃষ্ঠায় প্রতিদিন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে লেখা হতো। প্রতিদিন আমি ওই অংশ পড়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। এটা আসলে অনুভূতির ব্যাপার। হয়তো এর চর্চা করছেন না বলেই আপনাদের ভেতর ওই অনুভূতি আসছে না। জানি, পড়ালেখা নিয়ে আপনাদের কারও ব্যস্ততা আছে। কেউ হয়তো তাঁর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। আমিও খেলা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকি। এর ভেতরেও কেউ বলতে পারবেন না, আমার আধ ঘণ্টা সময় নেই। আমরা সবাই এই বাড়তি সময়টুকু মনের আনন্দে ব্যয় করছি। আপনি আগামী ১৫-২০টা দিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা করুন, দেখবেন আপনার ভেতরে ওই অনুভূতি সৃষ্টি হবে। আমি নিশ্চিত, এটা হতে বাধ্য। কারণ, আমারও এটা এক-দুই দিনে হয়নি। জানতে জানতে আমার ভেতরে কাজ করেছে। আপার কথা শুনে আমার ভেতরে আবেগ জেগে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের সবারই আবেগের বিষয়।

আজকাল দেখি, অনেকেই ঠাট্টা করেন যে এই ছেলে মুক্তিযুদ্ধ বা দেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না। যে ছেলেটা জানে না, শুধু শুধু তাকে এলোমেলো প্রশ্নে বিভ্রান্ত করা একটা মজার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে খবর প্রকাশ করা আমাদের জন্য অসম্মানের। এভাবে ঠাট্টা করা ঠিক নয়। যাঁরা এগুলো করছেন, অনুরোধ করি, দয়া করে এসব করবেন না। তারা কেন জানে না, বরং সেটা আমাদের খুঁজে বের করা উচিত। এটা তীব্র আবেগের জায়গা। তারা না জেনে থাকলে তাদের সহযোগিতা করুন। তারা যাতে জানতে পারে, সে জন্য পরিবার ও স্কুল থেকে তাদের সহযোগিতা করা উচিত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে সবাই যেন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে। আমার বিশ্বাস, আমরা সহযোগিতা করলে এটা সম্ভব।

শেষে একটা কথা বলতে চাই, আপনারাও ইনশা আল্লাহ এক দিন তারকা হবেন। বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে যাঁরা দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তাঁরা এ স্বপ্নই দেখেছিলেন যে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবশ্যই থাকতে হবে। তার সঙ্গে ভালো কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

আমি বিশ্বাস করি, আপনারা ভালো কাজ করবেন। বাংলাদেশকে আমরা বহির্বিশ্বে একটা সেরা দেশ হিসেবে দেখতে চাই। সেটা কিন্তু নির্ভর করছে আপনাদেরই ওপর। আপনারা যাঁরা তরুণ, যাঁরা এখনো পড়ালেখা করছেন, আপনারা চাইলে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আপনাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন সেরা হয়ে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

আমার ছেলেমেয়েও বড় হচ্ছে। আমি চাই, তারাও একাত্তর সম্পর্কে জানুক, বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানুক। জানুক, কোন ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীনভাবে চলছি, যা একাত্তরের আগে সম্ভব ছিল না। আমার ছেলেমেয়েকে এই জানানোর কাজটা হয়তো আপনাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন করবেন। সেই ভাবনা থেকেই আমি এখানে এসেছি। আপনারা জানলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও জানবে।

সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত