Thank you for trying Sticky AMP!!

জি-গ্যাস, ডি-ডিজেল, পি-পেট্রল

পছন্দ-অপছন্দের সূচক

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির নেশা বেশি রাজনীতিবিদদের। অর্থনীতিবিদেরা যতই জিডিপির বিভ্রম থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিন, রাজনীতিবিদেরা তা থোড়াই কেয়ার করেন। কেননা অর্থনীতি নিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে ভালো আর কোনো সূচক নেই। জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে—এই তথ্যে রাজনৈতিক ফায়দা অনেক বেশি তুলে নেওয়া যায় বলেই মনে করা হয়।

Also Read: সরকার ডেকে আনল মূল্যস্ফীতি

জিডিপি যদি রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে পছন্দের সূচক হয়, তাহলে সবচেয়ে অপছন্দের সূচক কী? এককথায় উত্তর হচ্ছে—মূল্যস্ফীতি। বলা হয়, রাজনীতিকে সবচেয়ে প্রভাবিত করে অর্থনীতির এই সূচকটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০০৫ সালে গবেষণা করে বলেছিল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। জার্মানির অর্থনীতিবিদ রুডিগার ডর্নবুশ গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর শাসনামলে অর্থনৈতিক বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরাই মন্ত্রিসভার রদবদলের শিকার হন সবচেয়ে বেশি এবং তাঁদের মন্ত্রিত্বের মেয়াদকালের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারের নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে।

এবার সাধারণ মানুষের দিকে আসা যাক, যাঁরা অর্থশাস্ত্র পড়েন না, এমনকি রাজনীতিও করেন না। এই যে এখন চলতি হিসাবের ঘাটতি ১ হাজার ৮৭০ কোটি ডলার, গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ—তাতে একজন সাধারণ মানুষের কী যায় আসে। কিংবা সর্বোচ্চ বাণিজ্যঘাটতি কিংবা চলতি আয়ের ভারসাম্যে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতির প্রভাবই বা কী তাঁদের জীবনে। এগুলো না হয় জটিল হিসাব। সহজ হিসাবেরও উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার না আইএমএফের হিসাব পদ্ধতিতে তা ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার—তাতেই–বা সাধারণ মানুষের কী যায় আসে। কেবল একটি সূচকেই আসলে যায় আসে। অর্থনীতির যে সূচকের প্রভাব বা উত্তাপ সাধারণ মানুষ সবচেয়ে টের পায়, তা হলো মূল্যস্ফীতি।
কারণ, ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হচ্ছে আগে যেসব পণ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত, সেই একই পণ্য কিনতে এখন ১১০ টাকা লাগবে। সুতরাং আয় বাড়াতে হবে ১০ টাকা। নইলে আগের চেয়ে কম খেয়ে থাকতে হবে। এতে কমবে জীবনযাত্রার মান। মূল্যস্ফীতি মানেই আয়ের ওপর সরাসরি আঘাত। এ কারণেই মূল্যস্ফীতিকে নীরব ঘাতক ও পরোক্ষ কর বলা হয়।

Also Read: আপনার মাথাপিছু আয় যেভাবে বেড়েছে

বিভ্রান্তিকর সূচক

জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি রাজনীতিবিদদের পছন্দের সূচক হলেও সাধারণ মানুষের কাছে এই দুটি সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর সূচক। জিডিপি হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের অভ্যন্তরে বা ভৌগোলিক সীমানার ভেতর বসবাসকারী সব জনগণ কর্তৃক উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের অর্থমূল্যের সমষ্টি। অর্থাৎ ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী দেশের সব নাগরিক ও বিদেশি ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে বিদেশে অবস্থানকারী ও কর্মরত দেশের নাগরিক, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না। আর একটি দেশের মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে অর্থাৎ মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়। একেই বলে মাথাপিছু আয়। মাথাপিছু গড় আয় কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত আয় নয়। সুতরাং রাতারাতি মাথাপিছু আয় বাড়লেও তা কখনোই টের পান না সাধারণ মানুষ। এই আয় থাকে কেবল সরকারের নথিতে, অন্য কোথাও নয়। সুতরাং মন্ত্রীরা যখন জিডিপি ও মাথাপিছু বৃদ্ধির গল্প করেন, তখন সাধারণ মানুষ আয় দেখতে না পেয়ে আরও বিভ্রান্ত হন।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Also Read: নিলুফা খাতুনের মাথাপিছু আয় বাড়ার গল্প

কথা রেখেছে সরকার

কোভিডের কারণে ২০২০ সালে যখন বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায়, কমে গেছে প্রবৃদ্ধি, তখন বাংলাদেশ ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘোষণা দিয়ে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। দেশে জিডিপির হিসাব নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। তবে কোভিডের সময় এই বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য নিয়ে সন্দেহও বেড়েছে। এমনকি সন্দেহ আছে মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়েও। মজার বিষয় হলো জিডিপি যেহেতু পছন্দ, তাই এটিয়ে বাড়িয়ে দেখানো হয়, আর মূল্যস্ফীতি যেহেতু অপছন্দের, তাই এটি কমিয়ে দেখানো হয়। সমস্যা হচ্ছে, জিডিপি বাড়লেও তা টের পাওয়া যায় কম, আর মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হলেও এর উত্তাপ পাওয়া যায় অনেক বেশি। অনেকটা আবহাওয়ার মতো, অনুভূত হয় বেশি।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সাড়ে ৭ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সুখবর হচ্ছে, অর্থবছর শুরুর এক মাসের মধ্যেই জিডিপি অর্জিত হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এক মাসের জিডিপির হিসাব সরকার করছে না। তাহলে অর্জন কীভাবে হবে। উত্তরটা খুবই সহজ। যেমন এখানে জিডিপির জি মানে গ্যাস, ডি মানে ডিজেল আর পি মানে পেট্রল। শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। তখন পি মানে পাওয়ার বা বিদ্যুৎ বলা যাবে। আর গ্যাসের দাম তো কদিন আগেই সরকার বাড়িয়েছে।

Also Read: সুখস্থান নামের দেশের জিডিপির গল্প

নতুন এই জিডিপি কি মূল্যস্ফীতিকে বাড়াবে? যদিও অর্থমন্ত্রীর প্রাক্কলন হচ্ছে চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্ব পরিস্থিতি যা–ই হোক, জি (গ্যাস) ডি (ডিজেল) পি (পাওয়ার) যতই বাড়ুক, মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখা বিবিএসের বাম হাতের কাজ। দেখাই যাক না, কী হয়।

সুতরাং যাঁরা লেখাটা পড়ছেন, তাঁদের সামনের দিনগুলোতে খুশির মাত্রা বাড়ুক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মতোই—৫১ শতাংশ। দুঃখ কমুক টাকার মান কমার মতোই—প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ, আর আপনাদের হৃদয় আনন্দে ভরে উঠুক দেশের সীমাহীন দুর্নীতির মতোই, যা কোনো শতাংশের ঘরে আটকে রাখা সম্ভব হলো না।

Also Read: এত মাথাপিছু আয় দিয়ে কী করবেন