একাই জ্বলে ওয়াসিউলের 'ম্যাজিক লাইট'

ও লেভেল ও এ লেভেল শেষ করে পুরান ঢাকার ছেলে ওয়াসিউল হক ভর্তি হন মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় ছিল টেলিযোগাযোগ প্রকৌশল। পড়াশোনার সময়ই সিদ্ধান্ত নেন, দেশে ফিরে নিজের মেধাকে কাজে লাগাবেন। তরুণ এই উদ্যোক্তা এখন ওমটেক ইলেক্ট্রনিকসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নিজেই তৈরি ও বাজারজাত করছেন বিভিন্ন ধরনের স্মার্ট এলইডি চার্জার লাইট। যা ম্যাজিকের মতোই জ্বলে।

মঙ্গলবার ওয়াসিউলের সঙ্গে কথা হলো। তাঁর জন্ম ১৯৮৯ সালে, পুরান ঢাকার লালবাগে। ২০১৪ সালে মালয়শিয়া থেকে ফিরে চাকরির চেষ্টা করেছেন তিনি। একসময় চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে নিজেই কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন। দেশে তখন বিদ্যুতের ঘাটতি, লোডশেডিং নিত্যসঙ্গী। তখন চার্জার লাইট নিয়ে কাজ করতে থাকেন এই প্রকৌশলী। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করলেন ‘ম্যাজিক লাইট’। লাইটের বিশেষত্ব, এটিকে এমন এক মোডে রাখা যায়—যে মোডে অন্ধকার নেমে এলেই লাইটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠবে।

নিজের তৈরি পণ্য হাতে তরুণ উদ্যোক্তা ওয়াসিউল হক। বকশিবাজার, ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
নিজের তৈরি পণ্য হাতে তরুণ উদ্যোক্তা ওয়াসিউল হক। বকশিবাজার, ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

ওয়াসিউল বললেন, ‘প্রোটোটাইপ লাইটটি বানানোর পর আশপাশের সবাই আমাকে উৎসাহ দিল। এটিকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে আরো গবেষণা শুরু করলাম।’ তিনি লাইটটি সাশ্রয়ী করার চেষ্টা শুরু করলেন। ম্যাজিক লাইটের ডিজাইনটি নিজস্ব হওয়ায় এর মোল্ড তৈরির করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় তাঁকে। কাগুজে নকশা নয়—সবাই চাইছিল নমুনা। এরপরও ২০১৫ সালে বাজারে এলো ওয়াসিউলের ‘ম্যাজিক লাইট’।

ওয়াসিউল জানালেন, লাইটটি বাজারে আসার পর নতুন বিপত্তি দেখা দেয়। বললেন, ‘গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা লাইট নেন, বিক্রি করেন—কিন্তু টাকা দেন না বললেই চলে।’ আর তখন যেহেতু কম পণ্য তৈরি করতে হতো, তাই যন্ত্রাংশও বেশি দামে কিনতে হতো তাঁকে। ব্যবসা এগোতেই চায় না। তখন ব্যবসা ছোট করে করে আনেন ওয়াসিউল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আরও নতুন করে ভাবতে হবে এবং নিজেকেই সরাসরি পণ্য বাজারজাত করতে হবে। আবার তাঁর পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু হয়।

২০১৮ সালের আগস্টের দিকে ওয়াসিউল ঘুরে দাঁড়ান। বাংলাদেশ ইয়ুথ এন্টারপ্রাইজ অ্যাডভাইস অ্যান্ড হেল্প সেন্টার (বি’ইয়া) থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি ঠিক করলেন পণ্যের মানের সঙ্গে কোনো আপস করবেন না। এলইডি লাইটকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ভালো যন্ত্রাংশ ব্যবহার শুরু করলেন। আরও ভালো করার সিদ্ধান্ত ওয়াসিউলের ব্যবসার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আগে যেখানে তিন বছরে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ লাইট বিক্রি হতো, এখন সেখান একই পরিমাণ বিক্রি হয় মাত্র দেড় বছরে।

ওয়াসিউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছে, খারাপও লাগতো। কিন্তু আমি জানতাম, ঘুরে দাঁড়াতে পারব। সত্যিই পেরেছি। অনেকে অন্য কোনো ব্যবসা করতে বলেছে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আমি যা ধরেছি আমি তার শেষ দেখতে চেয়েছি।’ দেড় লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসায় নেমেছিলেন তিনি। তা এখন মুনাফাসহ পাঁচ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

ওয়াসিউল নিজেই তৈরি করছেন স্মার্ট এলইডি লাইটের সার্কিট। বকশিবাজার, ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
ওয়াসিউল নিজেই তৈরি করছেন স্মার্ট এলইডি লাইটের সার্কিট। বকশিবাজার, ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

ওয়াসিউল বললেন, ‘আগের চেয়ে বিক্রি বেড়েছে। পণ্যের মান ভালো রিটার্ন গ্রাহকও পাচ্ছি। ডিলারও বাড়ছে।’ ঢাকায় ওমটেক ইলেক্ট্রনিক্সের ৪জন এবং চট্টগ্রামে একজন ডিলার রয়েছে। আর অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশেই ওমটেকের লাইট পাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমানে ওমটেক দুই ধরণের স্মার্ট এলইডি লাইট উৎপাদন করছে। একটি ‘ম্যাজিক লাইট’ আর অন্যটি ‘ম্যাজিক লাইট জাম্বো’। জাম্বো শুধু অন্ধকার হলে জ্বলেই উঠবে না—মানুষের অস্বাভাবিক চলফেরা বুঝতে পারবে এবং অ্যালার্ম দেবে। জাম্বোর আরেকটি বিশেষত্ব, এটি সোলার প্যানেল দিয়েও চার্জ দেওয়া যায়। আগামী বছরের শুরুতে বাজারে আসবে ওমটেকের স্মার্ট সুইচ।

উদ্যোক্তাদের প্রচারের জন্য একটি সাশ্রয়ী জায়গা চান এই তরুণ প্রকৌশলী। তিনি জানালেন, প্রচার করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। সাশ্রয়ী মেলাও করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বললেন, ‘সরকার সুদ ছাড়া ঋণ দিতে পারে। আর যন্ত্রাংশগুলো যদি দেশে তৈরি করা যায়, তাহলেও দাম কমে।’