অপুষ্টিতে ভুগছে কিশোর-কিশোরীরা

বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ অপুষ্টির শিকার । ছবি: মুসলিমা জাহান
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ অপুষ্টির শিকার । ছবি: মুসলিমা জাহান

কামরাঙ্গীর চরের বড়গ্রাম। ২১ মার্চ দুপুরে সালমাদের বাড়িতে যাই। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল কিশোরী সালমা উঠোনে বসে ভাত খাচ্ছে। শুধু মরিচভর্তা আর ডাল দিয়ে। জিজ্ঞেস করতেই জানাল, প্রায় প্রতিদিনই ওর খাবারের তালিকায় এ রকম খাবারই বেশি থাকে। তবে, তরকারি বা মাছ-মাংস খেতে না পেলেও, ভাত সে পেট ভরেই খায়।
সায়েম রাজধানীর হাজারীবাগের সালেহা উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ে। খাবারের তালিকায় কী কী থাকে জানতে চাইলে কথা বলতে এগিয়ে এলেন ওর মা মালিহা বেগম। তিনি জানান, সায়েমকে তিনি প্রতিদিন নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার দিতে চেষ্টা করেন। আর সে জন্য তিনি প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় মাংস রাখেন। আবার সায়েম মাংস না পেলে খেতেও চায় না। অন্য শাকসবজি সে খেতে পছন্দ করে না।
তানজিনা আহমেদের বয়স ১৬ বছর। উচ্চতা পাঁচ ফুট। কিন্তু উচ্চতা ও বয়সের তুলনায় ওজন অনেক বেশি। ৭০ কেজি। ওর মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল তাদের আজিমপুরের বাড়িতে। তিনি বলেন, আমার মেয়ের অন্য কিশোরীদের মতো পুষ্টির অভাব নেই। তার বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টি রয়েছে। কারণ, সে সব সময়ই খেতে খুব পছন্দ করে। আর আমিও বারণ করি না।
সালমা, সায়েম বা তানজিনা—তিনজনের পরিবারের সামর্থ্য আলাদা। কিন্তু দুটি বিষয়ে তিনজনের রয়েছে মিল। তিনজনই ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী। আর তিনজনই সুষম খাদ্য গ্রহণ করে না। তাই ওরা তিনজনই অপুষ্টির শিকার। মূলত সুষম খাদ্য গ্রহণ না করার ফলে তিন ধরনের পুষ্টিস্বল্পতা দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে প্রোটিনের ঘাটতি, ক্যালরি কম গ্রহণ এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন ভিটামিন এ, আয়োডিন, আয়রন ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ না করা।
সালমা, সায়েম ও তানজিনার মতো আমাদের দেশে বহু কিশোর-কিশোরী অপুষ্টির শিকার। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ অ্যান্ড সার্ভের (বিডিএইচএস) সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের ২৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। এই সমীক্ষায় দেখা যায়, কিশোরীর উচ্চতা ন্যূনতম ১৪৫ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত। কিন্তু এই হার ১৩ শতাংশের কম। আর কিশোরদের উচ্চতা হওয়া উচিত ১৫০-১৫৫ সেন্টিমিটার। সেটাও অনেক কম। আবার বডি মাস ইনডেক্স (বিএমডি) অনুযায়ী ওজন ১৮ শতাংশ হতে হবে। দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ কিশোরীর এই ১৮ শতাংশের নিচে ওজন।
জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১১ থেবে ১৬ বছর বয়সী ৪৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে।
মূলত কিশোর বয়সে শারীরিক পরিবর্তনগুলো ঘটে। তাই এই সময়ে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আর এর পেছনে মূলত কাজ করে হরমোন। সুস্থ শরীরে হরমোনের নিঃসরণ স্বাভাবিক থাকে। যখন কোনো কিশোর বা কিশোরী অপুষ্টিতে ভোগে, স্বাভাবিকভাবেই তার হরমোন নিঃসরণ গ্রন্থিগুলো কম কাজ করে। তাই শরীরের বিকাশ ব্যাহত হয়। আর কিশোরী যদি অপুষ্টিতে ভোগে, তাতে সমস্যা আরও বেশি। কারণ, তাকে পরবর্তী সময়ে সন্তান ধারণ করতে হয়। আর একজন অপুষ্ট মা অপুষ্ট শিশুরই জন্ম দেয়।
কিশোর বয়সের অপুষ্টি নিয়ে কথা হলো প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ লেনিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বয়স অনুযায়ী শরীরের যে বৃদ্ধি বা ওজন থাকার কথা, সেটা অর্জন না করাটাই অপুষ্টি। আর কিশোর বয়সে যেহেতু শরীরের বহিরাঙ্গ ও অভ্যন্তরীণ প্রজনন অঙ্গগুলোর বৃদ্ধি, বিকাশ বেশি ঘটে, তাই এই বয়সী সবাইকে পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে কিশোরীদের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।’
বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ কিশোরী রক্তস্বল্পতায় ভোগে। ২০১১-১২ সালে জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জাতীয় অনুপুষ্টি সমীক্ষা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, ৯ থেকে ১৪ বছরের কিশোরী মেয়েরা লৌহজাতীয় খাবার প্রয়োজনের তুলনায় ২০ শতাংশ কম খায়। আর মাছ-মাংস খায় শতকরা মাত্র ১০ জন।
এই সমস্যা কিশোর-কিশোরী উভয়েরই। তবে অপুষ্ট কিশোরীর সমস্যা অন্য রকম। অপুষ্ট কিশোরী সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্তস্বল্পতায় ভোগে। আর এ ক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা কম, দারিদ্র্য অঞ্চলে বসবাসকারী কিশোরী ও বস্তির কিশোরীরা বেশি রক্তস্বল্পতায় ভোগে।
একজন অপুষ্ট কিশোরী কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে, এই নিয়ে কথা বলেছেন কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক বিলকিস বেগম চৌধুরী। তিনি স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘একজন অপুষ্ট কিশোরীর মাসিক ঋতুস্রাবের শুরুটা দেরিতে হয়। আবার নিয়মিত হয় না। সেই সঙ্গে সাদা স্রাব বের হতে পারে। আর এই রোগের প্রধান কারণ পুষ্টিহীনতা।
বিলকিস বেগম আরও বলেন, ‘এই কিশোরীরা গর্ভকালীন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। তারা রক্তস্বল্পতায় ভোগে। খিঁচুন-জাতীয় রোগ হয়। শরীরে পানি আসে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। এই বয়সে এমনিতে প্রজননতন্ত্র অপরিপক্ব থাকে। সেই সঙ্গে যদি অপুষ্টিও যোগ হয় তবে সেটা হয় আরও ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত দেখা যায়, সন্তান প্রসবের সময় এদের বিভিন্ন সমস্যা হয়। যেমন, বিলম্বিত প্রসব, বাধাগ্রস্ত প্রসব, এমনকি তারা প্রসব-পরবর্তী জটিলতায়ও ভোগে। এর মধ্যে রয়েছে ফিস্টুলা ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগ।’
কিশোরী মায়েদের মাতৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে, তার গর্ভধারণ হলে শিশুটির অপুষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে । এ ক্ষেত্রে কম ওজনের বাচ্চা জন্মাবে। জন্মের সময় শিশুর ওজন আড়াই কেজির বেশি হওয়া উচিত। বিডিএইচএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০১১ সালে বাংলাদেশে কম ওজনের শিশু ছিল ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ এই শিশুরা আড়াই কেজির কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল।
সার্বিকভাবে দেশের কিশোর-কিশোরীদের অপুষ্টি দূর করতে কিছু উদ্যোগ এখন থেকেই গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন আইসিডিডিআরবির পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা কেন্দ্রের পরিচালক তাহমিদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আসলে পুরো দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো ঠিক করা উচিত। আলাদা করে কিশোর-কিশোরীদের জন্য কোনো অবকাঠামো তৈরির দরকার নেই। আর শিশুদের মায়ের বুকের দুধ, উপযুক্ত সম্পূরক খাবার, ছয় মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন এ খাওয়ানো—এই কার্যক্রম বাড়াতে হবে। শিশু বয়স থেকেই এটা করতে হবে। তাহলে শিশুরা অপুষ্টির হাত থেকে বাঁচবে। কিশোর বয়সেও অপুষ্টির শিকার হবে কম।’
তাহমিদ আহমেদ আরও বলেন, ‘অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা বাড়াতে হবে। আমরা পর্যাপ্ত ভাত খেতে পাচ্ছি। কিন্তু ধানের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাল ও শাকসবজির ফলন বাড়াতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি এনজিওগুলোকেও কাজ করতে হবে।
আবার কিশোরী মেয়েদের স্বাস্থ্য কীভাবে ভালো থাকবে, সেই জ্ঞান সবাইকে দিতে হবে। কিশোরীদেরও সেই জ্ঞান দিতে হবে। এ জন্য পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ধরনের কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অচিরেই দেশে অপুষ্ট কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা কমে আসবে।’