সেলিনামঙ্গল

সেলিনা হোসেন। ছবি: কবির হোসেন
সেলিনা হোসেন। ছবি: কবির হোসেন

ইতিহাসের নান্দনিক প্রতিবেদন নির্মাণে সেলিনা হোসেনের সিদ্ধি শীর্ষবিন্দুস্পর্শী। এ প্রসঙ্গে তাঁর চাঁদবেনে, নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, কাঁটাতারে প্রজাপতি, গায়ত্রী সন্ধ্যা, সোনালি ডুমুর—এসব উপন্যাসের কথা স্মরণ করতে পারি। এসব উপন্যাসে সেলিনা নিজস্ব ভাবনায় ইতিহাসকে সমকালের সঙ্গে বিমণ্ডিত করেছেন—ইতিহাসের কঙ্কালেই নির্মাণ করেছেন সমকালের জীবনবেদ। ইতিহাস ও শিল্পের রসায়নে সেলিনা হোসেন পারক্রম শিল্পী। ইতিহাসের সঙ্গে সমকালীন মানবভাগ্য বিমণ্ডিত করতে গিয়ে তিনি অদ্ভুত এক নিরাসক্তিতে, উভয়ের যে আনুপাতিক সম্পর্ক নির্মাণ করেন, বাংলা উপন্যাসের ধারায় তা এক স্বতন্ত্র অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। তাঁর উপন্যাস পাঠ করলে বিস্মৃত হতে হয় কোনটা ইতিহাস আর কোনটা কল্পনা।

সাহিত্যিক নির্মাণকে ভেঙে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় সেলিনা হোসেন রেখেছেন প্রাতিস্বিক প্রতিভার স্বাক্ষর। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ অবলম্বনে তিনি রচনা করেছেন নীল ময়ূরের যৌবন, মনসামঙ্গল কাব্য ভেঙে নতুন করে গড়েছেন চাঁদবেনে, আর চণ্ডীমঙ্গলের ছায়ায় নির্মাণ করেছেন কালকেতু ও ফুল্লরা। মূল রচনা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও সেলিনার হাতে তা এক অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত হয়েছে এই ত্রয়ী উপন্যাস। তিনটি উপন্যাসের মাঝেই শোনা যায় শ্রেণিসংগ্রাম-চেতনার অভিন্ন এক সুর।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সেলিনা হোসেনের ঔপন্যাসিক প্রতিভাকে প্রাণিত করে নিরন্তর। তাই ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন নির্মাণে তিনি বারবার ফিরে যান গৌরবোজ্জ্বল একাত্তরের কাছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর হাঙর নদী গ্রেনেড, যুদ্ধ—এসব উপন্যাসের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে একাত্তরে সাধারণ মানুষের জাগরণটাকেই ধরতে চেয়েছেন সেলিনা। বাংলাদেশে জীবনী-উপন্যাস রচনাতেও তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গবাসের দিনগুলো নিয়ে তিনি রচনা করেন পূর্ণ ছবির মগ্নতা, ইলা মিত্রের জীবনসংগ্রাম নিয়ে কাঁটাতারের প্রজাপতি আর গালিবের কবিপ্রতিভা নিয়ে যমুনা নদীর মুশায়েরা। সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে নারীর জন্য নিজস্ব একটা অবস্থান রচিত হয়েছে। নারীকে প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না দেখে তিনি দেখেছেন সামাজিক জেন্ডার দৃষ্টিকোণে। ফলে তাঁর নারীরা হতে পেরেছে ব্যক্তিত্বমণ্ডিত ও স্বাধীন নির্বাচনক্ষম।

উপন্যাসের মতো ছোটগল্প রচনাতেও সেলিনা হোসেন রেখেছেন নিজস্বতার পরিচয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, প্রেম-যৌনতা, ভণ্ডামি-প্রতারণা, শ্রেণিযুদ্ধ আর প্রতিরোধ-বাসনা—এই সব নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর বিশাল গল্পভূগোল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন একগুচ্ছ গল্প, যেখানে শিল্পিতা পেয়েছে তাঁর প্রগত জীবনচেতনা। সেলিনা হোসেন তাঁর গল্পে প্রত্যাশা করেছেন নারীর অনেকান্ত উত্থান—তবে সে উত্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিনির্ভর। সামাজিক নির্ভর না হয়ে ব্যক্তিনির্ভর হওয়ার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর নারীরা পরিণতিতে হয়ে পড়ে স্তব্ধ, নির্বাক কিংবা মৌন। তবে ছোটগল্পে নারী-অভিজ্ঞতার রূপায়ণে সেলিনার সিদ্ধি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে তাঁর মতিজানের মেয়েরা সংকলনভুক্ত গল্পগুলোর কথা স্মরণ করা যায়।

কেবল কথাকার হিসেবেই নয়, একজন প্রাবন্ধিক এবং গবেষক হিসেবেও সেলিনা হোসেনের ভূমিকা আমাদের স্মরণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বদেশে পরবাসী, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, একাত্তরের ঢাকা, নির্ভয় করো হে, বাংলাদেশের মেয়ে শিশু, ঘর গেরস্থালির রাজনীতি প্রভৃতি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়।

সম্পাদক হিসেবেও সেলিনা হোসেনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর একক ও যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত জেন্ডার বিশ্বকোষ (১-২ খণ্ড), নারীবিষয়ক একাধিক গ্রন্থ বাংলাদেশে নারীচর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছে। শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও সেলিনার অবদান উল্লেখ করার মতো। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন অনেকগুলো বই। সম্পাদনা করেছেন বাংলা একাডেমির কিশোর-পত্রিকা ধান-শালিকের দেশ

এ প্রসঙ্গে সাগর, গল্পে বর্ণমালা, কাকতাড়ুয়া, বর্ণমালার গল্প, অন্যরকম যাওয়া, আকাশপরী, যখন বৃষ্টি নামে, জ্যোৎস্নার রঙে আঁকা, ছবি, মেয়রের গাড়ি, মিহিরনের বন্ধুরা, এক রুপোলি নদী, গল্পটা শেষ হয় না, চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ—এসব বই স্মরণীয়। তাঁর ভ্রমণসাহিত্য দূরের দেশ কাছের দেশও ভিন্ন এক সেলিনা হোসেনকে পাঠকের সামনে হাজির করে।

বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারায় সেলিনা হোসেন, প্রকৃত প্রস্তাবেই, নির্মাণ করেছেন নিজস্ব একটা ভুবন। সাহিত্যিক হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে তিনি কখনো বিস্মৃত হননি। ফলে তাঁর সব রচনার পশ্চাতেই থাকে একটা সামাজিক অঙ্গীকার, থাকে একটা প্রগতিশীল ভাবনা। তাঁর শিল্পীমানসে সব সময় সদর্থক ইতিহাস-চেতনা জাগ্রত থাকে বলে মানুষকে তিনি ম্যাক্রোভাবনায় আয়ত চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। মাইক্রোভাবনা প্রাধান্য পায়নি বলে তাঁর মানুষেরা কখনো খণ্ড-জীবনের আরাধনায় মুখর হয়নি, হয়নি নষ্ট জীবনের উপাসক।

বাংলাদেশের এখন যে কজন সাহিত্যিক আছেন, যাঁরা দেশের ভূগোল অতিক্রম করে পরিচিত হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক ভূগোলে, সেলিনা হোসেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর সাহিত্য পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, তাঁর রচনা সংকলিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য বহু গ্রন্থে। সার্ক-সাহিত্যভুবনে এক প্রভাববিস্তারী সাহিত্যিকের নাম সেলিনা হোসেন। তাঁর রচনা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেলিনার সাহিত্য নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। এসব তথ্য সাহিত্যিক হিসেবে সেলিনা হোসেনের প্রাতিস্বিকতারই স্বাক্ষরবহ।

কেবল সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, একজন প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী ও সমাজচিন্তক হিসেবেও আমাদের দেশে এই কথাশিল্পীর রয়েছে একটি মর্যাদার আসন। তিনি মানুষকে জাগ্রত করেন তাঁর কথা দিয়ে, লেখা দিয়ে—মানুষের সংসারে কামনা করেন সম্প্রীতি, শুভ আর মঙ্গল। মানবিক সম্পর্কের এই দুর্দিনে সেলিনা হোসেনের মতো মানুষ আমাদের কতজনই-বা আছে?

সত্তর-অতিক্রমী এই সাহিত্যিকের কাছে আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে। তাই তাঁকে সুস্থ থাকতে হবে, থাকতে হবে বিগত অর্ধশতাব্দীর মতো কর্মচঞ্চল। সাহিত্যিক-সমাজচিন্তক-প্রশাসক সেলিনা হোসেনকে জন্মদিনের অনেকান্ত শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করি তাঁর এই মঙ্গলগীত।