অলিম্পিকের হাতছানি

মাবিয়া আক্তার
মাবিয়া আক্তার

এ যেন বাংলা সিনেমার কোনো চিরচেনা গল্প। নায়িকা কোথাও যাচ্ছেন। হঠাৎ পেছন থেকে পথ আটকে দিয়েছে এলাকার বখাটেরা। পরে সেই বখাটেদের ঠেঙিয়ে ‘হিরো’ বনে গেলেন নায়ক।
আপাতত গল্পের প্রথম দৃশ্যটা ঠিক থাকলেও, আমাদের মাবিয়া আক্তার, মানে সীমান্তের বেলায় পরের দৃশ্যে ‘হিরো’ হয়ে গেছে একটি সোনার পদক। শুনে অবাক লাগছে?
সোনাজয়ের পর মাবিয়ার চারপাশের জগৎটা এতখানি বদলে গেছে যে পাড়ার ওই বখাটেরা এখন মোটেও উৎপাত করে না। মাবিয়ার কণ্ঠে স্বস্তির সুর, ‘যে ছেলেরা আগে ডিস্টার্ব করত, এখন ওরাই আমাকে অনুশীলনে এগিয়ে দেওয়ার জন্য গলির ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর অনেকে তো টর্চ দিয়ে দেয়, যাতে পথে যেতে কোনো অসুবিধা না হয়।’ সোনার ছোঁয়ায় যেন সবার হৃদয়ও সোনা হয়ে গেছে!
আসলেই ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে ভারোেত্তালক মাবিয়ার চেনা দুনিয়া। আর সেই দুনিয়াটা বদলে যাওয়ার শুরু গত ফেব্রুয়ারিতে, দক্ষিণ এশীয় গেমসে (এসএ গেমস)। যেদিন গুয়াহাটির ভোগেশ্বরী ফুকনানি ইনডোরে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে ভারতের প্রতিযোগীকে হারিয়ে সোনা জিতে নিয়েছিলেন মাবিয়া।
এবারের এসএ গেমসে প্রথম তিন দিন কেটে গেলেও যখন সোনার পদক ‘সোনার হরিণ’ হয়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) কর্মকর্তারা যখন শুকনো মুখে এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে কাঙ্ক্ষিত সোনার পদকের জন্য ঘুরছিলেন, তখনই প্রথম বেজে উঠল আমাদের জাতীয় সংগীত। মঞ্চে উঠে সেই সংগীতের মূর্ছনায় গলা মেলালেন মাবিয়া। চোখের জলে বুক ভাসালেন। ঢাকা থেকে যাওয়া আমাদের মতো যেসব সাংবাদিক ছিলেন, মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে মাবিয়ার পদক নেওয়া দেখতে দেখতে সবার চোখের কোণেই জমেছিল পানি। মাবিয়ার ওই কান্নার দৃশ্য পরে ‘ভাইরাল’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ভার্চ্যুয়াল জগতে।
ওই কান্নায় যেন লুকিয়ে ছিল নানা বঞ্চনার ইতিহাস। মাবিয়ার বাবা হারুনুর রশীদ খিলগাঁওয়ের মুদিদোকানদার। টাকার অভাবে একসময় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মাবিয়ার। ভারোেত্তালন খেলে বাংলাদেশ আনসারে চাকরি পেয়েছেন। এখন সংসারেও হাসি ফুটেছে। আবারও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে মাবিয়ার স্বপ্ন এখন আকাশছোঁয়া, ‘আমি এবার অলিম্পিকে খেলতে চাই।’
ভারোত্তোলনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়মিতই সাফল্য পেয়ে আসছে বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন মাবিয়া প্রথমবারের মতো এসএ গেমসে গিয়েই। এর আগে ভারোত্তোলনে মেয়েদের ইভেন্ট ছিল না এসএ গেমসে। এবার সুযোগ পেয়েই সোনার পদক জিতে ইতিহাস গড়লেন মাবিয়া। সাফল্য আগেও পেয়েছেন মাবিয়া, মালয়েশিয়ায় ২০১৩ সালে কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে রুপা জেতেন, পরের বছর উজবেকিস্তানে আফ্রো-এশিয়া কাপেও জেতেন রুপা। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে কিংস কাপে জেতেন ব্রোঞ্জ। নেপালে প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও ব্রোঞ্জ জেতেন।
বক্সিং কোচ মামা শাহাদাৎ কাজী জোর করেই একদিন ভারোত্তোলন খেলানোর জন্য নিয়ে এসেছিলেন। খেলতে চাইতেন না বলে মামার কাছে কত বকা খেয়েছেন। এখন মাবিয়া যেন তরুণদের জন্য এক প্রেরণার নাম। ‘আমাদের এলাকার অনেক মেয়ে এখন ভারোত্তলনে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি ওদের ফেডারেশনের ঠিকানা দিয়েছি। অনুশীলনেও অনেক নতুন মেয়ে আসছে।’
পল্টনের যে জিমনেসিয়ামে মাবিয়ারা অনুশীলন করেন, সেটাকে গুদামঘর বলাই ভালো। ছোট্টো পরিসর। আধুনিক সরঞ্জাম অপ্রতুল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র নেই। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে সেখানেই হাসিমুখে অনুশীলন করেন।
খিলগাঁওয়ে মাবিয়াদের বাড়িতে গিয়ে অন্য রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হলো। সিপাহীবাগের বস্তির মধ্যে একখানা টংঘর। পচা ডোবার ওপরে গড়ে ওঠা বস্তির একটি ঘরে গাদাগাদি করে মাবিয়া থাকেন বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাঁশ দিয়ে তৈরি সাঁকো পেরিয়ে যখন মাবিয়ার বাড়িতে গিয়েছি, তখন রাত। স্থানীয় থানার পুলিশ কর্মকর্তারা মাবিয়াকে একনজর দেখতে ভিড় জমিয়েছেন।
এসব এখন দারুণ উপভোগ করেন মাবিয়া, ‘মনে হচ্ছে এখনো স্বপ্নের মধ্যে, ঘোরের মধ্যে আছি। সবকিছু খুব উপভোগ করছি। আগে সেলিব্রিটিদের এমনটা করতে দেখেছি। কিন্তু নিজেই সেলিব্রিটি হয়ে যাব, তা কোনো দিন ভাবিনি।’
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলে, শপিংয়ে গেলে লোকজন ছবি তোলে, সেলফি তোলে। এই তো গত সপ্তাহে ঘটে গেল মজার ঘটনা। শফিপুর আনসার একাডেমিতে যাচ্ছিলেন মাবিয়া। যাওয়ার পথে একটা রেস্তোরাঁয় খেতে বসেন। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার তাঁকে দেখেই চিনতে পারেন। কাছে এসে বলেন, আপনাকে টিভিতে দেখেছি। এরপর বলেন, আমি খুব ভাগ্যবান যে আপনি আমার রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছেন। এমনকি মাবিয়ার খাবারের বিলটাও রাখেননি ভদ্রলোক। বলেছিলেন, ‘আপা, আপনাকে টিভিতে কাঁদতে দেখেছিলাম। আপনার কান্না দেখে আমিও কেঁদেছিলাম।’
অলিম্পিকের ওয়াইল্ড কার্ড পেতে এবার মাবিয়া খেলবেন এশিয়ান ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে। ২০ এপ্রিল অলিম্পিকের বাছাইপর্ব
খেলতে উজবেকিস্তান যাচ্ছেন। আগামী আগস্টে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে হবে অলিম্পিক। রিও অলিম্পিক যেন হাতছানি দিচ্ছে।’