মরিলে কান্দিস না আমার দায়...

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২)
হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮-১৯ জুলাই, ২০১২)

মায়ের ক্যানসার ধরা পড়েছে। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। মা বললেন, আমেরিকায় সব রোগের চিকিৎসা আছে। তোমাদের ঘাবড়ানোর কারণ নেই। নিউ জার্সির যে এলাকায় থাকি, সেখানে নামী হাসপাতাল সেন্ট পিটার্স। বেসরকারি হাসপাতাল। চিকিৎসা শুরু হলো। সুযোগ পেলেই চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করি, কী অবস্থা? এ দেশে চিকিৎসকেরা মিথ্যা ভরসা দেন না। অবস্থা যা, রোগীর সামনেই তা অকপটে বুঝিয়ে বলে দেওয়া তাঁদের কাজ।

ক্যানসার চিকিৎসায় অনেক পরিবর্তন আসছে। নিত্যদিন নতুন গবেষণা হচ্ছে। চিকিৎসক আমাদের বুঝিয়ে বলেন, স্টেজ থ্রিতে পৌঁছে যাওয়া ক্যানসার; এ ধরনের রোগীর ভালো হওয়ার হার ২৫ শতাংশ। আমাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়। বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। আমরা ভাই-বোনেরা এ নিয়ে কথা বলি না।

নিয়মিত কেমো থেরাপি ও রেডিয়েশন চলছে। বিষয়টি যে শরীরের জন্য কতটা যন্ত্রণার, মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আমরা টের পাই। এর মধ্যে মা জিজ্ঞেস করেন, স্লোন ক্যাটারিং সেন্টার নামের হাসপাতালটি কোথায়।
কেন?
তিনিই জানালেন, দেশের টিভি থেকে খবর পেয়েছেন, লেখক হুমায়ূন আহমেদের ক্যানসার ধরা পড়েছে। তিনি নিউইয়র্কের স্লোন ক্যাটারিং সেন্টারে চিকিৎসার জন্য আসছেন। বাংলাদেশের টিভি আর পত্রিকায় বিস্তর লেখা হচ্ছে। ক্যানসার গবেষণায় হাসপাতালটি বিশ্বের সেরা।

হুমায়ূন আহমেদের ক্যানসার ধরা পড়ার খবরটি ক্যানসার আক্রান্ত আমার মায়ের কাছ থেকে পাই। একদিকে মায়ের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত, আরেক দিকে হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমাকে রিপোর্ট পাঠাতে হয়। এখানে কারও শারীরিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকেরা রোগীর মনোনীত পরিবারের লোকজন ছাড়া অন্য কারও সাথে কথা বলেন না। সারা দেশ থেকে তখন কিংবদন্তি এ লেখকের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন আসতে থাকে। আমি নিয়মিত প্রথম আলোতে সংবাদ পাঠাই। চূড়ান্ত সতর্কতা নিয়ে এ সংবাদ পরিবেশন করা হতো। লেখক নিজে পত্রিকা পড়েন। নিউইয়র্ক থেকে প্রথম আলোর জন্য লিখছিলেনও তিনি। লেখকের পরিবার, অনুরাগীদের দিকে খেয়াল রেখে সংবাদের প্রতিটা শব্দ যাচাই করতে হতো। শারীরিক অবস্থা কেমন বা ক্যানসার কোন স্টেজের, এ পর্যায়ে থাকা ক্যানসার রোগীর বেঁচে থাকার হার, এসব নিয়ে চিকিৎসকদের কোনো মন্তব্য দেওয়া থেকে আমরা বিরত থাকি।

চিকিৎসারত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণ দিতে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর সময়সূচি ধরে আমরা সংবাদকর্মীরা ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিনগুলো কাটাচ্ছি। হঠাৎ দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরসূচির বাইরে কোথাও গেছেন। আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। জানা গেল, শক্ত সময়সূচিতে বাঁধা প্রধানমন্ত্রী নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য সাহায্যের কথা বলে এসেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে একজন লেখকের খবর নিচ্ছেন—এ সংবাদ আমি আমার এ দেশি বন্ধুদের বলি। তারা অবাক হয়।

এর মধ্যে আমরা সংবাদ পরিবেশন করি, নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা চলছে স্লোন ক্যাটারিং সেন্টারে। তাঁর অবস্থা ভালোর দিকে। কিছুদিনের মধ্যে তিনি দেশে যাচ্ছেন। দ্রুত ফিরে আসতে হবে ধারাবাহিক আরও কিছুদিন চিকিৎসা নেওয়ার জন্য।

সর্বত্র আশাবাদ জেগে উঠেছে। আমাদের মা তখন কেমো থেরাপির চাপে নাকাল অবস্থায়। জানালেন, তিনি স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান। এর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ দেশে গিয়েছেন। স্লোন ক্যাটারিং হাসপাতালে রোগী দেখানোর জন্য চিকিৎসকের সময় পাওয়া বেশ দুরূহ। আমরা ব্যবস্থা করি। মাকে নিয়ে যাই। মাকে দেখেন ক্যানসার চিকিৎসার ওপর বেশ কটি বইয়ের লেখক এক ডাক্তার। দেখে বলেন, তাঁর যে চিকিৎসা চলছে, তা ছাড়া এ রোগের এখন পর্যন্ত আর কোনো চিকিৎসা নেই। ডাক্তার আশা করলেন, কোনো একদিন চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্যানসারকে জয় করার জন্য নিশ্চিত কোনো ওষুধ আবিষ্কার করবে। তাঁর এ আশার কথা শুনে আমার মা হতাশ হলেন। ফিরে গেলেন সেন্ট পিটার্স হাসপাতালে তাঁর আগের চিকিৎসায়। প্রতিদিন খোঁজ নিতে থাকলেন, হুমায়ূন আহমেদের খবর কী?

আমি বলি, ভালো।

মা তাঁর সাংবাদিক ছেলের কাছে জানতে চান, তুমি কি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছ? হুমায়ূন আহমেদ কি বাঁচবেন না? আমি কি বাঁচব না?

উত্তর খুঁজে পাই না। শূন্যে তাকিয়ে থাকি। মায়ের অবস্থা খারাপ হতে থাকে।

ক্যানসার চিকিৎসার জন্য হুমায়ূন আহমেদ দেশ থেকে আবার ফিরে আসেন। এবার যাচ্ছেন বেলভিউ হাসপাতালে। রাজ্য সরকারের এ হাসপাতাল অনেক বড়। চিকিৎসার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। অনেক বিশেষজ্ঞ সেখানে। আমরা আবার দেশে রিপোর্ট পাঠাই। চিকিৎসা চলছে। শরীরের অবস্থা অনেকটাই ভালোর দিকে।

জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হুমায়ূন আহমেদের শরীর কিছুটা খারাপ বলে সংবাদ দিতে হয় আমাদের। লোকজন বিশ্বাস করতে চায় না। সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি ভালো হয়ে যাবেন, এমন প্রত্যাশা সর্বত্র।

২০১২ সালের ১৮ জুলাই। বেলভিউ হাসপাতালে কার্যত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর শরীরের এ নাজুক অবস্থা নিয়ে মা জানতে চান, ঢাকার সংবাদ ডেস্ক থেকে জানতে চাওয়া হয়।

হুমায়ূন আহমেদ মারা যাচ্ছেন, কথাটি লেখার ক্ষমতা আমার ছিল না। এ কথা লিখতে পারছিলাম না। মা জানতে চান, আমি আমতা আমতা করি।

১৯ জুলাই দুপুরে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির পর চূড়ান্ত দুঃসংবাদটি আসে। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি এম এ মোমেন দুঃসংবাদটি নিশ্চিত করলে ছুটে যাই বেলভিউ হাসপাতালের দিকে। যাওয়ার আগে বাংলা টেলিভিশন যেন মাকে দেখতে দেওয়া না হয়—এ কথা বলে যাই আমি।

সংবাদকর্মীদের ভিড়। বেলভিউ হাসপাতাল থেকে হুমায়ূন আহমেদের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বেরিয়ে এসেছেন। ভাইয়ের মৃত্যুতে বিমর্ষ জাফর ইকবাল সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে আনন্দ দিতে এসেছিলেন। আনন্দ দিয়ে চলে গেছেন।

নন্দিত এ লেখকের মৃত্যুসংবাদ লিখতে হলো শেষ পর্যন্ত। ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়…’ শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এ মৃত্যুসংবাদ অনেকটাই ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছিল।

২০ জুলাই ভোরে জ্যামাইকার লিবার্টি অ্যাভিনিউতে ফিউনারেল সেন্টারে যখন উপস্থিত হই, তখন সেখানে কেউ নেই। সূর্য ওঠার কিছু পরে এলেন একজন। আমরা পরিচিত হই। তাঁর নাম আবেদীন, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর আত্মীয়। আবেদীন সাহেব জানালেন, তিনিই নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের অভিভাবক। তাঁর তত্ত্বাবধানেই মরদেহ ফিউনারেল হোমে রাখা হয়েছে। তসবিহ জপ করছেন আবেদীন। এর মধ্যে এলেন আরেকজন। নিজের পরিচয় দিলেন ‘পাশা মামা’ বলে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর অনেক লেখায় এই পাশা মামার কথা লিখেছেন। তিনিও ফিউনারেল হোমে বসে তসবিহ জপ করছেন। এর মধ্যেই ফিউনারেল হোমের পরিচালক এসে উপস্থিত। জানালেন, এখনই গোসল দিতে হবে। এরপর দর্শনার্থীদের দেখানোর জন্য মৃতদেহ রাখা হবে।

ফিউনারেল হোমের বেসমেন্টে শীতল কক্ষ। টেবিলে উন্মুক্ত মরদেহ। শরীর কাঁপতে লাগল। আমি পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়ি। আবেদীন সাহেব আমার অবস্থা দেখে পিঠে হাত বুলাতে থাকলেন। পেশাগত কাজে গিয়ে এমন বিব্রত অবস্থায় আর পড়িনি কখনো। ফিউনারেল ডিরেক্টর জানালেন, চারজন লোক লাগবে মৃতদেহ গোসল করাতে। আমিসহ চারজন উপস্থিত এ সাতসকালে। আমার পুরো শরীর কাঁপছে। আবেদীন সাহেব আমাকে সাহস জোগাতে থাকলেন। বলে দিলেন, কী করতে হবে।

বাংলা সাহিত্যের নন্দিত লেখকের বুকে আমি জলের ঝরনাধারা ধরে রাখি। হাতের আঙুল ছুঁই। যে আঙুলে কলম ধরেছেন, যে আঙুল জ্বলে বেরিয়েছে লক্ষ লক্ষ শব্দের জাদু। বাংলা সাহিত্যকে, বাঙালি পাঠককে জাদু দেখিয়েছেন যে আঙুল দিয়ে, মুকুটহীন সম্রাটের সে আঙুল ছুঁয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দেখি চোখ থেকে অশ্রুফোঁটা পড়ছে ফিউনারেল হোমের জলের ঝরনাধারার সাথে। বুক কাঁপছিল, হাঁটু কাঁপছিল।

হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে চলে যাওয়ার পর ঘরে ফিরেছি। মা জেনে গেছেন, হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। ক্যানসারের কাছে পরাজিত হয়েছেন লক্ষ কোটি মানুষের মন জয় করা হুমায়ূন আহমেদ। মায়ের চোখে দেখি অঝোরধারায় জল নামছে।

এর দুই সপ্তাহ পরে আমার মা-ও ক্যানসারের কাছে হার মানলেন।

ঘরে রাখা হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে বা অন্য কোনো বই চোখে পড়লে, মায়ের ব্যবহার করা জিনিসপত্র দেখলেই তন্ত্রীতে বেজে ওঠে, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদুধন...।’

লেখক: আবাসিক সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা।