এক বিস্ময়কর নিঃসঙ্গ বিজ্ঞানী

দুনিয়া-কাঁপানো বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মুখোমুখি হয়েছিল তিনি শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক স্মরণীয় যাত্রায়। তাঁর পাশে কাটিয়েছিলেনও বেশ কিছুটা সময়। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে সেই সাক্ষাতের বিস্তারিত জানাচ্ছেন নাসির আলী মামুন

স্টিফেন হকিং, ২০০৯। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
স্টিফেন হকিং, ২০০৯। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

বিপুল এই মহাবিশ্বকে অনাদি আর অনন্ত বলেই আমরা জানতাম। বিজ্ঞানীরা বললেন, এরও নাকি জন্ম আছে, আছে মৃত্যু। বিস্ময়কর এক বিজ্ঞানী এক পা এগিয়ে এসে মহাবিশ্বের জন্মক্ষণও বলে দিলেন। বললেন, এর নাকি জন্ম হয়েছে ঠিক ১৫ বিলিয়ন বছর আগে। আবার সময়েরও নাকি জন্ম ঠিক তখন থেকে। আরেকবার তিনি ঝড় তুলেছিলেন অদ্ভুত এক কথা বলে। বলেছিলেন, মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে শুরু করলে সময় ছুটবে একেবারে উল্টো দিকে।
এমন সব আশ্চর্য বিষয় যিনি ভেবে চলেছেন, ক্যামেরাটি আমি ফোকাস করেছি ঠিক তাঁর সামনে। ১২ আগস্ট ২০০৯। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমন্ত্রণ করেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১৬ জন মানুষকে, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দিতে। দিনটিতে মুখোমুখি পেয়ে গেলাম দুনিয়া-কাঁপানো বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে।
২১ বছর বয়সে স্টিফেন হকিংয়ের মোটর নিউরন রোগটি ধরা পড়লে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, আর মাত্র দুই বছর তিনি বাঁচবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে এ পদার্থবিজ্ঞানী বেঁচে রইলেন। বয়স এখন তাঁর ৭২ বছর। তাঁর জন্ম হয়েছিল ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে, ৮ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে।
‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূসও। তাঁর সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানে থাকার বিরল মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করার পরিকল্পনা মাথাতেই ছিল। এ ছাড়া নির্ধারিত অভ্যর্থনাকক্ষে বিশেষভাবে অপেক্ষা করছিলাম স্যার স্টিফেন হকিংয়ের জন্য। জানতাম, পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ঢুকবেন এখান দিয়েই। অধ্যাপক ইউনূসকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম, তাঁর সঙ্গে প্রফেসর হকিংয়ের অন্তরঙ্গ ছবি তোলার সুযোগ মিলে গেলে তিনি যেন আমাকে সময় দেন।
আমরা যেখানে অপেক্ষা করছি, তার সামনে বিশাল জানালা। দেখা যাচ্ছে, একে একে অতিথিরা আসছেন। প্রেসিডেন্ট ভবনের দায়িত্বে বিশেষ নিরাপত্তারক্ষী দেখছি। এত নিবিড় নিরাপত্তায় কি আমার প্রত্যাশা অপূর্ণ থেকে যাবে? দুপুরের আগে, ঠিক পৌনে ১২টায়, মামুলি একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থামল। চালক নিজেই এসে পেছনের দরজাটা খুলে দিলেন। কী যেন নামছে। সামনের দিকে কালো রঙের দুটি ছোট চাকা। বুঝতে আর সময় লাগল না। আমি লাফিয়ে উঠলাম।
নেমে এলেন আমাদের গ্রহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষটি। ড. ইউনূসকে বললাম, ছবি তোলার শুভক্ষণটি এসে গেছে। তিনি এগিয়ে গেলেন। তাঁর পেছনে আমরা। দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে হকিংয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ড. ইউনূসকে পাশে দাঁড়াতে বললে হকিংয়ের সঙ্গে আসা তাঁর মেয়ে লুসি হকিং ও পরিচারিকা সরে গেলেন। এ সময়ের শ্রেষ্ঠ দুই মানুষের যুগল ছবিটি তুলে ফেললাম।
হকিংয়ের চুল স্কুল-বালকদের মতো সুন্দর করে আঁচড়ানো। বড়সড় একটি কালো হুইলচেয়ারে কাত হয়ে বসে আছেন। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান অ্যাপল এ হুইলচেয়ারে লাগিয়ে দিয়েছে বিশেষ এক কম্পিউটার। মহাজগতের বিচিত্র রহস্যের সূত্র সেখানে ঘুমিয়ে আছে। তিনি ডান হাতে একমাত্র সচল আঙুলে মাউস নাড়াচাড়া করলেই সেসব রহস্য জেগে ওঠে। বিস্ময়ভরা তথ্যে হতবাক হয়ে পড়ি আমরা।

নাসির আলী মামুন, স্টিফেন হকিং ও ড. মুহাম্মদ ইউনুস, হোয়াইট হাউস, ওয়া​িশংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র, ১২ আগস্ট ২০০৯৷ ছবি: ভিদার জর্গেনসেন, ফটোজিয়াম
নাসির আলী মামুন, স্টিফেন হকিং ও ড. মুহাম্মদ ইউনুস, হোয়াইট হাউস, ওয়া​িশংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র, ১২ আগস্ট ২০০৯৷ ছবি: ভিদার জর্গেনসেন, ফটোজিয়াম

তাঁর কম্পিউটারটি আমি শক্ত হাতে চেপে ধরলাম। যেন মহাবিশ্বের সব রহস্য তাতে অনুভব করা যাবে। মনে হলো, তিনি বেশ খুশি। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি তাঁর বেশ শ্রদ্ধা আছে বলেই মনে হলো। তাঁর হাসিমাখা মুখের নিচের পাটির চারটি দাঁত জেগে উঠল।
স্টিফেন হকিংয়ের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। সৌররহস্যের গোপন বার্তা যিনি সারা পৃথিবীকে দিয়ে চলেছেন, তাঁর একি অসহায় অবস্থা! শুধু তাঁর মাথার ভেতরটা আর ডান হাতের একটি আঙুল ঠিকঠাক কাজ করছে। বাকি শরীর অসাড়। গলার নিচে একটি ফুটো।
ছবি তোলার সময় হকিংয়ের বাহু চেপে ধরলাম। নরম তুলতুলে। গাঢ় নীল কোট-প্যান্ট, ভেতরে সাদা শার্ট। একেবারে ইংরেজ সাহেব। কান দুটো কিছুটা বড়, যেন স্টার ট্রেক-এর কোনো চরিত্র। লুসি হকিং আমাকে অনুরোধ করলেন, ড. ইউনূস, হকিংসহ তাঁর একটি ছবি তোলা যায় কি না? আমি আনন্দের সঙ্গে ছবি তুললাম। জানতে চাইলাম, ড. ইউনূসকে হকিং কীভাবে চেনেন? লুসি জানালেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব খবর তিনি রাখেন। ড. ইউনূসের কাজের তিনি একজন সমর্থকও।
আবার আগের কামরাটিতে ঢুকে গেলাম। স্টিফেন হকিং চলে গেলেন অন্যদিকে। নানা কামরা ঘুরিয়ে কর্মীরা আমাদের নিয়ে গেলেন ইস্ট রুমে। কিছুক্ষণের মধ্যে স্ত্রী মিশেল ওবামাকে নিয়ে ঢুকলেন বারাক ওবামা। আমি দ্বিতীয় সারিতে, ক্যামেরা হাতে। লাল পোশাক পরা মিশেল বসলেন আমার ঠিক সামনের চেয়ারে।
মঞ্চে বিশ্বখ্যাত ১৬ জন মানুষ চেয়ারে বসা। পরিচারিকাটি পেছন থেকে বারবার উঠে এসে হকিংয়ের লালা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। ওবামা নিজেই সাইটেশন পড়ে সবাইকে মেডেল পরিয়ে দিলেন। মেডেল দেওয়ার সময় করতালি হচ্ছিল। ড. ইউনূসের নাম ঘোষণার পর করতালির ঝড় বয়ে গেল।
অনুষ্ঠান শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো বড় এক হলঘরে। পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের সঙ্গীদের জন্য সেখানে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গল্প আর খাওয়াদাওয়া চলছে। এক কোণে দেখি দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু। উল্টো দিকে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা সিডনি পইটিয়ারসহ বহু বিখ্যাত মানুষ। কারা কেনেডি তাঁর বাবা সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির পক্ষে পদক নিতে এসেছিলেন। তাঁকে জানালাম, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বাবার অবদানের কথা বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি। শুনে বললেন, কথাটি তিনি বাবাকে জানাবেন।
স্টিফেন হকিং ঘরের মাঝখানে। হুইলচেয়ারে অসহায়ভাবে কাত হয়ে আছেন। এগিয়ে গিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে ড. ইউনূসসহ একটি ছবি তুলতে পারি? আমি জানতাম, তিনি কথা বলতে পারেন না। কিন্তু চমকে দিয়ে পরিষ্কার গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর এল, ‘ইয়েস।’ বুঝলাম, ভয়েস সিনথেসাইজারের কী মাহাত্ম্য?
ছবি তুলছি, কিন্তু মন ভরছে না। কাছাকাছি ওত পেতে রইলাম। কিন্তু হকিং রইলেন সেই একভাবেই। ডানে-বাঁয়ে ঘাড়ও ঘোরাতে পারছেন না। লুসি তাঁকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন—এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধরার পর তিনি বিনীতভাবে নিষেধ করলেন। কিন্তু ছবি তো তোলা হয়ে গেছে। মুখের কাছে ক্যামেরা ফোকাস করলে হকিং সহাস্যে দাঁত বের করলেন।
সেই অসহায় নিঃসঙ্গ দৃশ্য কি ভোলা যায়!