আঁধারের কাব্যকথা

কালো রঙে অঙ্কিত সাদা-কালো চিত্রে বস্তু ও বিষয়ের ভাব আবেদন প্রকাশে কমতি হয় কি? হয়তো হয় না। সাদা-কালো চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এমনটি বলা যায়। যেমন সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি।
চলচ্চিত্র কিংবা চিত্রকলার দৃশ্য যখন সাদা-কালোয় (আলোছায়া) ফুটে ওঠে, তখন সে দৃশ্যের ভাব আবেদন বুঝতে বহু রঙের প্রতীক্ষায় থাকে না মন। অবশ্য দর্শকের গ্রহণ করার অন্তর্দৃষ্টি থাকতে হয়। শিল্পীর কল্পনা বোঝার জন্য অথবা নিজের কল্পনায় রসাস্বাদন করতে দর্শককেও কল্পনায় ভাসতে হয়। দর্শকের কল্পনা শিল্পীর কল্পনার ভাষা, রং, গড়ন, দৃশ্য, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার সঙ্গে এক না-ও হতে পারে। তবে দর্শক যদি নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে গল্প তৈরি করতে পারেন, তবে সেটা সৃষ্টির অন্যতম গুণ বলা যায়। কথাগুলো বলা হলো রাশেদুল হুদার ‘অন্ধকারের কাব্য’ শিরোনামের চিত্রকলা প্রদর্শনীর সূত্র ধরে। এই শিল্পী নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক। আলোছায়া অন্ধকারের যে রহস্যময়তা খেলা করে প্রকৃতিতে, তার ভেতরের সৌন্দর্য আপ্লুত করে তাঁকে। আলো ও অন্ধকারের মায়ার ভেতরেই জীবনের রং খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা তাঁর।
শিল্পী গল্প তৈরি করেন স্বপ্নের মতো। সন্ধ্যায় নেমে আসা অন্ধকারের পরতে পরতে যে দৃশ্যকল্প রচিত হয়, সেখানেও শিল্পী তাঁর জীবনের অর্থ খোঁজেন। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ কিংবা প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় ভিন্ন ভিন্ন আলো যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ তৈরি করে, পরিবর্তন করে ভাব আবেদনের—তা কি শিল্পী ফোটাতে চান না চিত্রকর্মে? হ্যাঁ, তাঁর দৃষ্টি উৎসরিত কোনো আলোক রাশির প্রত্যাশায়। যেখানে উত্তাপ আছে, আছে নতুন গল্প, নতুন পথ, রঙিন স্বপ্ন আর প্রত্যাশা।
‘অন্ধকারের কাব্য’ রাশেদুল হুদার চতুর্থ একক প্রদর্শনী। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এ প্রদর্শনীতে গ্যালারিজুড়ে ছবি আছে ৩৬টি। এর মধ্যে ৩৩টি ছবিই ‘অন্ধকারের কাব্য’ সিরিজের। নিকষ কালো, নিম কালো, কৃষ্ণ কালো, তমসা কালো—এখানে কালোর আছে নানা ‘গ্রেড’। আছে উছলে পড়া শুভ্র সাদাও। আর কোমল, নমনীয়, তীব্র কালোর নানান চাল। কালোর মধ্যে সাদা অন্ধকারে উৎসারিত আলোর মতো তীব্র প্রতাপে প্রত্যাশা আর আশার আলো দেখাচ্ছে যেনবা।
গভীর অন্ধকার, প্রগাঢ় অন্ধকার, তরল অন্ধকার, তিমির অন্ধকার—এমনভাবে বিচিত্র আঁধারের রূপ-রহস্য তথাকথিত আধা বিমূর্ত ধারার ছবি এঁকেছেন শিল্পী। ছবিগুলো আধা বিমূর্ত ধারায় হলেও দর্শক চাইলে খুঁজে পেতে পারেন সমুদ্রসৈকত, বালুচর, দিগন্ত সীমানায় বাড়িঘর, নদীর ঢেউ, গ্রাম, বদ্ধ জানালা, চাঁদের আলো, ভূ-প্রকৃতির নানা রূপ; যার গড়ন প্রকৃতির অভিজ্ঞতা থেকে নিয়েছেন রাশেদুল।
নানান টেক্সচারের হ্যান্ডমেড কাগজের সঙ্গে অ্যাক্রিলিক রঙের কালো গ্রেডেশনে সৃষ্টি হয়েছে বস্তু কিংবা দৃশ্যের রহস্যময়তা। কালো রং দিয়ে সব রঙের আবেদন সৃষ্টি করতে চান শিল্পী। তাঁর কালো-সাদার চিত্রমালা এত নান্দনিক যে গাঢ় অন্ধকারের ফাঁকে উৎসারিত আলো অমাবস্যার অন্ধকারের আকাশের চাঁদের আলোর মতোই হাতছানি দেয়। এ আলো আশা ও স্বপ্নজাগানিয়া। এ আলো তৈরি করে জাদুকরী মায়া। স্বপ্ন দেখায়, আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। সত্য সুন্দর আলোর পথে ইশারা দেয় মনকে। ‘অন্ধকারের কাব্য’ সিরিজের বাইরে অন্য যে তিনটি ছবি আছে প্রদর্শনীতে, সেগুলো ‘বিষণ্ন জানালা’ সিরিজের অন্তর্গত। সমাজের অসুস্থ পরিবেশের ইঙ্গিত আছে এসব চিত্রে। ৭ মার্চ শেষ হয়েছে এই প্রদর্শনী।