লুসি হকিংয়ের মুখোমুখি

ব্রিটিশ সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ক্যাথরিন লুসি হকিং এসেছিলেন ঢাকায় হে উৎসবে যোগ দিতে। তাঁর আরও একটি পরিচয় তিনি জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্যার স্টিফেন হকিংয়ের মেয়ে। লুসি হকিংয়ের কথায় ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর বাবা এবং তাঁর নিজের হয়ে ওঠার গল্প।

ঢাকা ঘুরে গেলেন লুসি হকিং। ছবি: খালেদ সরকার
ঢাকা ঘুরে গেলেন লুসি হকিং। ছবি: খালেদ সরকার

এবারের হে উত্সবে লুসি হকিং আসছেন। শোনার পর থেকেই উত্তেজনা। লুসি হকিং মানে জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্যার স্টিফেন হকিংয়ের মেয়ে? বাংলাদেশে আসবেন? খবরটা ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। ঢাকা হে উৎসবের পরিচালক সাদাফ সাজের কথা শুনে প্রায় লাফ দিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললাম, যে করেই হোক লুসি হকিংয়ের সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। কারণ, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় স্টিফেন হকিংকে নিয়ে কম লেখালেখি তো করিনি। ২০ নভেম্বর, ২০১৪। খবর পেয়েই ছুটলাম সোনারগাঁও হোটেলে। সেখানেই উঠেছেন তিনি। প্রায় আধা ঘণ্টা পর দূর থেকে দেখেই চিনতে পারলাম। ছোটখাটো গড়নের, মুখে হাসি। নীল রঙের একটা জামা পরেছেন। হাতে ছোট ভ্যানিটি ব্যাগ। ‘দ্বিতীয় আইনস্টাইন’ নামে পরিচিত, মোটর নিউরন ডিজিজের সঙ্গে ৫০ বছর ধরে লড়াই করা হুইল চেয়ারের পদার্থবিজ্ঞানী স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং-এর মেয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ক্যাথরিন লুসি হকিং আমার সামনে। এগিয়ে গেলাম পরিচিত হতে।

বাবা-মেয়ে দুজনই যখন বিখ্যাত: বাবা স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে লুসি। ছবি: সংগৃহীত
বাবা-মেয়ে দুজনই যখন বিখ্যাত: বাবা স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে লুসি। ছবি: সংগৃহীত

সুপার হিরোর মেয়ে
লুসিকে বললাম, চলুন আপনার ‘বিখ্যাত বাবা’র কথা দিয়েই শুরু করি। আমাকে থামিয়ে দিয়ে লুসি বললেন, ‘মোটেই না। আমার ছোটবেলায় বাবা মোটেই বিখ্যাত ছিলেন না। আমি, আমার বড় ভাই রবার্ট, আমরা সবাই বাবার দেখাশোনা করতাম, যত্ন নিতাম। এমনকি আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাই টিমও বাবার খেয়াল রাখত। আর দশজন বাবার মতোই বাবা সকালে চলে যেতেন, সন্ধ্যায় ফিরতেন।’
পরিবার নিয়ে হকিং তখন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকেন। সেখানকার তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তখন ছিলেন বাংলাদেশি অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামও। দুই পরিবারের সখ্যের কথা স্মরণ করে লুসি জানালেন, বেশির ভাগ সময় দুই পরিবার একসঙ্গে সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে যেত নদীর পাড়ে। এদিক–সেদিক। প্রফেসর ইসলামের বড় মেয়ে (সাদাফ সাজ, হে উৎসবের অন্যতম পরিচালক) এবং লুসি প্রায় সমবয়সী।
ক্যাম্পাস ও পদার্থবিজ্ঞান জগতের বাইরে তখন খুব কম লোকই হকিংকে চেনে। ক্যাম্পাসের সবাই হকিংকে আরও একটি কারণে চিনত। সেটি বিখ্যাত হুইলচেয়ারের কারণে। ‘বাবার হুইলচেয়ারটি ছিল মোটরচালিত। এবং বাবা নিজেই সেটি চালিয়ে ক্যাম্পাসে চলাচল করতেন। বাবা খুব দ্রুত এই চেয়ার চালাতেন।’ লুসি বলছিলেন ফেলে আসা দিনের কথা।
লুসির বয়স যখন ১৮-১৯, তখন স্টিফেন হকিংয়ের বিখ্যাত গ্রন্থ এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম প্রকাশিত হয়। লুসি বলছিলেন, ‘ব্রিফ হিস্ট্রি প্রকাশের পর বাবা বিখ্যাত হতে শুরু করেন এবং তখন থেকে তাঁর ব্যস্ততাও অনেক বেড়ে যায়। ফলে, আমাদের সঙ্গে বাবার সময় কাটানোর পরিমাণও কমতে থাকে।’
লুসি জানালেন, এর পর থেকে বলতে গেলে জর্জের অ্যাডভেঞ্চার সিরিজটি লেখার আগ পর্যন্ত বাবার সঙ্গে তাঁর তেমন সখ্য ছিল না।

সত্তরের দশকে: বাবা স্টিফেন হকিং, মা জেন ওয়াইল্ড ও ভাই রবার্টের সঙ্গে লুসি
সত্তরের দশকে: বাবা স্টিফেন হকিং, মা জেন ওয়াইল্ড ও ভাই রবার্টের সঙ্গে লুসি

বাবার বিজ্ঞান ও মায়ের ভাষা
পদার্থবিজ্ঞানী বাবা আর ভাষাতত্ত্বের মা, কার প্রভাব বেশি পড়েছে তাঁর ওপর? এমন প্রশ্নের জবাবে দুজনেই তাঁকে সমানভাবে প্রভাবিত করেছেন বলে জানালেন লুসি।
কিন্তু আপনি তো পদার্থবিজ্ঞান না পড়ে অক্সফোর্ডে ফরাসি ও রুশ ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। আপনার বাবা আপনাকে বিজ্ঞানী বানাতে চাননি?
লুসির জবাব, ‘সব বাবাই চান তাঁর সন্তানেরা তাঁর মতোই হোক। তবে বাবারা সব সময় সফল হন না। আমি যখন খোলাখুলি তাঁকে বলেছি পদার্থবিজ্ঞান আমার ভালো লাগে না, তখন বাবা আর আপত্তি করেননি। তখন কি আর জানতাম আমাকে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানেই ফিরতে হবে!’
এর কারণ? ‘ছোটবেলা থেকে আমার শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি বেশি ঝোঁক। ব্যালে নাচের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহের কারণে আমি ভেবেছিলাম ব্যালেরিনা হব। কিন্তু এই ছোটখাটো গড়ন নিয়ে ব্যালেরিনা হওয়া যায় না। আমি আবার নাচার সময় পাক খেতে গিয়ে পড়েও যেতাম।’
কাজেই লুসির ব্যালেরিনা হওয়া হলো না।
২০০৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস জাদেদ এবং তার পরের বছর উপন্যাস রান ফর ইউর লাইফ প্রকাশিত হয়। লুসির নিজেরও বিখ্যাত হওয়ার শুরু সেখান থেকেই।

গেল সপ্তাহের হে উৎসবে লুসি হকিং
গেল সপ্তাহের হে উৎসবে লুসি হকিং

অ্যাডভেঞ্চারের দুনিয়া
সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক লুসির জীবন তাঁর বাবার মতো বিজ্ঞানেই ফেরত আসে ২০০৭ সালে। সেই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই জর্জ’স সিক্রেট কি টু দি ইউনিভার্স। লুসি তাঁর বাবা স্টিফেন হকিং এবং গবেষক ক্রিস্টোফে গলফ্রাডের সঙ্গে যৌথভাবে বইটি লেখেন। মজার অ্যাডভেঞ্চার এবং গল্পের আদলে লেখা এই বইটি প্রকাশের পরপরই বিশ্বজুড়ে সবারই মনোযোগ আকর্ষণ করেন লুসি। বইটি প্রকাশের পর ২০০৮ সালে নাসার সুবর্ণজয়ন্তীতে লুসি সেখানে বক্তব্য দিতে যান।
তখন থেকে তিনি শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করার জন্য বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলা একাডেমির চত্বরে হে উৎসবের দ্বিতীয় দিনে তাঁর এমন একটি আলোচনা উপভোগ করেছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী এবং তাদের বাবা-মায়েরা। পরে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও স্কলাস্টিকা স্কুলেও লুসি হকিংয়ের গল্প শুনেছেন অনেকেই।
২০০৮ সালেই তিনি ইউরোপের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘স্যাপিও প্রাইজ ফর পপুলারাইজিং সায়েন্স’ লাভ করেন।
এরপর ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় জর্জ’স কসমিক ট্রেজার হান্ট। ২০১১ সালে জর্জ অ্যান্ড দি বিগ ব্যাং। মাস দুয়েক আগে প্রকাশিত হয়েছে জর্জ অ্যান্ড দি আনব্রেকেবল কোড।
উপন্যাস আর গল্প বলার ঢংয়ে এই বইগুলো বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের একটি নতুন পর্যায় উন্মোচিত করেছে। এর মধ্যে জর্জ’স সিক্রেট কি ৩৮টি ভাষায় অনুবাদ হয়ে ৪৩টি দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
লুসির জগৎ
জর্জ সিরিজ লেখার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন—প্রশ্নটা শুরু থেকেই মাথায় ছিল। কারণ, জানতাম লুসি মোটেই বিজ্ঞানের ‘লোক’ নন। লুসি উত্তরটা দিলেন এভাবে।
‘তোমাকে আমার ১৭ বছর বয়সী একমাত্র ছেলের কথা বলি। ওর যখন নয় বছর বয়স, তখন নানার সঙ্গে দেখা হলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রশ্ন করত। বাবা তাঁর কম্পিউটার আর যান্ত্রিক স্বরে সেসব প্রশ্নের জবাব দিতেন। আমি লক্ষ করলাম, বাবার উত্তরগুলো প্রায় বইয়ের মতো নয়। বরং মজাদার এবং একটু ভিন্ন রকম। তুমি তো জানো, বাবা খুবই মিশুক। কাজেই গল্প, কৌতুকের সঙ্গে মেশানো বিজ্ঞান আমার ছেলে গোগ্রাসে গিলত। বাজারে দেখলাম প্রচুর সায়েন্স ফিকশন রয়েছে। সায়েন্স ফিকশন নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর, চমত্কার ও মোহনীয়। কিন্তু আমরা যে দুনিয়ায় বাস করি তার সম্পর্কে সায়েন্স ফিকশন কিছুই তো বলে না। তাই আমি আর বাবা মিলে ভাবলাম বিজ্ঞানের কল্পনা নয়, বরং বিজ্ঞানের সত্য নিয়েই আমরা বই লিখব।’
কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার ঢঙে লিখলেন কেন?
‘শিশুরা খুব সহজে জ্ঞানের বই পড়তে চায় না। যখনই ওরা বোঝে যে তুমি তাদের শেখানোর চেষ্টা করছ, তখনই সে বেঁকে বসে। কিন্তু আমি যদি শুরু করি ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম দেয়ার ওয়াজ এ’, তাহলেই ওরা নড়েচড়ে বসে। তারপর যখন দেখে তার বয়সী কোনো ছেলে বা মেয়ে একটা মজার জগতে চলে যাচ্ছে, তখনই সেও সেখানে ঢুকে পড়ে। তার মনেই হয় না সে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারছে। জর্জ চরিত্রে আমার ছেলেকে খানিকটা খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন এই সিরিজের সর্বশেষ বই জর্জ অ্যান্ড দ্য ব্লু প্ল্যানেট লিখছেন লুসি হকিং।
কোন ফাঁকে পেরিয়ে গেছে নির্ধারিত সময়। লুসিকে শেষ প্রশ্নটা সেদিন করা হলো না।
পরের দিন হে উৎসবে বাংলা একাডেমি চত্বরে দেখা হতেই জানতে চাইলাম বাংলাদেশ কেমন লাগল?
লুসি হাসিমুখে জবাব দিলেন, ‘তোমাদের দেশের মানুষেরা খুবই ভালো। আমি বেশ উপভোগ করছি।’