চমক জাগানিয়া!

ছবি: সুমন ইউসুফ
ছবি: সুমন ইউসুফ
চমক হাসানের কাছে গণিতের সূত্র একটাই—‘এ ম নি প’। এসো মজা নিয়ে পড়ি! বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করে পিএইচডি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনায়। সেখানে বসেই ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গণিত ও বিজ্ঞানের আনন্দ

লোকটার বয়স হতে পারে ৩৫, তার বেশিও হতে পারে। গলায় ক্যামেরা ঝুলছে। উৎসুক তরুণ-তরুণীতে ভরপুর ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছোট্ট হলঘরে ছবি তুলছিলেন। এসেছেন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে। হঠাৎ হাত তুললেন, মঞ্চের অতিথিকে প্রশ্ন করতে চান। মাইক দেওয়া হলো তাঁকে। বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে গণিতে আমার খুব ভয়। কোনোরকমে গণিত বিষয়টা পাশ কাটিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছি। চাকরিজীবন শুরু হয়েছে। আমার ছোট ভাই আপনার কাছে পড়ত। ওর মুখে আপনার প্রশংসা শুনতে শুনতে খুব কৌতূহল হলো। ও যা পড়ে আসত, সব শুনতাম। ইউটিউবে আপনার ভিডিওগুলো দেখে ফেললাম এবং একসময় আবিষ্কার করলাম, সত্যিই গণিত দারুণ মজার একটা বিষয়। এখন আমার কাছে গণিত একটা আনন্দ!’

মঞ্চের অতিথি প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলেন। শুনলেন প্রশংসা। উত্তরে কী বলবেন? স্বভাবসুলভ হাসি ধরে রাখলেন মুখে। চোখে চমকিত ঝিলিক। এ রকম অনেক চমক-জাগানিয়া গল্প এখন রোজই শোনেন চমক হাসান। কুষ্টিয়া জিলা স্কুল ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে পাস করে চমক ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তড়িৎ কৌশল বিষয়ে স্নাতক শেষ করে চলে গেছেন ‘সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে’র যুক্তরাষ্ট্রে। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনায় পিএইচডি করছেন তড়িৎ কৌশলেই। সম্প্রতি দেশে এসেছেন। প্রতিদিনই ডাক পড়ছে এই অনুষ্ঠান, ওই অনুষ্ঠানে। এবং অবধারিতভাবেই প্রতিটি অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনছেন অনেক চমক-জাগানিয়া গল্প, গণিতকে ভালোবাসার গল্প।
আপনার জীবনে সবচেয়ে বড় চমক কী? প্রশ্ন করেছিলাম আমরা। ৭ জানুয়ারি প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে চমক হাসান বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজভাবে স্বতন্ত্র। ঠিক তার মতো করে চিন্তা করতে পারে, এমন কেউ নেই। অথচ তারা একসঙ্গে মিলে কত বড় বড় কাজ করে ফেলে। অল্প কিছু মানুষ প্রভাব ফেলে যায় নিযুত লক্ষ মানুষের জীবনে—এ ব্যাপারগুলো খুবই চমকপ্রদ মনে হয় আমার কাছে।’
চমক হাসানের দর্শন আর তাঁর কর্মকাণ্ড একই সুরে কথা বলে। বাংলাদেশের অনেক তরুণ-তরুণী এমনকি মাঝ বয়সীদের জীবনে তাঁর অনেক প্রভাব। একটা উদাহরণ তো প্রথমেই পেলেন। গণিত কিংবা বিজ্ঞান বিষয়টা যে এত সহজ করে, আনন্দের সঙ্গে মিশিয়ে শেখানো যায়, এই চিন্তাটা এল কী করে তাঁর মাথায়? গল্পটা শুনতে হলে চমক হাসানের শৈশব-কৈশোরের অভিজ্ঞতা শুনতে হবে আগে, ‘ছেলেবেলায় গৎবাঁধা নিয়মে লেখাপড়া করেছি। কোনো বিষয়ের গভীরে চিন্তা করতে কেউ শেখাতেন না।’
এই সমস্যা তো এখনো আছে। কেন এমনটা হচ্ছে? চমক গুছিয়ে উত্তর দিলেন, ‘গণিতের অনেক বিষয় ভেতর থেকে অনুভব করা যায়, গণিত খুব মজা নিয়ে শেখা যায়, শিক্ষকদের অনেকে সেটা অনুভব করেন না। অধিকাংশ শিক্ষক নিজেরা খুব মজা নিয়ে শেখেননি, তাঁরা যেভাবে শিখে এসেছেন, সেভাবেই নতুন প্রজন্মকে শেখাতে চান। এভাবেই গণিতের ভীতি বাড়তে থাকে।’
চমকের জীবনদর্শন খুব সহজ, যা-ই করবেন, আনন্দের জন্য করবেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ গণিত পড়ানোয়। গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বুয়েটে পড়ার সময় থেকে। অলিম্পিয়াডের জাতীয় গণিত ক্যাম্পে ‘নাম্বার থিওরি’ পড়াতেন। অলিম্পিয়াড কমিটির উদ্যোগে সারা দেশে ‘সংখ্যা ভ্রমণ’ নামে একটা কর্মসূচির সঙ্গে ছিলেন একেবারে শুরু থেকেই। আর পড়ানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ হয়েছিল কোচিংয়ে শিক্ষকতার সুবাদে। ‘২০১১ সালে যখন দেশের বাইরে গেলাম, মন খুব খারাপ থাকত।’ বলছিলেন চমক, ‘পড়ানো ব্যাপারটাকে খুব মিস করতাম। তখন থেকেই চিন্তা ছিল কিছু একটা করব!
‘কিছু একটা’ করার জন্য চমক বেছে নিলেন ইউটিউবকেই। বলছিলেন বাকিটুকু, ‘ইউটিউব খুবই চমৎকার মাধ্যম হবে, এটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার টাচপেন ছিল না, তাই ঠিক করলাম, ইকুয়েশনগুলো সম্পাদনা করে ভিডিওতে বসিয়ে দেব। সেভাবেই “গণিতের রঙ্গে” ভিডিও সিরিজের শুরু। এরপর তৈরি করি শিক্ষক ডটকম-এর জন্য “ক্যালকুলাসের অ-আ-ক-খ” ভিডিও সিরিজ। অনেকেই গণিত নিয়ে নানা প্রশ্ন করত, সেগুলোর উত্তর দিতে “চটপট গণিত” নামে আরও একটা সিরিজ বের করি। আর কিছুদিন আগে অন্য রকম জ্ঞানবাক্সের প্রযোজনায় “বিজ্ঞান বিগ ফান” নামে বিজ্ঞানের একটা ভিডিও সিরিজ শুরু করেছি।’
চমক শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয়, তাঁর ভিডিওগুলোর দর্শকও অনেক। ভালো পড়ানোর সূত্র কী? চমক বললেন, ‘ভালো পড়ানোর জন্য প্রথম প্রয়োজন ছাত্রছাত্রীদের মনস্তত্ত্ব বোঝা। ওরা আসলেই আমার কথা বুঝতে পারছে কি না, সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বলবে না, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই আমি নিজেই বোঝার চেষ্টা করতাম, এবং যদি বুঝতাম যে ওরা বুঝতে পারছে না, অন্যভাবে চেষ্টা করতাম। অনেক সময় ক্লাসে ওরা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত, তখন এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতাম। মজার গল্প করে গণিত বোঝাতাম। আমার ভাবনা ছিল, আমি যদি ওদের থেকে মজা করে গল্প বলতে পারি, তাহলে ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করবে কেন? বরং আমার গল্প শুনবে!’
চমকের চমক দেওয়া শেষ হয় না। কেবল শিক্ষক হিসেবেই নয়, কুষ্টিয়ার এই তরুণের লেখা দুটি বই গল্পে জল্পে জেনেটিক্স ও গণিতের রঙ্গে: হাসিখুশি গণিত পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। আর আছে গান। নিজেই লেখেন, সুর বসিয়ে গেয়েও ফেলেন। গণিত অলিম্পিয়াডের থিম সংটাও তাঁরই। চমক গানে গানে বলেছেন, ‘মন মেলে শোন, শুনতে পাবি বিজয়ের আহ্বান,/ গণিতের ধ্বনিতেই বাজে ওই মুক্তির জয়গান...।’
চমকের কাছে শেষ প্রশ্ন, যারা গণিত ভয় পায়, তাদের কী বলবেন? উত্তর ছিল এ রকম, ‘আপনি গণিত ভয় পান, এটা আপনার দুর্বলতা নয়। হয়তো গণিতের আনন্দটা আপনার কাছে কেউ উপস্থাপন করেনি। একবার একটু সাহস নিয়ে নিজে নিজে গণিত করুন। যতটুকুই বুঝতে পারেন, সেটা ছোটদের শেখান। শেখানোর সময় সবচেয়ে বেশি শেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। দেখবেন, একবার যখন ভয় কেটে যাওয়া শুরু হবে, একটা অপার আনন্দ এসে ভর করবে।’
গণিতের আনন্দ উপভোগ করতে চাইলে ঢুঁ মারুন চমক হাসানের ইউটিউব চ্যানেলে:
www.youtube.com/user/swopnochari