হাসিনা ও মনিরের জন্য শুভকামনা

টিনের ঘর। আয়না, খাট, আলমারি, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে বড় ঘরটি বেশ পরিপাটি করে গোছানো। পাশেই ছোট একটি ঘর এবং ঘরের সঙ্গে লাগোয়া একটি চাপকল ও গোসলের জায়গা। বিয়ের পর এখানেই নতুন জীবন শুরু করেছেন হাসিনা আখতার ও তাঁর স্বামী মনিরুজ্জামান মনির।

কেমন আছেন জানতে চাইলে হাসিনার অ্যাসিডে দগ্ধ হওয়া, কুঁচকে যাওয়া মুখে খুশির ঝিলিক। অ্যাসিডে এক চোখ প্রায় বন্ধ ও ঘোলাটে হয়ে গেছে তাঁর। ওই চোখে দেখতে পান না তিনি। অন্য চোখটিতেই ভবিষ্যতের হাতছানি।

নতুন দম্পতি মনিরুজ্জামান মনির ও হাসিনা আখতার—এ হাসি থাকুক অমলিন।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
নতুন দম্পতি মনিরুজ্জামান মনির ও হাসিনা আখতার—এ হাসি থাকুক অমলিন। ছবি: সাইফুল ইসলাম

হাসিনার স্বামী অ্যাসিডে দগ্ধ নন। তিনি বললেন, তাঁরা বেশ সুখে আছেন এবং ভবিষ্যতেও সুখে থাকতে চান। স্ত্রীর শারীরিক যেসব সীমাবদ্ধতা আছে, তা জেনেই তিনি তাঁকে বিয়ে করেছেন, তাই এ নিয়ে আর নতুন কোনো প্রশ্ন নেই।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এই দম্পতিকে শুভকামনা জানানোর জন্যই সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার বোগাদিতে হাসিনার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া। বিয়ে হয়েছে গত বছরের নভেম্বর মাসে। আর বউ সেজে হাসিনা শ্বশুরবাড়ি এসেছেন গত ১৬ মার্চ।

ছবি: সাইফুল ইসলাম
ছবি: সাইফুল ইসলাম

হাসিনা আড়াইহাজারে উপজেলা সহকারী ভূমি অফিসে অফিস সহকারী হিসেবে ২০১১ সাল থেকে কাজ করছেন। এখন চাকরির পাশাপাশি সংসার সামলাচ্ছেন। হাসতে হাসতেই বললেন, সংসার করা খুব কষ্টের। কথার ফাঁকেই জানালেন, এমএ পাস স্বামী খুব ভালো মনের একজন মানুষ। বর্তমানে কয়েকটা টিউশনি করে সংসার চালাচ্ছেন। স্বামীর একটা চাকরি হয়ে গেলে ভবিষ্যতের স্বপ্নটা আরেকটু নিশ্চিন্তে দেখতে পেতেন।

হাসিনা নিজের সম্পর্কে নিজেই বললেন, ‘আমি সত্য কথা বলতে ভয় পাই না। উচিত কথা বলতে ছাড়ি না। তাই অনেকে আমাকে পছন্দ করে না। নতুন সংসার, বুঝতে পারছি আমার মেজাজ একটু কমাতে হবে।’ হাসিনার শাশুড়িও এ কথায় সায় দিলেন। বলেই ফেললেন, বউয়ের মনটা ভালো। কিন্তু এত মেজাজ গরম করলে চলে?

হাসিনার বাড়িও আড়াইহাজার উপজেলায়। হাসিনা ২০০৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন। এরপর ২০০৪ সালের ২২ জানুয়ারি তাঁর জীবনে ঘটে ভয়াবহ ঘটনাটি। তিন বোনের মধ্যে হাসিনা সবার ছোট। তাঁর চার ভাই, বাবা, চাচা মিলে যৌথ পরিবারে হাসিনা বড় হয়েছেন। তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁদের বাড়িতে কাজ করা আমির হোসেন অ্যাসিড মারেন হাসিনা ও তাঁর এক ভাইয়ের শরীরে। হাসিনার একটি চোখ ও কান নষ্ট হয়ে যায়। মুখ, গলা, বুক, হাতের কিছু অংশসহ শরীরের বেশির ভাগ জায়গা দগ্ধ হয়।

ছবি: সাইফুল ইসলাম
ছবি: সাইফুল ইসলাম

হাসিনার পাশে দাঁড়ায় অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)। চিকিৎসা, প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সংস্থাটি। ২০০৮ সালের ৮ মার্চ প্রথম আলোতে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে হাসিনার জীবনের কাহিনী প্রকাশিত হয়। লেখাটি চোখে পড়ে তখনকার পুলিশের মহাপরিদর্শকের। তিনি আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারকে। পরের দিন ৯ মার্চ দুপুরের মধ্যে গ্রেপ্তার হন আসামি। আসামি ধরার পেছনে প্রথম আলো যে ভূমিকা পালন করেছে, এ কারণে কৃতজ্ঞতা জানালেন হাসিনা। রায়ে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত এ আসামি এখনো কারাগারে আছেন।

হাসিনার বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এএসএফের সদস্য ও অন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হাসিনার বিয়ের ছবি ও অন্যদের শুভকামনা জানানো অব্যাহত আছে। শ্বশুরবাড়িতে চলছে নতুন বউ দেখার পর্ব।

হাসিনা ভুনা খিচুড়ি, গরু ও মুরগির মাংস রান্না করেছেন। এক ফাঁকে হাসিনা স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন রান্না কেমন হয়েছে। একগাল হেসে মনিরুজ্জামান জানিয়ে দিলেন রান্না খুব ভালো হয়েছে।

 মনিরুজ্জামানের পরিবারের পক্ষ থেকেই প্রথম বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। হাসিনা বললেন, ‘এই জীবনে আমাকে বিয়ে করতে আর কেউ উৎসাহ দেখাননি। বিয়ে হলো। আমরা ভালো থাকতে চাই।’