ছবি যেন বিমূর্ত কবিতা

‘শিরোনামহীন–৪’, শিল্পী: মোহাম্মদ ইউনুস
‘শিরোনামহীন–৪’, শিল্পী: মোহাম্মদ ইউনুস

প্রকৃতিকে বিষয় করে ছবি আঁকেন না এমন শিল্পী বিরল, অন্তত আমাদের দেশে। এখানে একজনের কাজের ধরন ও করণকৌশলের সঙ্গে দৃশ্যত অন্যদের কিছু বিষয়ের সাদৃশ্য ঘটা বিচিত্র নয়। মোহাম্মদ ইউনুস এ বিষয়ে সচেতন থেকে দীর্ঘকাল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের চিত্রভাষা ও প্রকরণ নির্মাণ করেছেন। প্রকৃতির অন্তর্গত রূপ, তার অভিব্যক্তিকে সংগীতের লয়ে কবিতার মতো বিমূর্তভাবে তুলে ধরেন তিনি। প্রকৃতিকে অবগাহন করে শিল্পী তাঁর সৌন্দর্য-চেতনাকে এবার অনুবাদ করেছেন বিচিত্রভাবে। ফলে তাঁর অন্তর্চোখের আলোয় অন্য এক প্রকৃতির বহুরূপী চিত্রণ দেখা গেল; দেখলাম গুলশান লেকসংলগ্ন ‘এজ গ্যালারি’তে, ‘বিমূর্ত সম্পর্ক’ নামে তাঁর একক প্রদর্শনীতে।

বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের একজন বিমূর্ত ধারার চিত্রকর ইউনুসের শিল্প-অভিযাত্রার সূচনা গত শতকের সত্তর দশকে। ছয় বছর পর আয়োজিত হলো এই শিল্পীর একক প্রদর্শনী। ১৯৭৯-তে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার গুলশানে, ‘সাজু আর্ট গ্যালারি’তে। দেশে-বিদেশে তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছে ৪০টি। এটি ৪১তম। সাম্প্রতিককালে আঁকা শিল্পীর অর্ধশতাধিক চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে।

মোহাম্মদ ইউনুসের কাজের ধরনের সঙ্গে আমরা ঐক্য অনুভব করি চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের শিল্পী জ্যাকসন পোলক, মার্ক রথকো, উইলিয়াম ডি কুনিং প্রমুখের। এমনকি এ দেশের মোহাম্মদ কিবরিয়া, মাহমুদুল হক, মনিরুল ইসলামের বিমূর্ত প্রকাশবাদী চিত্রকলার সঙ্গে একধরনের অন্ত্যমিল যে নেই, সেটিও বলা যাবে না। তবে ইউনুস সে প্রভাবের জায়গা নিজ গুণে ও দীর্ঘ পরীক্ষায় অতিক্রম করেছেন। তাঁর মতে, শিল্পসৃজন একধরনের গবেষণা। এ ঠিক নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রা নয়; বরং যাত্রাপথে নতুন কিছু অনুসন্ধান কিংবা আবিষ্কারের চেষ্টা। নতুন এ চেষ্টার প্রমাণস্বরূপই হয়তো শিল্পীর চিত্রপটে আবির্ভাব ঘটে অনেকগুলো বর্ণ পর্দার। একেকটি বর্ণ পর্দার পরতে পরতে যে রং থাকে, তার কোনো কোনো অংশ ক্রমান্বয়ে স্বচ্ছ হয়ে উঠে আসে চিত্রের উপরিভাগে। ফলে নানা বর্ণ পর্দার মিথস্ত্রিয়ায় দৃষ্টিনন্দন রূপ পরিগ্রহ করে অনন্য হয়ে ওঠে তাঁর ছবি। ‘দেয়ালের গল্প’ সিরিজের কাজে তাঁর এই বিশেষ কৌশলের প্রয়োগ দেখা যায়। একটি দেয়াল প্রথমে পরিচ্ছন্ন থাকে, পরে সময়ের পরিবর্তনে প্রাকৃতিকভাবে এটি যেমন বদলে যেতে থাকে, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও বদলে যায় এর অবয়ব। ছবিতে এই বদল-প্রক্রিয়াকেই নন্দিতভাবে তুলে ধরেছেন ইউনুস।

কালো, ধূসর, ছাই যেন ইউনুসের নিজের রং। এসব রং পাওয়া যায় আমাদের কাদামাটি, খড়ির চুলা থেকে শুরু করে নদীতীরের বালুর মধ্যে। আলোচ্য প্রদর্শনীতে এ রংগুলো নিয়ে বিস্তর নিরীক্ষা করেছেন শিল্পী। ফলে দেখতে পাই, নিজের জন্মশহর ঠাকুরগাঁওয়ের মাটি ও প্রকৃতির রং যেন নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছে তাঁর ক্যানভাসে। ২০১৫ সালে আঁকা ‘ডার্ক ইমেজ’ নামের ছবিতে ধূসর বর্ণের মায়াময় আবহ তৈরি করেছেন তিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামাঞ্চলের মাটির ঘর, কৃষকের খননযন্ত্রের ইমেজ ও টেক্সচার তুলে এনেছেন চিত্রপটে।

তাঁর কতগুলো ছবিতে শিশুদের আঁকা ছবির অঙ্কন বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই আমরা। ‘অসহজ অবসর’ শিরোনামে ছবিতে নীলাভ ধূসর আবহে আঁকা এক নদীবক্ষে পাঁচটি নৌকার ছবি এঁকেছেন ইউনুস, শিশু আঁকিয়ের সরলতায়। ‘গ্রীষ্ম’ নামের সিরিজচিত্রেও শিশু চিত্রকলার অঙ্কনশৈলী বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে শিল্পীর স্বীকারোক্তি, ‘শিশুদের সরল অঙ্কন আমাকে আকৃষ্ট করে। এ জন্য সচেতনভাবে শিশুদের আঁকার ধরনকে শিশুর সারল্যেই ছবিতে তুলে ধরতে চাই।’

এবারের প্রদর্শনীতে বড় আকারের কয়েকটি ক্যানভাসে অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল রং ও টেক্সচার এঁকেছেন ইউনুস। এগুলো দৃষ্টিনন্দনও হয়েছে বটে। এই ধারার একটি কাজের শিরোনাম ‘কসমোপলিটন রেড’। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা এ ছবি চিন্তার খোরাক জোগায়। এ ছাড়া প্রদর্শনীর ছবিগুলো শিল্পী এঁকেছেন তেল রং ও মিশ্র রঙে। আবার ছাপচিত্রীদের অঙ্কনশৈলীও প্রয়োগ করা হয়েছে এখানে। তাই স্বভাবতই বেশ বৈচিত্র্যের খোঁজ পাওয়া যায় ‘বিমূর্ত সম্পর্ক’তে। নিজের ছবি সম্পর্কে মোহাম্মদ ইউনুসের কথা, ‘আমার কাজ প্রকৃতির ভেতরের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করা। শিল্পীমনের আধ্যাত্মিক অনুভূতির সংমিশ্রণে রং-রেখা-টেক্সচার নিয়ে আমার আঁকা; যা মনের ক্ষুধা মেটায়, ধ্রুপদি সংগীতের মতো শরীর-মনকে আন্দোলিত করে, আবার স্পর্শ করে হৃদয়কেও।’

১৮ মার্চ শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত।