অবিন্তার স্বপ্নের ফাউন্ডেশন

অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন স্কুলের শিক্ষার্থীদের তখন খেলার সময়। ছবি: সংগৃহীত
অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন স্কুলের শিক্ষার্থীদের তখন খেলার সময়। ছবি: সংগৃহীত

দিনটা কীভাবে যেন মিলে গেল। ঠিক দুই বছর আগে, ২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবিন্তা বাংলাদেশে ফিরেছিলেন। ফিরেছিলেন ছুটি কাটাতে। গত ২৭ জুন অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে বসে সে দিনের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন লুবনা আহ্‌মেদ, অবিন্তার খালা। ধরা গলায় বললেন অবিন্তার নানা স্বপ্নের কথা, ‘এটা অবিন্তার স্বপ্ন ছিল। অবিন্তার জন্যই করা। ও থাকলে ভালোভাবে কাজগুলো করত। আমরা চেষ্টা করছি তেমনটি করার, যেমন ও ভাবত।’

ঢাকার শাহজাদপুরে ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়। এটি যেন অবিন্তার রাজ্য। এলিগেন্ট হাইটস ভবনের ১৪ তলায়, যেখানে চোখ যায়, সেখানেই অবিন্তার ছোঁয়া। আমরা যে বৈঠকঘরে বসেছি, সেটার দেয়ালজুড়ে ফ্রেমে বাঁধানো অবিন্তার নানা অর্জনের সনদ। স্বেচ্ছাসেবী কাজ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আঁকিবুঁকি, পড়াশোনায় সেরা ফলাফলের স্বীকৃতি—কী নেই সেসব সনদে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই, ঢাকায় ফেরার তিন দিন পর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হন অবিন্তা কবির। তাঁর স্মৃতি ধরে রাখতে ২০১৭ সালের ৪ মার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন’।

অবিন্তা কবির  (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ – ১ জুলাই ২০১৬)
অবিন্তা কবির (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ – ১ জুলাই ২০১৬)

অবিন্তার স্বপ্নে গড়া স্কুল
এ যেন শিশুদের আনন্দ উদ্যান। দেয়ালে দেয়ালে আঁকিবুঁকি। অবিন্তার ছোটবেলার আঁকা ছবিগুলো। শ্রেণিকক্ষেও তা-ই। তবে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে আলাদা নজর কাড়ল মাটির ব্যাংকগুলো। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নামে একটি করে ব্যাংক রাখা হয়েছে।
অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক শরিফুল ইসলাম বললেন, ‘মাসে ১০ টাকা করে এখানে জমা দেন অভিভাবকেরা। এটাই স্কুলের ফি। অভিভাবক যেন মনে না করেন তাঁর সন্তান এখানে বিনা পয়সায় পড়ছে। তাঁর কোনো বক্তব্য থাকলে তা যেন জোরগলায় বলতে পারেন, তা-ই এই ১০ টাকা নেওয়া হয়। অনেকটা তাঁর অংশগ্রহণ। যদিও এই অর্থ একটা সময় শিক্ষার্থীকে দিয়ে দেওয়া হবে।’
রাজধানীর পূর্ব ভাটারায় অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের বিদ্যালয়। শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ৬৪টি মেয়ে পড়াশোনা করছে। শিক্ষক আছেন ছয়জন। আছে ৩ হাজার শিশুতোষ বইয়ের একটি গ্রন্থাগার। শিশুরা যেন খেলাধুলা করতে পারে, তার জন্য পরিসর বাড়ানোর কাজও চলছে। অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের শিক্ষা কর্মসূচি কর্মকর্তা মালিহা আহসান বললেন, ‘শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে আমরা চাই গুণগত মান রক্ষা করতে। সবাই যেন সেরা শিক্ষা এখান থেকে পায়। স্কুল যেন তার স্বপ্নের জায়গা হয়। আগ্রহ নিয়ে যেন প্রতিদিন আসে।’
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রয়োজনীয় সবকিছু স্কুল থেকে সরবরাহ করা হয়। শিক্ষা কার্যক্রম এখন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত হলেও প্রতিবছরই একটি করে শ্রেণি যোগ করা হয়। এই শিক্ষার্থীদের নিয়েই ধীরে ধীরে স্কুলটি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করবে।

অগ্নিকাণ্ডে ঢাকার কড়াইল বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা করে অবিন্তা ফাউন্ডেশন
অগ্নিকাণ্ডে ঢাকার কড়াইল বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা করে অবিন্তা ফাউন্ডেশন

অসহায়ের পাশে, মেধাবীর পাশে

যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি ইউনিভার্সিটির অক্সফোর্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন অবিন্তা কবির। সেখানে তাঁর নামেই বৃত্তি চালু করা হয়েছে। এই বৃত্তিতে বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীরাই অগ্রাধিকার পাবেন। যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে তখন সুযোগ দেওয়া হবে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের শিক্ষার্থীকে। এই বৃত্তির আওতায় অক্সফোর্ড কলেজের টিউশন ফি, বাসস্থানসহ আনুষঙ্গিক খরচ বহন করবে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। ২০১৭ সালে ভারতের হায়দরাবাদের মেধাবী ছাত্র মোহাম্মদ সায়েদ এই বৃত্তি পেয়েছেন।

অবিন্তা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বৃদ্ধাশ্রমের কাজটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। রাজধানীতেই জায়গার ব্যবস্থা হয়েছে। এই বৃদ্ধাশ্রমে এতিম শিশুদের থাকার ব্যবস্থাও করা হবে। কারণ, এটা ছিল অবিন্তার স্বপ্ন। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে সিরাজগঞ্জে। তীব্র শীতে শীতবস্ত্র পৌঁছে দেওয়া হয়েছে নাটোরে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ১২ জন গৃহহীন মানুষকে। খুদে আঁকিয়েদের আঁকা ছবি নিয়ে ‘দ্য লিটল আর্টিস্ট’ শিরোনামে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল অবিন্তা ফাউন্ডেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সাইবার সেন্টার চালু করা হয়েছে। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনকে কিনে দেওয়া হয়েছে ‘প্রেশার গার্মেন্টস’। এমন আরও অনেক কাজ করেছে অবিন্তা ফাউন্ডেশন।

ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অসহায় মানুষদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে
ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অসহায় মানুষদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে


অবিন্তার ইশতেহার

অক্সফোর্ড কলেজের ফ্রেশমেন (প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী) সেমিনারের প্রবন্ধটি যেন অবিন্তা কবিরের স্বপ্নের ইশতেহার। তিনি লিখে রেখে গেছেন তাঁর জীবনের ব্রত, কী করতে ভালোবাসেন—এমন নানা কথা। এতে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর ভাবনা আর বাংলাদেশি হিসেবে গর্বের কথামালা। তিনি লিখেছেন, ‘চারপাশের ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য।’

সে লেখারই এক অংশে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাদের সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখাতে চাই।’ অবিন্তার স্বপ্নের বাস্তবায়নেই কাজ করছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। তাই অবিন্তা কবির জীবন্ত ফাউন্ডেশনের প্রতিটি উদ্যোগে। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনের কাজগুলো।