‘দাম না পাইলে আবাদ ছাড়ি দেওয়ার নাগিবে’

চলতি আমন মৌসুমের শুরুতেই বীজ ও সার বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে কৃষককে।

সেচ মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দেওয়া হচ্ছে। আমনের চারা রোপণ করতে খেতে যাচ্ছেন দুই কৃষক। ডিজেলের দাম বাড়ায় এবার ধান উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। সোমবার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সনগাঁও গ্রামেছবি: প্রথম আলো

আঁকাবাঁকা গ্রামীণ পথ। দুই পাশে ফসলি জমি আর ঝোপঝাড়। এই পথ ধরে এগিয়ে যেতে চোখে পড়ে কর্মব্যস্ততা। বেশির ভাগ জমিতে আমনের চারা রোপণের ব্যস্ততা চলছে। আবার কোনো কোনো মাঠে চলছে পরিচর্যা। জমিতে সেচ দেওয়া শেষে কোদাল হাতে বাড়ি ফিরছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সনগাঁও গ্রামের কৃষক আবদুল মজিদ (৪৯)।

শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। বেজার মুখে আবদুল মজিদ বলেন, ‘আমনে খেতত (খেতে) সেচ দেওয়া নাগে না। কিন্তু এইবার পানি কম হইচে। সেচ দিয়া চারা নাগাবার যায়ে খরচ বাড়ি গেইচে। সার, ওষুধের দামও বাড়িছে। তেলখান বাদ যাবে ক্যানে, সেখানেও বাড়িল। খরচ যেমন বাড়িছে, ধানের দাম কি তেমন পামো? মনে হচে না। দাম না পাইলে আবাদ ছাড়ি দেওয়ার নাগিবে। তোমরা তখন ঠেলাখান বুঝিবেন।’

চলতি আমন মৌসুমের শুরুতেই বীজ ও সার বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে কৃষককে। সরকারি হিসাবে, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) টিএসপি সারের দাম ১ হাজার ১০০, ইউরিয়া ৮০০, ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ৮০০ ও এমওপির (মিউরেট অব পটাশ) দাম ৭৫০ টাকা। তবে নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দরে এসব সার বিক্রি হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার ১ আগস্ট থেকে ইউরিয়া সারের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু কৃষকদের ইউরিয়াসহ অন্য সব সার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লালাপুর গ্রামের কৃষক গোবিন্দ বর্মণ (৫৬) জমির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘একবার পানি দিবা গেইলে এক বিঘাত আড়াই লিটার ডিজেল নাগে। আগত ২০০ টাকার ডিজেল নাগিতো। আর এলা ২৮৫ টাকা নাগছে। আগে ট্রাক্টর দিয়ে এক বিঘা জমি চাষ দিতে ৫০০ টাকা দেওয়া নাগত। তেলের দাম বাড়ার পরে এলা নাগিছে ৮০০ টাকা।’

পাশে দাঁড়িয়ে গোবিন্দ বর্মনের কথা শুনছিলেন অশোক রায় (৫১)। তিনি বলেন, ‘মিথ্যা কহে লাভ নাই, হামাক সরকারি দামের বেশি দামে সার কিনিবা হচে। ওই হিসাব করিলে খরচ আরও বাড়িবে।এত খরচ করিয়া আর কৃষি করিবার সাহস হচেনি।’

কিছুদূর এগিয়ে শাহবাজপুর গ্রাম। চারদিকে সবুজ বাড়ন্ত ধানগাছ। সেখানে কৃষকেরা খেতে সারের পাশাপাশি সেচ দিতে ব্যস্ত। ব্যস্ততার ফাঁকে কৃষক হাফিজ উদ্দিন (৩৯) বলেন, ‘দেশের জন্য কৃষক খাটি মরিলেও কেউ হামার দিকে দেখে না। বীজ, সার, ওষুধ, তেল, মজুরি সবকিছুর দাম খালি বাড়িছে আর বাড়িছে।’

হাফিজ উদ্দিনের কথা কেড়ে নিয়ে সাদেকুল ইসলাম তেলের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করেন। সাদেকুল ইসলাম বলেন, সরকার ডিজেলের দাম কম রেখে পেট্রল আর অকটেনের দাম বাড়ালে কৃষির ওপর কোনো প্রভাব পড়ত না। খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ত না। কারণ, পেট্রল আর অকটেন তো ধনীদের তেল।

ঠাকুরগাঁও অধিকার সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ইন্দ্রনাথ রায় বলেন, জ্বালানি তেলের দাম অসহনীয় পর্যায়ে বেড়েছে। সরকারি নির্ধারিত দামেও সার পাওয়া যাচ্ছে না। সার ও জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আরও বেড়ে যাবে।