সেই প্রেম সেই স্মৃতি

এখানেই ছিল একটি আমগাছ, যার নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন, লিখতেন কবিতা । ছবি: এম সাদেক
এখানেই ছিল একটি আমগাছ, যার নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন, লিখতেন কবিতা । ছবি: এম সাদেক

বাড়িটির স্থাপত্যশৈলী, দরজা-জানালা বা রেলিংয়ের নজরকাড়া কারুকাজ আজও সমীহ জাগায়। সময়ের আঁচড়ে মলিন হয়েছে এর সৌন্দর্য, খসে পড়েছে পলেস্তারা। কিন্তু এককালে যাঁরা ছিলেন এ বাড়ির বাসিন্দা, তাঁদের বিত্তবৈভব আর সমৃদ্ধির সাক্ষী হয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে দৌলতপুরের খাঁ মঞ্জিল। তবে কী আশ্চর্য, বিত্তবান বাসিন্দাদের কারণে নয়, বাড়িটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে বহুকাল আগে এ বাড়িতে আসা এক অতিথির কারণে। তিনি এসেছিলেন এখানে, জয় করেছিলেন এক নারীর হূদয়—আবার ফিরেও গিয়েছিলেন। পেছনে পড়ে রইল এক অনন্ত হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস।

খাঁ বাড়িতে এখনো আছে নজরুলের ব্যবহূত এই পালঙ্ক
খাঁ বাড়িতে এখনো আছে নজরুলের ব্যবহূত এই পালঙ্ক

কোথায় দৌলতপুর
কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। মুরাদনগরের এই গ্রামটির নাম আজ হয়তো অনেকের জানা। কিন্তু ৯৩ বছর আগে এই অজপাড়াগাঁর কথা কেই-বা শুনেছে? বাংলার আরও হাজারটি গ্রামের মতো এখানেও বিস্তৃত সবুজ ধানের খেতে সময় কেটেছে কৃষকের। খালে-নদীতে গান গেয়ে দাঁড় টেনেছে মাঝি, আর রান্নাঘর থেকে পুকুরঘাট পর্যন্ত ছিল বউঝিদের ব্যস্ততা ও কলরবের সীমানা। সন্ধ্যার পর ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলে এখানে থেমে গেছে জীবনের সব লেনদেন।
কিন্তু আজ এই দৌলতপুর স্থান নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে (১৩২৭ চৈত্র) এই গ্রামে এসেছিলেন বাঙালির প্রিয় কবি নজরুল। শুধু আসা তো নয়, এই গ্রামটিতে মাত্র আড়াই মাস অবস্থানের স্মৃতি তিনি নিজে যেমন ভুলতে পারেননি সারাটি জীবন, তেমনি নজরুলের ভক্তদের কৌতূহল ও বিস্ময় যেন এখনো জেগে আছে এই গ্রাম ঘিরে, এই বাড়ি নিয়ে।

কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম

যেভাবে এসেছিলেন
কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে যখন থাকতে শুরু করেন নজরুল, সে সময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও কিছুটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা ও প্রকাশক আলী আকবর খানের। আলী আকবর তাঁর গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব করেন কবিকে। নজরুল তখন সবে নবযুগ পত্রিকার কাজে ইস্তফা দিয়েছেন। হাতে অখণ্ড অবসর। তা ছাড়া ভবঘুরে স্বভাবটা তো তাঁর ছিলই। তিনি রাজি হয়েছিলেন। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে কুমিল্লা এসেছিলেন তাঁরা। কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন আলী আকবরের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। এই বাড়িতেই পরবর্তীকালে নজরুলের জীবনের অন্য এক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। সে প্রসঙ্গ আজ থাক।
বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের বাড়িতে দুদিন (মতান্তরে ৯-১০ দিন) কাটিয়ে আলী আকবরের সঙ্গে চলে যান দৌলতপুরে। পল্টনফেরত যুবক নজরুল তখন দেশজুড়ে মোটামুটি কবি খ্যাতি পেয়েছেন। আলী আকবরের নির্দেশে কবির আগমন উপলক্ষে তোরণ সাজানো হয়েছিল। ফুল ছিটিয়ে বরণ করা হয়েছিল তাঁকে।

সৈয়দা আসার খানম (নার্গিস ): অনেক দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর... সৌজন্যে: নজরুল ইনস্টিটিউট
সৈয়দা আসার খানম (নার্গিস ): অনেক দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর... সৌজন্যে: নজরুল ইনস্টিটিউট

যেন ঘরের মানুষ
যেখানেই যান, সেখানকার মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা নজরুলের সহজাত। খাঁ-বাড়িতে তাই নতুন অতিথিটি যেন হয়ে
উঠলেন ঘরের মানুষ। পুকুরের ধারে একটি বৈঠকখানায় থাকতে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। আলী আকবরের বিধবা বড় বোন এখতারুন্নেসা ছিলেন বাড়ির কর্ত্রী। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। নজরুল তাঁকে মা ডেকেছিলেন। এখতারুন্নেসাও পুত্রস্নেহে গ্রহণ করেছিলেন এই পাগল ছেলেকে। খাঁ-বাড়িতে নজরুলের দিনগুলো হয়ে উঠল উচ্ছল আনন্দময়। পুকুরে সাঁতার কেটে, বুকপানিতে ভেসে উদাত্ত কণ্ঠে গান করে, পুকুরপারের আমগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজিয়ে সময় কেটে যেত কবির। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হইহুল্লোড়ও করতেন। গ্রামের গায়ক জনার্দন দত্ত, সাদ আলী মাস্টার, জলধর মাস্টার ও জমির উদ্দিনের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল হূদ্যতা। তাঁরা আসতেন, পুকুরপাড়ে গাছের ছায়ায় জমে উঠত গানের আসরও। ব্যাপারটি হয়ে উঠেছিল এমন, এই অতিথি কদিনের জন্য এসেছেন, কবে যাবেন কেউই তা জানত না।
দুজনে দেখা হলো
আলী আকবর স্নেহ করতেন কবিকে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পরিবারেরই কোনো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হোক নজরুলের। নজরুলের অনেক জীবনীকার বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করেছেন অন্যভাবে। যদি নজরুলকে বাঁধতে পারেন আত্মীয়তার সূত্রে, তাহলে তাঁকে হাতের মুঠোয় রেখে তাঁর লেখা বই প্রকাশ করে ধনী হতে পারবেন—এই আকাঙ্ক্ষা ছিল আলী আকবরের। তবে এই ধারণাকেই শতভাগ সত্য মেনে নিতে হবে, এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না।
উদ্দেশ্যমূলক হোক বা স্নেহবশতই হোক, নিজের পরিবারের একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হোক এমন আগ্রহ যে আলী আকবরের ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাড়ির কয়েকটি মেয়েকে দেখিয়েও ছিলেন। কিন্তু কবির পছন্দ হয়নি।
এর মধ্যে আলী আকবরের বড় ভাই নেজামত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খানমের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলো তাঁর বড় বোন আসমাতুন্নেসার ছেলে মুন্সি আবদুল জব্বারের। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে খাঁ-বাড়িতে মানে মামাবাড়িতে এসেছিলেন আলী আকবরের ভাগনি, সৈয়দা খানম। বিয়ের আসরে গানও গেয়েছিলেন সৈয়দা। প্রথম দেখাতেই এই সুন্দরী ষোড়শীকে ভালো লেগে গিয়েছিল নজরুলের। সৈয়দারও ভালো লেগেছিল একমাথা ঝাঁকড়া চুল, লালের ছিটা লাগা আয়ত চোখ ও সুঠাম দেহের তরুণ নজরুলকে।

তোমার নাম নার্গিস
‘গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি।’ নজরুলের সুহূদ ও অভিভাবক কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতে, ‘এইভাবে হলো তাঁদের পরিচয়ের সূত্রপাত’। সেই পরিচয় প্রেমে গড়াল। সৈয়দা আসার খানমের ডাক নাম ছিল দুবি বা দুবরাজ। নজরুল তাঁর নাম পাল্টে রাখলেন ‘নার্গিস’। একদিন বলেছিলেন, ‘এমন ফুলের মতো যার সৌন্দর্য, তার এই নাম কে রেখেছে? আজ থেকে তোমার নাম নার্গিস।’ সেই থেকে নার্গিস নামটা স্থায়ী হয়ে গেল সৈয়দার জীবনে। আর প্রেম ও বিরহে এই নাম অমর হয়ে রইল নজরুলের গানে ও কবিতায়।

খাঁ-বাড়ির সামনে এই আমগাছতলায় নজরুল শিশুদের গান শেখাতেন
খাঁ-বাড়ির সামনে এই আমগাছতলায় নজরুল শিশুদের গান শেখাতেন

বিয়ে হলো, কিন্তু...
প্রেম গড়িয়েছিল পরিণয় পর্যন্ত। কিন্তু ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হলো না। বিয়ের ব্যাপারে নজরুলেরই তাড়া ছিল বেশি। তাঁর পীড়াপীড়িতেই ১৯২১ সালের ১৭ জুন শুক্রবার রাতে বিয়ের তারিখ ধার্য হয়। বিয়ে উপলক্ষে সাত দিন আগে থেকে খাঁ-বাড়িতে শুরু হয়েছিল উৎসব। বিয়েতে এসেছিলেন আলী আকবরের আত্মীয়স্বজন, স্থানীয় জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদারসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। আর এসেছিলেন কুমিল্লা থেকে আলী আকবরের বন্ধু বীরেন্দ্র, তাঁর মা গিরিবালাসহ পুরো পরিবার। 
বিয়ের দিনই কী এক কারণে নজরুলের সঙ্গে মতান্তর হয় আলী আকবরের। অনেকের ধারণা, বিয়ের দেনমোহর ২৫ হাজার টাকা ধার্য করায় বিরোধের সৃষ্টি, আবার অনেকের মতে, কাবিননামায় স্থায়ীভাবে কুমিল্লায় বসবাস করতে হবে, এমন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল বলেই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন নজরুল। এ বিষয়টা এখনো রহস্যাবৃত হয়েই আছে। তবে নজরুলের মন বিষিয়ে দেওয়ার জন্য পরবর্তীকালে মুজফ্ফর আহমদ ও কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারকে দায়ী করেছিলেন আলী আকবর। 
ক্ষুব্ধ নজরুল বিয়ের রাত শেষ হওয়ার আগেই বিদায় নিয়েছিলেন কুমিল্লা থেকে। ক্রন্দনরতা নববধূকে বলে এসেছিলেন, শ্রাবণ মাসে পরিবারের লোকজন নিয়ে এসে তুলে নিয়ে যাবেন তাঁকে। এরপর বারবার শ্রাবণ ফিরে এসেছে, কিন্তু নার্গিসের কাছে ‘সে’ ফিরে আসেনি। 
মাত্র দুই মাসের প্রেম ও এক দিনের পরিণয়ের স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছরের দুঃসহ অপেক্ষার রাত কেটেছে নার্গিসের। ১৭ বছর পর ১৯৩৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের সংবাদ শুনে নজরুল ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরানপ্রিয়’ গানটি লিখে পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল একটি চিরকুট, তাতে লেখা ছিল, ‘জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম, তাই মরণে পাব এই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব।’
স্মৃতিধন্য সেই বাড়িটি
নজরুল-নার্গিসের স্মৃতিময় সেই বাড়িটি সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। অনেকের মতে, নজরুল যখন এসেছিলেন, এই আলিশান দোতলা বাড়িটি তখন ছিল না। জানি না এই বাড়িটি তখন ছিল কি না, তবে পারিবারিক আভিজাত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা বাড়ি তো নিশ্চয় ছিল। আজও সেই পুকুর, যেখানে কবি সাঁতার কাটতেন, সেটি আছে। পুকুরপাড়ের আমগাছটি নেই, কিন্তু যেখানে গাছটি ছিল, যার ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাতেন, গাইতেন, কবিতা লিখতেন, সেই স্থানটি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে কংক্রিটের বেদিতে। যে ঘরটিতে নজরুল-নার্গিসের বাসর হয়েছে সেটিও এখনো আছে, আর আছে কাঠের ওপর কারুকাজ করা বাসরঘরের পালঙ্কটিও। ৩৫ বিঘা জমি পরিবেষ্টিত বাড়িটিতে এখন বাস করেন আলী আকবর খানের উত্তরসূরিরা। সালেহীন খান নামের এক যুবক জানালেন, ‘আমরা ঢাকায় থাকি, মাঝে মাঝে আসি।’ এ বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে এ কথা জানেন সালেহীন, ইতিহাসটা জানেন না।
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম বাড়ির চারপাশ। বর্তমান-বিস্মৃত হয়ে মাঝে মাঝে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম ৯৩ বছর আগেকার কোনো দিনে। যেন এখনই আমতলা থেকে ভেসে আসবে কবির বাঁশির সুর। যেন এখনই কোনো এক জানালায় দেখতে পাব লাজনম্র নার্গিসের মুখ। ফিরে আসার পথে কোকিলের ডাক শুনতে পেলাম। বহুকাল আগে হয়তো এ রকমই এক নিদাঘ দুপুরে কোকিলের ডাকে প্রিয়-বিরহে বেদনার্ত হয়ে উঠেছিলেন নার্গিস, তাঁর সেই বিখ্যাত বেদনার স্মৃতি ধরে আছে এই বাড়ি।