এশীয় প্রদর্শনী এশীয় থাকবে না?

দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম দেখছেন এক দর্শক। মাসব্যাপী এ প্রদর্শনী শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর। ছবি: খালেদ সরকার
দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম দেখছেন এক দর্শক। মাসব্যাপী এ প্রদর্শনী শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর। ছবি: খালেদ সরকার

সপ্তদশবারের মতো মাসব্যাপী দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর দ্বার উন্মোচন হয়ে গেল পয়লা ডিসেম্বর। এশীয় দৃশ্যকলার এটি সম্ভবত প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম আয়োজন। এ দেশের নবীন কলাশিল্পীরা অংশ নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের দৃশ্যকলাচর্চার বিবিধ বিচিত্র উদাহরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আশায় এ প্রদর্শনীটির জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করে থাকেন। এশিয়ার অন্য কোনো দেশে এত বৃহৎ পরিসরে এশীয় শিল্পের প্রদর্শনীর আয়োজন হয় বলে আমাদের জানা নেই। তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে এ প্রদর্শনীর তেমন কোনো স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। অনেক পরে শুরু হয়েও দুবাই, বেইজিং বা এ মহাদেশেরই আরও কিছু কিছু আয়োজন বিশ্বপরিসরে মর্যাদার আসন পেয়ে গেছে। আমরা সেটি অর্জন করিনি, করার তেমন প্রয়াসও লক্ষণীয় নয়।

‘শিরোনামহীন’, শিল্পী: মূসা ওমর, ওমান
‘শিরোনামহীন’, শিল্পী: মূসা ওমর, ওমান

এর একটি মূল কারণ প্রদর্শনীটির শিল্পকর্মের উৎকর্ষের চেয়েও আমাদের আকর্ষণ বরাবরই নিবদ্ধ রয়েছে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে, অর্থাৎ উচ্চতায় বাড়ানোর প্রচেষ্টার বদলে প্রস্থে স্ফীত হওয়ার দিকেই আমাদের আকাঙ্ক্ষা বেশি দেখা গেছে। ফলে ৩৫ বছর ধরে নিয়মিত আয়োজনের কৃতিত্ব সত্ত্বেও উৎকর্ষের বিচারে আমাদের এ আয়োজন কতটা, বা আদৌ সামনে এগিয়েছে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ রয়ে গেছে।
এবারের প্রদর্শনীটিতে সর্বাধিক ৫৪টি দেশের ২৩০টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। এর প্রায় আধাআধি, ২৪টি দেশ অ-এশীয়। এতে ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাও রয়েছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ইউরোপ এবং দুই আমেরিকার অধিকাংশ শিল্পকর্ম তাদের সমকালীন দৃশ্যকলা চর্চার কোনো পরিচয় বহন করে না। সম্ভবত প্রদর্শিত ভিনদেশি শিল্পকর্মগুলোর সিংহভাগ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচনের মাধ্যমে আসেনি, চেয়েচিন্তে বা ব্যক্তিগত যোগাযোগে সংগ্রহ করা হয়েছে। ফলে ইতালি বা ফ্রান্সের মতো সমকালীন শিল্পে অগ্রবর্তী দেশের শিল্পনমুনা দেখে যদি কেউ ভড়কে যান তাঁকে দোষ দেওয়া সমীচীন হবে না।
এমনটি বলা যায় যে এবারের আয়োজনটির মুখ রক্ষা করেছে অল্প কয়েকটি দেশের তুলনামূলক উন্নত শিল্পনিদর্শন। অস্ট্রেলিয়া (একে এশিয়ার অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে), জাপান, কুয়েত, ওমান, দক্ষিণ কোরিয়া আর প্রায় অচেনা রিইউনিয়ন আইল্যান্ড এদের অন্যতম। তবে জাপান, কোরিয়া আর অস্ট্রেলিয়ার আগ্রহ আগের চেয়ে কমে আসছে বলে ধারণা করি। মোটামুটি মানসম্পন্ন কাজ এসেছে কানাডা, চীন, উত্তর কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, ভারত, ইরান, রাশিয়া, সৌদি আরব ও ভিয়েতনাম থেকে। তবে এ কথাটি জোর দিয়েই বলতে হবে যে সংখ্যায় স্বল্প হলেও এ প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ বাংলাদেশের কিছু নবীন শিল্পচর্চাকারীর দৃশ্যকলার বহু বিচিত্র মাধ্যমে করা আগ্রহোদ্দীপক শিল্পকর্মগুলো। কিন্তু সঙ্গে এ-ও উল্লেখ করা দরকার যে একটি প্রদর্শনীতে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি যদি হয় স্বাগতিক দেশের শিল্পকর্ম, এবং তার একটি বৃহৎ অংশ অনুল্লেখযোগ্য, তবে সেটিকে মহাদেশীয় বা আন্তর্জাতিক আখ্যা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অংশগ্রহণকারী বাদবাকি ৩৮টি দেশও তথৈবচ, দেশের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া তারা আর কোনো অবদান রাখেনি।

‘শিরোনামহীন’, শিল্পী: সাবিনা হোসেইন, রাশিয়া
‘শিরোনামহীন’, শিল্পী: সাবিনা হোসেইন, রাশিয়া

বাংলাদেশের একক প্রাধান্যের কারণে প্রদর্শনীটি মোটামুটি বাংলাদেশি একটি আবহ অর্জন করেছে। এতে বাংলাদেশের প্রীত হওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং এর বহুজাতিক চরিত্র ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এর এশীয় পরিচয় বিনষ্ট করে একে একটি আন্তর্জাতিক জগাখিচুড়ি বানানোর পথে অগ্রসর হয়ে যেটি ইতিমধ্যেই খানিকটা অর্জিত হয়ে গেছে। পুরস্কারের তালিকাটির দিকে তাকালেই এর সত্যতা প্রতিভাত—মোট নয়টি পুরস্কারের আটটিই বাংলাদেশের। এ তথ্য একটি মহাদেশীয় প্রদর্শনীর জন্য গৌরবের নয়।
পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক ও অসন্তোষ বরাবরই থাকে, সে কারণে এ বিষয়ে কম কথা বলাই শ্রেয়। তবু বলতে হয় যে সাঁওতাল ঘটনা নিয়ে সোমা সুরভি জান্নাতের প্যানেল-চিত্রকর্মটি এ প্রদর্শনীর অন্যতম সেরা একটি উপস্থাপন, পুরস্কার এর প্রাপ্য ছিল। আমিরুল মোমেনিন চৌধুরী দীর্ঘকাল ধরে কাঠখোদাই মাধ্যমে বড় আকারের ছাপচিত্র করে চলেছেন, শিল্পকর্মে এ দেশীয় একটি নিজস্ব গল্পের বয়ান ও রূপবন্ধ তিনি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের গতানুগতিক শিল্পরুচিতে এ শিল্পী নজরে আসেন না, এঁকে স্বীকৃতি জানানোর কথা ভাবা যেত বৈকি। সম্মানসূচক কয়েকটি পুরস্কার একটু বিস্মিত করে। বরং বিবেচনায় আসতে পারত জাপানি চিত্রকর তামানা মোতেকির অপূর্ব তেলরং চিত্রটি। এ ছাড়া ওমানের মূসা ওমর ও কুয়েতের মোহাম্মদ আলি আল শিবানির চিত্রকর্ম এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বসুক লির স্থাপনাকর্মও বিবেচনার যোগ্য ছিল। বাংলাদেশের আর যাঁদের শিল্পকর্ম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তাঁদের মধ্যে ফারজানা আহমেদ ঊর্মি, মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম, আশরাফুল হাসান, রিয়াদ মাহমুদ, যুবরাজ, তাসাদ্দুক হোসেন দুলু প্রমুখের নাম উল্লেখ করা চলে। পারফরম্যান্স ও ভিডিও উপস্থাপনা ছিল বেশ কিছু। আমার প্রদর্শনী-পরিক্রমাকালে অধিকাংশ ভিডিও ছিল বন্ধ, কোনো নিয়মের কারণে নাকি আমাদের বিদ্যুৎ-অনিশ্চয়তার বলি হয়ে—জানতে পারিনি। পারফরম্যান্স দেখার সুযোগও হয়নি, শিল্পীরা কোনো নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে তাঁদের শিল্পরূপ উপস্থাপন করেন কি না সেটিও বোঝা গেল না। ফলে দৃশ্যকলার এ দুটি সাম্প্রতিকতম প্রকাশ-মাধ্যমে সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে মতামত প্রকাশের সুযোগ হলো না।

আমন্ত্রিত অতিথি বিভাগে বাংলাদেশের শিল্পীর তালিকা গতানুগতিক। কিছু শিল্পীর উপস্থিতি যেমন বিস্ময়ের, কিছু অনুপস্থিতিও প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথি শিল্পীরা সবাই সমান যোগ্যতায় আমন্ত্রিত কি না, এ ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হওয়ার অবকাশ আছে। দেশ-ভিত্তিতে শিল্পকর্ম প্রদর্শনের যে চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে সেটি বাদ দিয়ে দৃশ্য-সমতা বা অনুরূপ বিবেচনায় যেটি করা হয়েছে সেটি উন্নততর হলো কি না, এখনই বলা কঠিন; হয়তো ভবিষ্যতে দৃশ্যকলা প্রদর্শনে বিশেষজ্ঞ কারও সাহায্য নিয়ে এটিকে যথাযথ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিক এশীয় দৃশ্যকলার এ আয়োজনটি এখনো আমাদের সম্পদ। একে নিয়ে গর্ব করারও কিছু আছে। এর সূচনাটি ছিল চমৎকার। মনে আছে প্রথম কয়েকটি প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া দেশের সংখ্যা কম হলেও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারত একে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল এবং সমকালীন সেরা শিল্পকর্মসহ অংশ নিয়েছিল। তুরস্ক, ইরাক, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াও বলার মতো শিল্পকর্ম নিয়ে উপস্থিত থাকত। এর কারণ বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিক এ আয়োজনটি এশীয় দৃশ্যকলা উপস্থাপনের একটি বিশিষ্ট মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছিল। পরবর্তীকালে ক্রমে ক্রমে এর এশীয় স্বকীয়তা খর্ব করে একে তাৎপর্যহীন বৈশ্বিক জগাখিচুড়িতে পরিণত করার দিকে আগ্রহ বৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিকভাবেই এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হওয়া অন্যান্য প্রদর্শনীগুলোর প্রতি এশীয় দেশসগুলোর আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং এখানে তাদের অংশগ্রহণ এখন নামমাত্র।

এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। আমরা যদি কঠোরভাবে এর এশীয় চরিত্রটিকে ফিরিয়ে আনি, আর ৫০-৬০টি দেশের জন্য হাহাকার না করে এমনকি মাত্র ২০টি এশীয় দেশের সমসাময়িক দৃশ্যকলা জগতের যথাযথভাবে নির্বাচিত এক শটি শিল্পকর্ম আনতে পারি, এর সঙ্গে যোগ করতে পারি বাংলাদেশি নির্বাচিত বা আমন্ত্রিত সমসাময়িক বিগত দুই বছরের সেরা ৫০টি শিল্পকর্ম, তবে সেটুকু দিয়েই এ আয়োজন তার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে, বিশ্বশিল্প-দরবারেও পেতে পারে পরিচিতি। আবার যেভাবে চলছে সেভাবেও চলতে পারে—তাৎপর্যহীনভাবে অনেক কিছুই তো চলছে, সেটি যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁদের বিবেচনা।