পাচার প্রতিরোধ বড় চ্যালেঞ্জ

হলিউড অভিনেতা অ্যাস্টন কুচার যখন নারী পাচারের বিরুদ্ধে।  ছবি: টুডেডটকম
হলিউড অভিনেতা অ্যাস্টন কুচার যখন নারী পাচারের বিরুদ্ধে। ছবি: টুডেডটকম

বিবিসির অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে জানা যায়, কাজ দেওয়ার নামে, ভালো থাকার প্রলোভনে কিশোরী রোহিঙ্গা মেয়েদের ভারতের বিভিন্ন স্থান, দুবাই, লেবাননসহ নানা দেশে পাচার করা হচ্ছে। ভারত থেকে কয়েকজনকে উদ্ধারও করা হয়েছে। এদের বাংলাদেশি হিসেবে পাচার করা হয়। আবার দেশের মধ্যেও বিভিন্ন হোটেল বা বাড়িতে যৌন কর্মে বাধ্য করার ঘটনা ঘটছে।

পরিবারের সব সদস্য হারানো একা এই মেয়েরা আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তাদের পাচার এবং যৌন কর্মে বাধ্য করার পাশাপাশি জোর করে বিয়ে দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।

বিভিন্ন নেটওয়ার্ক জানায়, পাচারের অভিযোগ আছে স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে; যাঁদের অনেকে মাদক পাচারের সঙ্গেও জড়িত বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা মেয়েদের সুরক্ষার নামে বিভিন্ন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা কারা! সুরক্ষার নামে পাচার হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। তবে আগে আসা মানে পুরোনো রোহিঙ্গারা পাচারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে, অনেক সময় মুখ্য ভূমিকা পালনও করছে।

ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও পাচার-প্রক্রিয়ার কাজ হয়ে থাকে। আবার রোহিঙ্গা কিশোরীদের কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে ইন্টারনেটে তথ্য দেওয়া হয় বলে পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে। ফলে এখন ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধ করা জরুরি।

কেন হচ্ছে?
রোহিঙ্গারা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। সহায়-সম্বলহীন পরিবারের মেয়েরা কাজের নামে, নানা প্রলোভনে দালালদের খপ্পরে পড়ে। দেশে ও দেশের বাইরে যেহেতু কিশোরী মেয়েদের চাহিদা আছে, তাই তারা অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় আছে। পাচারের সঙ্গে জড়িত দুষ্টচক্র সেই সুবিধা নিচ্ছে। এতে কিশোরীরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ছে। দেশের যৌনপল্লিতেও এ ধরনের মেয়ে পাওয়া যাওয়ার কথা জানা যাচ্ছে।

পাচারের শিকার নারী ও শিশুদের উদ্ধার করা হলেও তারা পাচারকারী বা পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা বলতে পারে না। যোগাযোগের ফোন নম্বর থাকলেও বন্ধ পাওয়া যায়। দালালরা মাঝেমধ্যে চিহ্নিত হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। পাচার প্রতিরোধে এটা বড় চ্যালেঞ্জ।

আশ্রয় নিতে এসে এই নারীরা যাতে পাচারের শিকার না হয়, সেটাই সবার কাম্য। ছবি: এএফপি
আশ্রয় নিতে এসে এই নারীরা যাতে পাচারের শিকার না হয়, সেটাই সবার কাম্য। ছবি: এএফপি


প্রতিরোধে করণীয়
সরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) তৈরি করাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু কিশোরীদের সুরক্ষায় সরকারের পাশাপাশি দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আরও সক্রিয় হতে হবে। পরিচয়পত্র দেওয়ার সময় যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।

পাচার বন্ধে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২’ আছে। এই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন জরুরি। আইনি সহায়তা নিলে আক্রান্ত নারী ও শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় মানব পাচার প্রতিরোধে ৩০ বছর ধরে কাজ করছি। কিন্তু সম্প্রতি দেশে রোহিঙ্গা কিশোরীদের পাচার এবং যৌন কর্মে নিয়োজিত করার যে চিত্র উঠে আসছে, তা জেনে আতংকিত হয়েছি। এ তথ্য মারাত্মক ও ভয়াবহ। এটি বন্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতির আরও বিপর্যয় ঘটবে।

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা হলে গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। এর ১০ দিনের মাথায় আমি কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তে যাই। সকাল ছয়টায় এবং রাতে সেখানকার সীমান্ত এলাকাকে চরম অরক্ষিত অবস্থায় পাই। কোনো চেকপোস্ট নেই। কোনো নজরদারি নেই।

রোহিঙ্গাদের যেভাবে ছোট ছোট যানবাহনে করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তাতে সহজেই অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। তখন সীমান্ত এলাকায় কর্তব্যরত এক কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, এদের যেভাবে নেওয়া হচ্ছে, তাতে নারীদের বিপদ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘এসব দেখা আমার দায়িত্ব নয়। ওপরের কর্মকর্তাদের বলেন। আর বিষয়টি দেখছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান।’

আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি প্রাথমিকভাবে যখন তৃণমূল পর্যায়ে দেখভালের দায়িত্ব থাকে, তখন অভিজ্ঞতার ঘাটতি বা অসাধুতার কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র এবং সুবিধাভোগীরাও ওত পেতে থাকে।

আমি সরকারকে অনুরোধ করব রোহিঙ্গা কিশোরী মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর, যাতে ক্যাম্পগুলো কোনোভাবেই অরক্ষিত না থাকে। পাশাপাশি কক্সবাজারের মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনকে যুক্ত করে কারও মানবাধিকার ক্ষুণ্ন না করে নিয়মিতভাবে অভিযুক্ত স্থানীয় হোটেল, বাড়িতে তল্লাশি চালানো, মেয়েদের সচেতন করা। মানবাধিকারকর্মীদের নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে টাস্কফোর্স গঠন করা। এককথায় কিশোরীদের সুরক্ষায় আন্দোলন গড়ে তোলা। তুলতে হবে।

লেখক: মানবাধিকার আইনজীবী