মারিয়া পালমা

বুড়িকে দেখে হঠাৎ অদ্ভুত কাঁপুনি অনুভব করে গনজালেস। অনেক বছর আগে কর্ণফুলীর পলির নিচে তলিয়ে যাওয়া জাহাজটির কথা মনে পড়ল। জাহাজটির কথা বাবাই বলেছিলেন। বাবা শুনেছিলেন, জাহাজে এক তরুণী থাকত। তার নাম মারিয়া পালমা। চোখ দুটো হরিণের চোখের মতো। পর্তুগিজ নাবিকের বউ নাকি রক্ষিতা ছিল, ভুলেই গেছে। মেয়েটা কারণ ছাড়াই হাসত। তার চাহনি দেখে নাবিকেরা ফুর্তিতে গান গাইত। বাবার বর্ণনার সঙ্গে বুড়ির চেহারা মিলে যাচ্ছে।

জাহাজে লুট হওয়া মানুষ। হাতের তালু ভেদ করে ঢুকে গেছে রশি। তাদের আর্তচিৎকার আর কান্নায় গুমোট হয়ে থাকত জাহাজের খোল। নাবিকেরা মাতলামি করত আর বন্দীদের দিকে তাকিয়ে বমি করার ভাব দেখাত। তাদের বিক্রি করে দেওয়ার পর নামত মৃত্যুপুরীর নীরবতা।

জাহাজটির কথা বাবাকে বলেছিলেন তাঁর বন্ধু হাসিম চাচা। তিনিও নাবিক ছিলেন। বছরে ছয় মাস, নয় মাস সাগরেই কাটাতেন। বলতেন, মেয়েটা সাংঘাতিক। চোখের তারায় যেকোনো পুরুষকে নাচাতে পারে।

গোমেজ বারবার বলেছিল, সোনাদিয়া চল। সোনাদিয়া গেলে জোছনা রঙের হরিণ দেখতে পারবি। পূর্ণিমা রাতে এসব হরিণ নাচে।

গত বছর সোনাদিয়া দ্বীপে গিয়েছিল। চিংড়িঘেরের পাশে ছোট রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েক ঢোক বাংলা মদ খেয়েছিল। তাতেই বুঝি জ্বলে গিয়েছিল গলা। ঝাঁজ কমাতে একটার পর একটা ঘের, কেটে ফেলা কেওড়াগাছের গোড়া, সিগন্যালের কারণে গোঁ গোঁ বয়ে যাওয়া বাতাসের দিকে তাকিয়েছিল। ভেবেছিল, এখানে যদি কেওড়ার ব্যারিকেড থাকত, হরিণ, বানর কিংবা একটা-দুটো বাঘও থাকত, পরিস্থিতি পাল্টে যেত। হয়তো তাদের আসা হতো না; পথ হারিয়ে পুব ও পশ্চিমপাড়ায় চরকির মতো ঘুরতেও হতো না।

সমুদ্রে লাখ লাখ বাঘ-সিংহ লুকিয়ে থাকে। সেবার প্রথম দেখেছিল। ৮ নম্বর সিগন্যালের কথা তাদের জানা ছিল না। সাগরের কাছে গিয়ে দেখে, ঢেউয়ের আগায় দাঁড়িয়ে বাঘ ও সিংহগুলো গর্জন করছে।

একটু আগে ঘেরে দোনলা বন্দুকের পাশে বসে ভাত খেয়েছিল। খাওয়ার সময় মাছের ডেকচির দিকে একঝলক চোখ পড়ে। ঝোলের রং রক্তের মতো। মনে হলো বউয়ের চোখ। প্রেমিকা গুইনতারার কথা জানার পর ওর চোখ এমন লাল হয়েছিল।

পরদিন সকালে অদূরে সাগরের মাঝে দেখেছিল একটা চর। যেন পথ ভুলে দাঁড়িয়ে পড়া তরুণী। চর দেখে মনে পড়েছিল জাহাজটির কথা। আজও মনে পড়ল। বাবা বলেছিলেন, কর্ণফুলীর পলির নিচে আছে জাহাজটা। হয়তো সেটা চাটগাঁর বন্দরে ভেড়া জোয়া দা সিলভেইরার লুপু সোয়ানের মতো জাহাজ।

গনজালেস দেখল, বুড়ির চোখের তারায় জাহাজটা দোল খাচ্ছে।

এখন সন্ধ্যা। চেরাগী পাহাড়ে বিদ্যুতের চেরাগ জ্বলছে। কয়েকটা গাঁদা ফুটেছে। কামিনীর ঝাড়, ঝাউ আর ডিজেলগাছের পাতায় সন্ধ্যার ছায়া।

এখানেই তো প্রথম চেরাগ জ্বালিয়েছিলেন বদর শাহ। চেরাগের আলো কি মেয়েটার চোখে পড়েছিল?

বুড়ি হাত বাড়িয়ে দলা-মোচড়া হয়ে বসে আছে। সামনে মিষ্টির দোকান। লোকজন ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। বেশির ভাগের চোখ-মুখ ভাবলেশহীন।

গনজালেস তাদের দেখে, এলোমেলো ফুটপাত ও সড়ক দেখে। ফুটপাতগুলো দখলে। সড়কের অবস্থা আরও খারাপ। সে মুচকি হাসে। হাসিতে ব্যঙ্গ।

ভাবে, যেসব জলদস্যু তাদের পূর্বপুরুষের দেশ থেকে এসেছিল, মানুষের মনে তারা এখনো রয়ে গেছে। একটা লোক সাদা কার দাঁড় করাল রাস্তার মাঝখানে। যেন এটা মগের মুলুক। মগের মুলুকই তো ছিল।

বাসা থেকে এসেছে একটু আগে। চুরিয়ালটুলী লেন দিয়ে হেঁটে আসার সময় দেখে, বিল্ডিংয়ের ছাদে কয়েকজন কিশোর শরতের আকাশে হলুদ ও নীল ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়িগুলো কেড়ে নিতে ইচ্ছে হয়েছিল।

গনজালেস আবার তাকাল বুড়ির দিকে। আকাশের দিকেও একবার তাকাল। অনেক কথা মনে পড়তে চাইছে। জিজ্ঞেস করল, একে চিনিস?

জেমস গোমেজ চোখ কচলে তাকাল। বুড়ির মুখে মৃদু হাসি। দাঁতে গাবের কষ। ওপরের পাটির দুটো দাঁত পোকায় খাওয়া।

মগদের ঘোড়দৌড়ে আসা ও হিংস্রতার কথা মনে পড়ল গনজালেসের। চট্টগ্রাম গিলে খাবে এমন সংকল্প নিয়ে আসত তারা। তরুণী বন্দরে নেমেছিল সদাই করতে। এক মগ সেনাপতির চোখে পড়েছিল। মেয়েটার চোখ দেখে ভালো লাগায় তাকে তুলে নিয়েছিল।

কিছুদিন পরের কথা। সাগরে একটি জাহাজে মুখোমুখি বসেছে সেনাপতি ও গনজালেস। তারা পান করছিল। ওই সময় গনজালেস মেয়েটাকে দেখে। চোখের তারায় বিদ্যুতের ঝিলিক। মেয়েটাকে ও চায়। বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ সেনাপতি তাকে দিয়ে দেয়।

একবার জাহাজে তোলা বন্দীদের হাতের তালু ফুটো করে রশি ঢোকানো হচ্ছিল। একেকজনের আর্তচিৎকারে জাহাজের খোল ফেটে যাওয়ার দশা। গনজালেস মেয়েটাকে দেখাতে নিয়ে যায়। যেন তার ভেতর হিংস্রতা জেগে ওঠে।

এক বন্দীর লুঙ্গির কোঁচা খুলে পড়ে যাওয়া গাঢ় খয়েরি রঙের একটা ফল দেখে মেয়েটা। রং দেখে তার খেতে ইচ্ছে করে। ওটা ছিল গাব। সে সুস্বাদু ফলটা খায় এবং দাঁতে কষ লাগে। সেই কষ নাকি যায়নি।

গনজালেস একটা কাজে শুলকবহর যায়। বান্দরবান থেকে আসা তুলায় এখানে নদীর পাড় ভর্তি থাকত। সে তুলার গন্ধ পায়। তখন কারও কাছ থেকে কিছু কেড়ে নেওয়ার ইচ্ছাটা আরও বাড়ে।

পাথরঘাটায় তাদের বাড়ির ছোট্ট উঠানে একটা নারকেলগাছ আছে। পাতার সরসর আওয়াজে মনে হয় জাহাজ চলছে। প্রতিদিন এভাবে তার ঘুম আসে। আজ এল অনেক রাতে। স্বপ্নে দেখে একটা জাহাজ। পাল তোলার লম্বা গাছটিতে হেলান দিয়ে সাগরের ঢেউ দেখছে। বুড়ি এগিয়ে আসে। বলে, আমার ছেলে প্যারালাইজড। তার বউ বাসায় কাজ করে। আমার দুই নাতি। কিছু সাহায্য করেন।

তোমার নাম কী?

বুড়ি মুচকি হাসে। তার চোখ দেখে গনজালেস আশ্চর্য হয়।

গনজালেসের গম্ভীর মুখ দেখে বুড়ি বলে, এক বলী আমাকে বলেছিল, মানুষ যখন হাসে, তার হাসিতে জন্ম হয় গাছের। ওই গাছ থেকে পাওয়া যায় নির্মল বাতাস। বাতাসে মানুষের মন মমতায় ভরে ওঠে।

পরদিন একই জায়গায় আবার দেখা। সে দশটা টাকা দেয়। বুড়ি খুশি হয়ে হাসে। এই হাসি সে দেখেছে! শুনেছে, তখন ও ছিল রানির মতো। এলোকেশী মেয়ে, ঠোঁটের রেখায় ছিল সমুদ্রের ঢেউ।

বুড়ির গায়ে পুরোনো জাহাজের গন্ধ। ডান গোড়ালির ওপর দাউদ। একটু আগে চুলকেছে মনে হয়। রস গড়িয়ে পড়ছে।

বুড়ি থাকে বগার বিলে। এই সেই বিল, এখানে থাকত হাজার হাজার হলুদ, লাল ও সাদা বক। বকগুলো শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। ভুলে যায় কেন দাঁড়িয়ে আছে। একসময় ডানা মেলে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম আর ভাঙেই না। সেই ঘুমের ওপর, ডানার ওপর পলি জমতে থাকে। পলির স্তর বাড়ে। উইয়ের ঢিবির মতো উঁচু হয় চর। লোকেরা বকের কথা ভুলে যায়। নদীও সরে যায়। সেই চরে বাসা বাঁধে মানুষ।

একসময় বগার বিল ছিল কর্ণফুলীর গভীর তলদেশ। সেখানে হয়তো কোনো এক যুদ্ধে পর্তুগিজ জাহাজটা ডুবেছিল। ওই সময় জাহাজের ভেতরে ঘুমাচ্ছিল তরুণী। সেখানে পানি ঢোকেনি। কিংবা ঢুকলেও পানিতে আরও গাঢ় হয়েছিল তার ঘুম। তারপর কত দিন সে ঘুমিয়েছে কেউ জানে না।

প্রবল এক ভূমিকম্পের পর সেই চরে দেখা গেল জাহাজের একটা অংশ। মেয়েটার ঘুম ভাঙে আর সে পলির গন্ধ পায়। হয়তো পচে যাওয়া কাঠের দরজা একটু ফাঁক হয়েছিল। ফাঁক দিয়ে ঢুকেছিল পলি। অবাক হয়ে গন্ধও শুঁকেছিল।

এই গন্ধে রক্তে নাচন উঠল। মনে হলো, কী যেন হারিয়ে ফেলেছে। ঘুম আর এল না। তখন শুনল একটা পাখি মধুর স্বরে ডাকছে। এখন যে বসন্তকাল, তা তার জানার কথা নয়। ডাক শুনে জাহাজ থেকে বেরোয়। সারা গায়ে পলিমাটি। তখন কিছু একটা হয় এবং সে আপন মনে কথা বলে।

সাদা-কালো, ধূসর ও কালো রঙের কয়েক রকম পাখি দেখে চমকে ওঠে। সে হাঁটে। লাল, বেগুনি ও হলুদ ফুলে ভরা গাছ দেখে, জলা-জঙ্গল দেখে।

কীভাবে সে বেরিয়েছিল? বেরোনোর সময় জাহাজে আর কেউ ছিল কি না, তা আজ কেউ বলতে পারবে না। এমনকি সে নিজেও না। কর্ণফুলীপাড়ের মানুষ এক সকালে দেখে, পলি রঙের এক তরুণী এলাকায় হাঁটছে। তার গা থেকে আসছে অদ্ভুত এক গন্ধ। এই গন্ধ তাদের অচেনা।

এলাকার মেয়েরা তাদের স্বামী, বাবা আর ছেলেদের চোখে চোখে রাখে। তাদের বারবার সতর্ক করে। বলে, সাবধান, জিনের খপ্পরে পোড়ো না। কেউ বলে, ইবে বার্মাইয়ে পরি।

তরুণী হাঁটে। কারও সঙ্গে কথা বলে না। হাঁটতে হাঁটতে একদিন বলীর হাটে যায়। কর্ণফুলীর পাড়ে বড় চর। লু হাওয়া। নদীর পানি রোদে চিকচিক করছে।

কতগুলো লোক হাত পাকাচ্ছে। শরীরের গিঁটে গিঁটে জমা হচ্ছে শক্তি। শরীর যেমন দেখার মতো, চেহারাও তেমন উজ্জ্বল।

মেয়েটা বুকভরে নিশ্বাস নেয়। অদূরে একটা বটগাছ। বটের ছায়ায় বসে বলীদের দেখে। হঠাৎ দেখে, নদীতে লাফ দেওয়া শুশুক। শুশুকটা কি তার মনে ঢুকে গেছে! নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। একটু দূরে তামাটে এক বলী। নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছেও যেতে ইচ্ছে করে।

পর পর কয়েক দিন বটের নিচে দাঁড়িয়ে বলীকে দেখল। বলীখেলা দেখতে দেখতে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলল।

হাটে মিষ্টির দোকান আছে। সেখানে বসে সে রসগোল্লা খাচ্ছিল। বলী ঢুকল। বলীর চামড়া বাদামি, সে তাতে ভাজা বাদামের গন্ধ পায়। চোখে পড়ল চোখ। তার চোখের তারায় থাকা তিরের ফলায় বলীকে গেঁথে নিল। নিয়ে নিল মনের গভীরে।

বলী পুনরায় তাকাল। তার মনে পড়ল গত রাতের স্বপ্নের কথা। ঘরের পাশে ব্যাঙের ছাতা। ছাতায় বসে আছে এক পরি। তার দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। নড়ছে ডানা দুটো। যেকোনো সময় উড়ে যাবে।

তারপর শ্রাবণের এক বিকেলে কর্ণফুলীর তীরে লোক্কা বিলে বলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। চট্টগ্রামের বেশির ভাগ বলী বিয়েতে উপস্থিত ছিল। বিয়ে উপলক্ষে সেদিন বলীখেলাও হয়েছিল।

কর্ণফুলীর পাড়ের কাছে তারা ঘর বাঁধে। বিয়ের পর পর জানতে চেয়েছিল, ‘ুমি এত সহজে আমাকে গ্রহণ করলে কীভাবে?

বলী মনে মনে বলে, তোঁয়ার চগুত জাদু আছে। জাদুর সাগরত ডুবি গেইলেম। মুখে বলে, তোমার চোখে পলি দেখে।

পলি!

হ্যাঁ!

সে আরও অনেক কথা বলতে চেয়েছিল। বলা হয়নি। তবে মারিয়া পালমা বুঝতে পেরেছিল। বিয়ের পর তো সে সুফিয়া খাতুন, স্বামীর বাহু আকড়ে সেদিন অনেকক্ষণ জোছনা দেখেছিল।

মাঝি বলরাম বলীর বন্ধু। পূর্ণিমা রাতে তার মাছ ধরার ছোট নৌকাটা নিয়ে কর্ণফুলীর বুকে তারা ঘুরে বেড়াত। দেখত জোছনা ফুল ফুটে আছে। বলী ফুল পেড়ে সুফিয়ার গায়ে ছুড়ে মারত।

লালদীঘি মাঠে বলীখেলা থাকলে বলী ধরতে যেত। ওখান থেকে এসে তাকে বলত নানা গল্প। সেই সব গল্পে ঘুমিয়ে পড়া বক আর ডুবে যাওয়া জাহাজের কথাও থাকত। শুনে শুনে সুফিয়ার মনে জেগে উঠত মারিয়া পালমা। মনে হতো, কী যেন হারিয়ে ফেলেছে। সে কাঁদত। একবার মনে হতো বলীর জন্য, আবার মনে হতো সে কাঁদছে হারিয়ে যাওয়া মারিয়ার জন্য।

একদিন স্বামীকে বলল, আমার খুব ইচ্ছে করছে।

স্বামী বুকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটের কোনায় এঁকে দেয় কর্ণফুলীর স্রোত। জানতে চায়, কী?

সুফিয়া তখন পলির গন্ধ পায়। আবছা এক জাহাজের কথা মনে পড়ে। তার মন কেমন করে। ইচ্ছে করে চলে যেতে, কিন্তু ইচ্ছের কথা বলে না।

এভাবেই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল, সুফিয়ার মন আলগা আলগা, কোথায় যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে। আগের মতো হাসে না, বলীর চোখের তারায় চোখ রাখে না। যেন পলির নিচে চাপা পড়া বক।

একদিন বলেই ফেলল, চলো, আমরা বকের ঘুমিয়ে পড়া বিলে বাসা বাঁধি।

বলী আর কী করে! তত দিনে তাদের সংসারে একটা ছেলে এসেছে। বউ-ছেলে নিয়ে বলীর হাট থেকে বগার বিলে চলে যায়।

এক সকালে ঘুম থেকে উঠে সুফিয়ার মনে হয়, তার মনে অনেক কথা জমা হয়েছে। সে তখন বলীকে খোঁজে, কিন্তু পায় না। বলী কি কোথাও চলে গেল? সপ্তাহখানেক আগের কথা মনে পড়ে। সেই রাতে বলী যখন ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, মুখ ঝামটা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, তোমার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগছে না।

এরপর তার কাছে আসতে শুরু করে একটা-দুটো ঘুমের বক। কিন্তু বকে তার মন নেই। সে খোঁজে বলীর হাসি, ঠোঁটের ঘাম, রাগ, শরীরের গন্ধ ও শক্তি। তার মনে গন্ধ ছড়াত ওই শক্তি। সেই গন্ধের জন্য সে হাঁটতে শুরু করে।

গনজালেস হয়তো হারিয়ে যাওয়া জাহাজে চড়ার স্বপ্ন দেখছে। সে কী করে বুঝবে এই বুড়িকে? এ যে ঘুমের মেয়ে, ঘুমের ভেতর থেকে এসেছে।

বুড়ি তো আসলে অপেক্ষা করছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, বলী একদিন আসবে। বলবে, চলো, বলীর হাটে চলো।

সে হয়তো ভুলে গেছে, বলীর হাটে এখন কোনো বলীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়া বলীদের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ছড়াতে ছড়াতে মানিকছড়ি, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির দিকে চলে গিয়েছিল। দীর্ঘশ্বাস থেকে জন্ম নিয়েছে লড়াইয়ের মোরগ। ব্যাপারীরা ফটিকছড়িতে এসব মোরগ নিয়ে আসে। বলীর হাটের তরুণেরা ফটিকছড়ির বিবিরহাটে গিয়ে কিনে আনে।

মহররম এলে বলীর হাটের অলিগলিতে লাল রাতার কক কক বেড়ে যায়। কোনোটা বালকের কোলে ঘোরে, কোনোটা দাঁড়িয়ে বলীর হাটে খালের বাতাস বুকে নিয়ে বাক দেয়। লোকে তখন খালপাড়ের কেওড়া বা কেরবাগাছ আর পানিতে উড়ে বেড়ানো রাজহাঁস দেখে।

লড়াইয়ে রক্তাক্ত লাল ঝুঁটি কালচে হয়, কোনো মোরগের চোখ কানা হয়ে যায়। সবচেয়ে সেরা মোরগটা আঘাতে আঘাতে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। কেউ বাজি জেতে, কয়েক হাজার টাকা পকেটে নিয়ে কোরবানির ঈদে বালুর মাঠের গরুর লড়াই দেখার জন্য অপেক্ষা করে।

গোধূলির রং ছড়িয়ে পড়লে বুড়ি হাতটা বাড়িয়ে দেয়। যেখানে জাহাজটা ডুবেছিল কিংবা তার স্বপ্ন, তার আশপাশে কোনো একটা ছোট্ট খুপরিতে সে থাকে। চাক্তাই খাল থেকে উঠে আসা দুর্গন্ধে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায় কি না, গনজালেস জানে না। সে ভাবে, কর্ণফুলী আরও বড় হোক, তার বুকে চলুক বড় বড় জাহাজ। বুড়ি ডুব দেবে একদিন। দেখবে জাহাজের গায়ে শেওলা। সেখানে হালদার মা মাছেরা বাসা বানাবে। একেকটা বিশ-ত্রিশ সেরি কাতলা, রুই। সে মাছের মতো ঘুরে বেড়াবে। ওপরে আর আসবে না, ভিক্ষাও করবে না।

গুর্খা ডা. লেনের একটি বাসায় এক সন্ধ্যায় গনজালেসকে চুমু খেয়েছিল প্রেমিকা গুইনতারা। ফিসফসিয়ে বলেছিল, তুমি আমার পৃথিবী।

গনজালেস মনে মনে বলেছিল, পৃথিবীকে তুমি খুব কম চেন। ভেবেছিল, গুর্খা ডা. লেনে কেন তার আত্মা কেঁদে বেড়ায়? কাঁপতে কাঁপতে সেদিন জেলেপাড়ার ফাঁক গলে কর্ণফুলীর পাড়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখেছিল কেওড়ার ঝোপের পাশে লাল কাঁকড়ার গর্ত।

সে হাঁটতে হাঁটতে পাথরঘাটায় পৌঁছায়। গুর্খা ডা. লেনে ঢুকলেই জাহাজের গায়ে লেগে থাকা নুনের গন্ধ পায়। পুরোনো কালের গন্ধ এখানকার আনাচে-কানাচে এখনো রয়ে গেছে। গলিতে ঢুকতেই কানে আসে দীর্ঘশ্বাস।

বাসায় গিয়ে বই খোলে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টায়, কিন্তু বকের গন্ধ খুঁজে পায় না। বইজুড়ে মগ আর পতুর্গিজের অত্যাচার, অনাচার। ক্লাস এইটে পড়ুয়া মেয়ে পরীক্ষা নিয়ে কী একটা বলে, কানে যায় না।

কোনো কারণ ছাড়াই দাদি মাঝেমধ্যে তাকে ডাকাইতুর পোয়া ডাকেন। বলেন, ইক্কে আয়। জিজ্ঞেস করেন, এটা যে রম্যভূমি, তোর মনে আছে? এখানে পুষ্পের মতো ঝরে পড়ে সমৃদ্ধি। লোকে কয় এটা পুষ্পপুর। জলদস্যুরা তো পাগল হবেই।

মাটিয়া বা কালা ফিরিঙ্গি গনজালেস ধন্দে পড়ে। সে কিছু বলতে পারে না। তার খুব ঘুম পায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে চারপাশে তাকাতে চেষ্টা করে। না, এই বাসায় কোথাও আলো খেলা করে না। যে জাহাজে নিষ্ঠুরভাবে হাসত মারিয়া পালমা, তার কাছে যেতে ইচ্ছে করে।

সে কী করবে? হয়তো গুইনতারার বদলে ওই মেয়েকে খুঁজবে। বলবে, এসো কাছে এসো।

হয়তো সে খুঁজে বের করবে জাহাজটা। দেখবে সেখানে মেয়েটা বসে আছে। তার অট্টহাসিতে ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে। কর্ণফুলীর তীরে কোনো ডকইয়ার্ডে মেরামত করবে জাহাজটা। ওটা ক্রীতদাসে ভর্তি করার স্বপ্নও দেখবে।

তারপর এক রাতে রওনা দেবে গনজালেস। পালের হাওয়া দেখতে দেখতে মদ খাবে। মদে ভেজা ঠোঁট ছোঁয়াবে মেয়েটার ঠোঁটে। মারিয়ার হয়তো মনে পড়বে গাঢ় খয়েরি গাব কিংবা বলীর কথা। তখন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে পড়বে জাহাজটি।