কোনো মনস্তাপ নেই

>অপূর্ব বাংলা লিখতেন বেলজিয়ামের নাগরিক ফাদার দ্যতিয়েন। সৃষ্টি করেছিলেন স্বকীয় এক গদ্যশৈলী। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। প্রয়াণের ঠিক আগে আগে নিজের সব বন্ধুর উদ্দেশে ইংরেজিতে দ্যতিয়েন লিখেছিলেন একটি চিঠি। তাতে ধরা আছে তাঁর জীবনদর্শন। ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সৌজন্যে পাওয়া সেই চিঠিটি অনুবাদ করেছেন শিবব্রত বর্মন

আমার অভিযাত্রার শেষ ধাপে আমি সবে প্রবেশ করেছি (কিংবা শেষের আগের ধাপে...কারণ যন্ত্রণার পর্ব এখনো শুরু হয়নি)।

ফাদার দ্যতিয়েন (৩০ ডিসেম্বর ১৯২৪—৩১ অক্টোবর
ফাদার দ্যতিয়েন (৩০ ডিসেম্বর ১৯২৪—৩১ অক্টোবর

সেইন্ট লুক হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, খুব দ্রুতই এই অভিযাত্রার অমোঘ পরিসমাপ্তি নেমে আসবে: ‘কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার...মাস গুনবেন না...কল্পনা করুন, আপনি টিকতে পারছেন নববর্ষ পর্যন্ত।’
সেদিন থেকে আজ অব্দি ১৪ জন সহকর্মীকে সমাহিত করেছি।
এখন আর ঘরের বাইরে বের হই না (এমনকি রোববারের প্রার্থনাতেও যেতে পারি না)। দিনের বেশির ভাগ সময় নিজের বিছানায় শুয়ে থাকি: ঘরের ভেতর যে কয়েক কদম জায়গা আছে, সেটা অতিক্রম করতেও হুইলচেয়ারের সহায়তা নিতে হয়।
যন্ত্রণা (এখনো) অনুভব করি না...এবং অলৌকিক ব্যাপার হলো, একটিবারের জন্যও একঘেয়েমি লাগছে না। সকাল থেকে রাত অবধি আমি প্রভুর সঙ্গ পাই, তাঁকে বারবার বলি, ‘আপনার সঙ্গ পেয়ে ভালো আছি।’
এর চেয়ে বেশি কী আর প্রার্থনা করা সম্ভব আমার পক্ষে?
এই কথার একটা প্রাসঙ্গিক ইতিহাস আছে। আমার জীবনে তাঁর একটা বিশেষ স্থান আছে। শার্ত্রের তীর্থে গিয়ে একবার সহতীর্থযাত্রীকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী বললে তিনি বেশি খুশি হবেন, ‘আপনি খুব সুন্দর!’ নাকি ‘আপনি খুব বুদ্ধিমতী!’ তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব, ‘সত্যি সত্যি আমাকে খুশি করতে চাইলে বলুন, “আপনার সঙ্গ পেয়ে আমি ভালো আছি।”’
বিদ্যুচ্চমকের মতো তক্ষুনি বুঝে গেলাম, ঈশ্বর স্বয়ং আমাকে এ কথা শোনাচ্ছেন। বুলেটের মতো বিঁধে গেল কথাটা।
অবাক করা ব্যাপার হলো, বিছানায় নির্ঘুম পড়ে থাকার পর্যায় শুরু হওয়ার পর থেকেই আমার কল্পনাগুলো উবে গেছে: পুরোদমে উবে গেছে...ভালো কী মন্দ, যা-ই হোক না কেন, চিন্তার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই, নেই বিভ্রমের লেশ, সব গায়েব...প্রভুর সঙ্গ পেয়ে আমি ভালো আছি।
তফাতটা বুঝে দেখুন। যখন বলছি আপনার বেড়াতে আসা, বা ফোন কল বা ই-মেইল পাওয়ার বাসনা আমার আর হয় না, তখন কিন্তু আমি এ কথা বলছি না যে সেগুলো আর পেতে চাই না।
আমি আসলে কেবল আশা করি, আপনার বেড়াতে আসা, ফোন কল বা ই-মেইল আপনার মনে আনন্দ বয়ে আনুক। বস্তুত আমার কামনা কেবল আপনি সুখী হোন...আপনার মতো করে, আমার উপস্থিতি অথবা অনুপস্থিতিতে।
এই সেদিন আমার দেহ দান করলাম বিজ্ঞানের উদ্দেশে...আশা করি, এ দেহ কোনো প্রতিষ্ঠানে গৃহীত হবে...এ আমার গভীর অন্তর্গত অভিলাষ, তবে আপনি খুব সহজেই এর প্রতীকী ব্যাপারটি অনুমান করে ফেলতে পারবেন।
আমি কি মৃত্যুকে ভয় পাই? আন্তরিকভাবে আর খুব স্পষ্ট করেই বলি: না। মৃত্যু আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছে...বহু বছর হয়ে গেল।
হিন্দুধর্ম আমাকে এক অমূল্য উপহার দিয়েছে, ভারতে রওনা দেওয়ার পরপরই আমার সংস্কৃত শিক্ষক ফাদার জোহান্স আমাকে স্বাগত জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘অনেক কিছু দেওয়ার থাকবে তোমার, নেওয়ারও থাকবে অনেক কিছু।’ আর সেটা কাউন্সিলের ১১ বছর আগের কথা।
ফাদার জোহান্স যাঁর কথা উল্লেখ করছিলেন, তা কেবল সাংস্কৃতিক বৈভবের প্রতি খোলামন নয় (যে কারও চোখে যা স্পষ্ট ধরা পড়ে), সেই সঙ্গে ধর্মীয় ঐশ্বর্যও, যেমন ঈশ্বরের মাতৃগুণ। মেরি হলেন ঈশ্বরের সেই মাতৃরূপের মানবীয় প্রতিমূর্তি, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ওল্ড টেস্টামেন্ট তার খুব একটা হদিস পায়নি, আমরাও বিরাট ধন্দে পড়েছি।
আমার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হিন্দুধর্মের ‘জীবন-মুক্ত’-এর ধারণা, মুক্ত মানুষের ধারণা। ধারণাটা আমি একটা রূপকের মধ্য দিয়ে বোঝাই।
প্রভু আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন একটা ছবি আঁকার জন্য। প্রতিদিন একটা করে রেখা যোগ করি আমি, একটা নতুন রঙের পোঁচ দিই...তারপর এক সকালে বিছানা ছেড়ে অনুধাবন করি, ছবিটা পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ফ্রা অ্যানজেলিকো বা পিকাসোর মতো হয়নি বটে, কিন্তু তবু পূর্ণ হয়েছে ছবিটা: একটা বাড়তি রেখাও যোগ করার নেই, দরকার নেই কোনো রং চড়ানোর।
আমার কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে প্রভু তাঁর স্বর্গের জাদুঘরে টাঙিয়ে রাখতে পারতেন...কিন্তু তিনি আরও কিছুদিন সেটা পৃথিবীতেই রেখে দেবেন বলে সাব্যস্ত করলেন...যাতে মর্ত্যের বাকি লোকেরা দেখে মনে করতে পারে, আমার মতো এক অভাগাও যদি পারে, তাহলে নিজের নিজের ছবিগুলো এঁকে ফেলার আনন্দ বাকিরাও পেতে পারে।
অসহায় এক মানবসন্তান হিসেবে এই যে এখনো বেঁচে আছি, তার এই-ই একমাত্র কারণ।
এই মুহূর্তে প্রভু এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারেন, প্রস্তুতির জন্য আমি তিন সেকেন্ডও চাইব না: প্রথম সংকেত পাওয়ামাত্র তাঁকে অনুসরণ করব, তল্পিতল্পা ছাড়াই।
আমি কি ঘুমের মধ্যে মারা যেতে চাই? শুনতে আকর্ষণীয় লাগে...তবে আমি প্রভুকে স্বাগত জানাতে চাই পরিপূর্ণ সচেতন অবস্থায়: ‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম।’ ঘুমের মধ্যে তা কি আর সম্ভব?
সাক্ষাৎ দিতে এসে আমাকে কী বলবেন ঈশ্বর? বলবেন, তোমার অগাধ শুভেচ্ছার জন্য তোমাকে অনন্ত ‘ধন্যবাদ’। শুভেচ্ছা পোষণেরই সামর্থ্যই শুধু আমার ছিল, গর্বের বলতে ছিল মাত্র ওটুকুই।
না, ভয় পেয়ো না, সিদ্ধান্ত আমি এখনো নিয়ে ফেলিনি...তবে সবার আগে যা বলে নিতে চাই, তা হলো: ‘কেউ যাতে মনে না করে, ও আমার জন্য যথেষ্ট করেনি।’
হ্যাঁ, জানি, অনেক পাদরি একপর্যায়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। আমার ঘটনা আলাদা। সেই প্রাথমিক স্কুলের প্রথম দিনটি থেকে আমি সন্দেহ পোষণ করে এসেছি আমার নিজের অস্তিত্বে। কাঁধে স্কুলব্যাগ চাপিয়ে সকালে বাসা থেকে বেরিয়েই আমি ভাবতাম, ‘আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।’ আমি আসলে স্বপ্নের মধ্যে ভাবছি আমি অস্তিত্বশীল (কোনো অধিবিদ্যাগত উদ্বেগ এটি নয়), তখন পাল্টা যুক্তি দিলাম, ‘আমি স্বপ্ন দেখছি, এ কথাটি বলা মানেই তো আগে আমাকে অস্তিত্বশীল হতে হবে...কিন্তু না, আমি স্বপ্নে দেখছি যে আমি অস্তিত্বশীল হয়ে ভাবছি, আমি স্বপ্নে দেখছি যে আমি অস্তিত্বশীল...’ তখন সব ছেড়েছুড়ে মার্বেল খেলতে চলে যাই।
এই বিভ্রমের অভিজ্ঞতা আমাকে কখনো ছেড়ে যায়নি; মাঝে মাঝে এই অভিজ্ঞতা হয়, এখনো হয়।
ব্যাপার হলো, ‘কোণঠাসা’ হয়ে নিজের অস্তিত্ব যখন মেনে নিতে বাধ্য হলাম, তখন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমার কাছে একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেল—আমি যদি হই, তবে হয়ে উঠতে পারি কেবল সেই অতিলৌকিকের বশবর্তী হয়ে।
পেশাগত জীবনে কি নিজেকে সফল মনে করি আমি? অত্যন্ত সীমিত একটি ক্ষেত্রে (বাংলা গদ্য) আমি অনন্য। আমার প্রথম নিবন্ধ, কারও মতামত না নিয়েই (৫৭ বছর আগে) সরাসরি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কলকাতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ। পত্রিকাটির সম্পাদক আমাকে লিখলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন আপনি।’
অনেকেই আমার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনি। তারা মনে করেছে, আমি কোনো ‘অচেনা’ বাঙালি লেখকের ছদ্মনাম। এখন আমার শৈলী সম্পর্কে বলা হয়, প্রাণবন্ত ছন্দোবদ্ধ ‘নিবিড়’ গদ্য।
আমার প্রথম বইটাই সবচেয়ে নামকরা পুরস্কার জিতেছিল, বাংলা ভাষার গঁকুর বলা যায় সে পুরস্কারটিকে। প্রতি দুই বছর অন্তর সেটা দেওয়া হয় অন্তর্বর্তী সময়ের সেরা বইটিকে (আমার ক্ষেত্রে সালটা ছিল ১৯৭১-১৯৭২)।
তারপর ১৯৭৭ সালে বেলজিয়াম আমাকে ক্রিস্তফ প্লানতিন পুরস্কার দিল। শুধু বিদেশের মাটিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বিশিষ্ট হয়ে ওঠা বেলজিয়ান নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ এ পুরস্কার।
আজ এর সবকিছুই নিরর্থক ‘খড়বিচালি’ বলে মনে হয়, জীবন-সায়াহ্নে নিজের লেখালেখিগুলোকে যেমন মনে হয়েছিল টমাস অ্যাকুইনাসের। তবু, ‘তাঁর নাম বড় পবিত্র!’

দ্রষ্টব্য
আমার শেষ দিককার নিবন্ধগুলো এখন নিয়মিত ছাপা হচ্ছে দেশ পত্রিকায়। আমাকে পাঠানো পাঠকদের ই-মেইল থেকে তার প্রতিধ্বনি পাই। অনুমান করি, হয় আমার মৃত্যুর আগে আগে, নয়তো ঠিক পরপর ছাপা হবে শেষ নিবন্ধটি।
কোনো মনস্তাপ পুষে রেখে বিদায় নিচ্ছি না আমি। যেসব শব্দ বা কর্মকাণ্ডে সাফল্যের ঘাটতি আছে, ব্যর্থতা আছে, যৎসামান্য দুবর্লতাও আছে; সেগুলো ভিন্ন রকম কিছু হলেই যে ভালো হতো, তা তো মনে হয় না। ‘ঈশ্বর লেখেন সোজাসাপ্টা, কিন্তু রগড়ের সঙ্গে’ (পর্তুগিজ ভাষায় বলে) ...অথবা সেইন্ট পল যেমনটা বলেছেন, ‘ঈশ্বরকে যারা ভালোবাসে, তাদের কাছে কল্যাণকর হয়ে ওঠে সবকিছু।’ সেইন্ট অগাস্টিনের জোরালো কলমে সেটা আরও বিপ্লবী ভঙ্গিতে বলা হয়েছে, এমনকি পাপও সাহায্য করে।
একটা কথা বারবার বলে যেতে চাই, পাপ ততটা গুরুতর নয়...যতটা গুরুতর পাপের বশে হৃদয় পাথর হয়ে যাওয়া।
৯৯ বার আপনি প্রলোভন পায়ে ঠেলেছেন,...কিন্তু হার মেনেছেন একটিমাত্র বার: আপনার কি মনে হয় আমাদের সদাশয় ক্ষমাশীল ঈশ্বরের কাছে দুর্বলতাজনিত এই পাপখানি বিশেষ গুরুত্ববহ?
না, আমাদের ধর্ম গুণের ধর্ম না। আমাদের একটাই গুণ, আর সেটাই প্রধান: ‘ঈশ্বরের প্রেমের অযাচিত উপহার মন উজাড় করে গ্রহণ করো।’
মুক্তভাবে সৃষ্টি হওয়া প্রতিটি মানুষ (আপনি-আমিসহ) এই অযাচিত উপহার পায়ে ঠেলার সামর্থ্য রাখে।
সেটা পায়ে ঠেলাই যে নরক।
আর তারপর? হিটলারের কথা যখন ভাবি, তাকে প্রথম কমিউনিয়নের পোশাকে ভাবি, ভাবি মোমবাতি আর ধর্মগ্রন্থ হাতে সেই ছবিটার কথা...মনে পড়ে যায়, স্তালিন ছিলেন অর্থোডক্স চার্চের এক শিক্ষার্থী।
আমি এখন চিকিৎসা-উপকরণের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল...অন্তিম দশা পর্যন্ত এই খেলাটা খেলে যাব বলে ঠিক করেছি। আমি চাই, ওরা আমাকে ভীষণ অনুগত, মনোযোগী রোগী হিসেবে মনে রাখুক...যদিও জানি, এই রোগ আমাকে সহজেই বিরক্তিকর করে তুলছে।
সাহস পাই সেইন্ট পলের বাণী থেকে, ‘তোমাদের চেয়ে অন্য সবাইকে শ্রেয়তর গণ্য কোরো।’ সমস্যার অবলুপ্তিতেই তার সমাধান।