বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র রোবট

অধ্যাপক তাহের এ সাইফ
অধ্যাপক তাহের এ সাইফ

রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে কিংবা ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর কোষে নির্দিষ্ট স্থানে ওষুধ দিতে গেলে প্রয়োজন হয় অতি ক্ষুদ্র কোনো একটি যন্ত্রের। চিকিৎসকদের এমন একটি উপকরণের স্বপ্ন অনেক দিনের, যা শরীরের ভেতরে ঠিক যেখানে প্রয়োজন সেখানেই ওষুধ দিতে পারবে কিংবা নিজে থেকে রক্তনালির ভেতরের জমাট বাঁধা রক্তকে সরিয়ে দিতে পারবে।
চিকিৎসকদের সেই স্বপ্নের স্বচালিত উপকরণটি তৈরির পুরো গবেষণাটি হয়েছে বাংলাদেশি অধ্যাপক তাহের এ সাইফের নেতৃত্বে। গবেষক দলটি তৈরি করেছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র রোবট। সম্প্রতি প্রথমবারের মতো এমন সাফল্যের খবরটি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক জনপ্রিয় জার্নাল নেচার-এ প্রকাশিত হয়েছে। অতি ক্ষুদ্র এ বায়োরোবটটি মানুষের হৃৎস্পন্দনের মতোই বিভিন্ন বিষয় বুঝতে পারে। স্বশক্তিতে চালিত এ রোবট একটানা কয়েক বছর ধরে সাঁতারও কাটতে পারবে।
বিষয়টা অনেকটা ষাটের দশকের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্র ফ্যানটাসটিক ভয়েজ-এর মতো। সেখানে অবশ্য চিকিৎসকের শরীরকে ছোট করে রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সিনেমার মতো না হলেও এই অতি ক্ষুদ্র চিকিৎসক রোবটটির নাম দেওয়া হয়েছে রোবটিক বায়োলজিক্যাল সুইমার (বায়ো-বট সুইমার)। যেহেতু এটি জীবন্ত কোষের সঙ্গে কাজ করেন তাই এটি চালাতে আলাদা কোনো ব্যাটারির দরকার হয় না।
একদল বিজ্ঞানীসহ দীর্ঘদিনের গবেষণা শেষে তৈরি হয় এ রোবট। রোবট নিয়েই যে শুধু সাইফের কাজ তা কিন্তু নয়, তৈরি করেছেন মেশিনস অব মাইক্রো ইলেকট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস (এমইএমএস) নামের অতি ক্ষুদ্রকায় যন্ত্র। তাদের তৈরি রোবটের মতোই এগুলো এতই ক্ষুদ্র যে এর আকার মানুষের চুলের চেয়েও ছোট, দেখতে হলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়! বিশেষ করে বর্তমানে গাড়ি, ক্যামেরা, টেলিভিশন, কম্পিউটারে এ যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। গবেষণাগারে ১০০ ন্যানো মিটারের চেয়ে ছোট নানা ধরনের যন্ত্রও তৈরি হয়। এমন সব গবেষণায় দীর্ঘদিন ধরেই যুক্ত রয়েছেন ন্যানো প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তাহের এ সাইফ। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
এ ছাড়া তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমইএমএস পরীক্ষাগারেরও পরিচালক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন তিনি।
চিকিৎসা উপকরণ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র রোবট প্রসঙ্গে তাহের এ সাইফ টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানান, ‘আমাদের এ গবেষণার মূল বিষয় হচ্ছে জীবন্ত মেশিন তৈরি করা। অর্থাৎ প্রযুক্তি এবং জীবনের যৌথ সমন্বয়ে এমন যন্ত্র তৈরি করা, যা নিজে থেকেই নিজস্ব কোষের শক্তিতে চলতে পারবে।’
প্রযুক্তি দিয়ে যা তৈরি হয় সেটিকেই জীবনের সঙ্গে যুক্ত করার বিষয় নিয়েই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর এই গবেষণাগুলো হয় অতি ক্ষুদ্রকায় বস্তু, যেগুলোর আবার এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাহের সাইফ জেরক্স পুরস্কার, আমেরিকার জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের ক্যারিয়ার পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
তাহের এ সাইফের জন্ম ঢাকায়। বাবা সাইফুর রহমান সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কেটেছে ছোটবেলার সময়। সাইফ জানালেন, ‘বিভিন্ন ছোট শহরে সময় কাটানোর ফলে আমার সব সময়ের খেলনা ছিল পিং পং বল। এ ছাড়া আমি জুতার বাক্সকে গাড়ি বানিয়ে সে সময়ে খেলতাম। তবে আমার মা তাহেরা বেগম প্রচুর বিজ্ঞান, কবিতা, উপন্যাস, ইতিহাসবিষয়ক বই পড়তেন। মায়ের পড়ার সুবাদে আমিও এসব বই পড়তাম। আমার আজকের এ অবস্থানে আসার পেছনে আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা।’
উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা বোর্ডে চতুর্থ হয়ে বুয়েটে ভর্তি হন সাইফ। পুরকৌশল বিভাগেও প্রথম হন এবং বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সেই সময়কার শিক্ষক এবং বর্তমানে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন তাঁর গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক। প্রথম আলোকে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকেই সাইফ অনেক মেধাবী এবং কর্মোদ্যোমী। নিজের গবেষণার পাশাপাশি সে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে ভিডিও তৈরি করেছে, যা দেখে শিক্ষার্থীরা সহজে ন্যানো প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারবে।’
আমরা এখনো জীবন আর যন্ত্রের সমন্বয়ে আরও কিছু রোবট তৈরি করতে চাই, টেলিফোনে বললেন তাহের এ সাইফ। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, এমন একসময় হয়তো আসবে যখন কোনো রোগীর একটি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন ক্যানসার রোগীদের নির্দিষ্ট টিউমার অংশ) ওষুধ দিতে হলে সেটি রোবট দিয়ে করা সম্ভব হবে। এর ফলে ওষুধ নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়বে না।
শিক্ষক স্ত্রী শাহনীলা চৌধুরী এবং দুই সন্তান ফারযাদ সাইফ এবং ফাইজা সাইফ নিয়ে সংসার তাহের এ সাইফের। বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের জন্য তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, এমন একটি গবেষণার বিষয় খুঁজে নেওয়া উচিত, যা সত্যিকার অর্থেই কাজের এবং যা নিজেই বিশ্বাস করেন। তৈরি করতে হবে নতুন প্রশ্নও। কারণ এমন একটি প্রশ্ন তার উত্তর নিজেকেই বের করতে হয়।
আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: [email protected]