'ইন্ডাস্ট্রি' ও 'আর্ট'-এর চলচ্চিত্র

আয়নাবাজি  ছবিতে চঞ্চল চৌধুরী ও নাবিলা
আয়নাবাজি ছবিতে চঞ্চল চৌধুরী ও নাবিলা

‘ইন্ডাস্ট্রি’ ও ‘আর্ট’ উভয় অর্থেই চলচ্চিত্র মাধ্যমটি িশল্প। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখালেখির যে ধারা দেখা যায়, তাতেও এ বিভাজনের ছাপ স্পষ্ট। ফাহমিদুল হক দুটো ব্যাপারেই আগ্রহী। তাই তাঁর চলচ্চিত্র আলোচনায় চলচ্চিত্রের শৈল্পিক ও বাণিজ্যিক অভিপ্রকাশের আলোচনা প্রায় সমানভাবেই পাওয়া যায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর একটি নতুন বই এসেছে—চলচ্চিত্র পাঠ। এই বইয়েও লেখক ‘ইন্ডাস্ট্রি’ ও ‘আর্ট’—দুই অর্থেই চলচ্চিত্রকে পাঠ করেছেন।

চলচ্চিত্রশিল্পের বর্তমান অবস্থা তেমন আশানুরূপ না হলেও চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা হচ্ছে বেশ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা নিয়েই কথা বলেছেন ফাহমিদুল হক।

বইটি লেখক ভাগ করেছেন চারটি পর্বে—‘পাঠ’, ‘সমসাময়িক’, ‘সমীক্ষা’ ও ‘সমালোচনা’। সব মিলিয়ে মোট ১৭টি রচনা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চলচ্চিত্র পাঠ কী পর্যায়ে এসেছে, চলচ্চিত্রের আলোচনা এখানে কতটুকু কীভাবে হয়, তার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা পাওয়া যাবে একটি প্রবন্ধে। আক্ষেপ নিয়েই বলতে হচ্ছে, অবস্থাটা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। অথচ একসময় চলচ্চিত্রবিষয়ক আলাদা পত্রিকা ও সাময়িকীপত্র বের হতো এখান থেকে! আর সেগুলোর বাজার ও চাহিদাও মন্দ ছিল না। কেউ কেউ বলতে পারেন, কয়েক বছর আগেও চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা যেখানে প্রায় হতোই না, সেখানে বিতর্কের খাতিরেও এখন কিছু আলোচনা তো হচ্ছে। কিন্তু এই বিতর্ক বা আলোচনা, তার কতটুকু গঠনমূলক বা স্বাস্থ্যকর?

এসব আলোচনায় একটা বিষয়ই বারবার উঠে আসছে প্রবলভাবে। সেটা অসহিষ্ণুতা। আমাদের রাজনীতি, সমাজ—সবকিছুতে অসহিষ্ণুতা ভয়ংকরভাবে যেমন বেড়েছে, এর প্রভাব পড়েছে সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্রশিল্পেও। বর্তমানে যৌথ প্রযোজনার ছবি সম্পর্কে যে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানেও অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট। মেঠো রাজনীতির মতোই প্রত্যক্ষ হুমকি-ধমকি ও গালিগালাজ এসব আলোচনায় খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এগুলো আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির দৈন্যই প্রকাশ করছে। ফাহমিদুল তাঁর বইতে মেহেরজান চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষের মেরুকরণ কীভাবে প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা নিয়ে বলেছেন। অনন্ত জলিলের মোস্ট ওয়েলকাম নিয়ে হাসাহাসি ও রঙ্গরসিকতার আড়ালে আসলে যে লুকিয়ে আছে আহত মধ্যবিত্ত অহম, সেটিও আছে তাঁর আলোচনায়। অন্যদিকে মনের মানুষ ছবিটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি, কেন হয়নি? লেখায় সেই কারণই খুঁজেছেন ফাহমিদুল।

চলচ্চিত্র পাঠ
চলচ্চিত্র পাঠ
চলচ্চিত্র পাঠ
ফাহমিদুল হক
প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল,
প্রকাশক: আদর্শ, ঢাকা,
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭,
১৬৬ পৃষ্ঠা,
দাম: ৩০০ টাকা।

আরেকটি প্রবন্ধে ফাহমিদুল আলোকপাত করেছেন নিজস্ব চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে। পশ্চিমে আবিষ্কৃত এ মাধ্যমের ভাষা এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে পশ্চিমকে অনুসরণ করছে, সেটি উঠে এসেছে এই আলোচনায়। হলিউডের মুনাফামুখী ধারাক্রমিক কাহিনি বর্ণনার ন্যারেটিভকে ইউরোপ চ্যালেঞ্জ করেছিল নন-ন্যারেটিভ নন্দনতত্ত্বের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসব ছবিতে প্রাধান্য পায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, একাকিত্ব, হতাশা ও অবক্ষয়ের চিত্র। ওদিকে রুশ নির্মাতারা বানান আঙ্গিকনির্ভর সিনেমা। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের নিজস্ব কোনো ভাষা এখনো গড়ে ওঠেনি, একমাত্র ব্যতিক্রম ঋত্বিক ঘটক। বহির্বিশ্বে সত্যজিৎ রায় বাঙালিত্বের প্রতিনিধি হলেও তিনি নিজেই বলেছিলেন, ঋত্বিক তাঁর চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি। চলচ্চিত্রের যে ভাষা তিনি তৈরি করেছিলেন, ফাহমিদুলের ভাষায় তা ‘বাঙালি, স্থানীয়, অপশ্চিমা’। এই বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন লেখক। একই রকম ভাবে ইয়াসিজুরো ওজু একধরনের জাপানি চলচ্চিত্র ভাষার জন্ম দিয়েছেন। লেখক লাতিন আমেরিকান ও আফ্রিকান ছবিতেও নিজস্ব ভাষা তৈরির প্রচেষ্টা দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ইরানি চলচ্চিত্রে নিজস্ব চিত্রভাষা কেন তিনি দেখতে পেলেন না, সেটা বেশ বিস্মিত করে।

বইয়ে চলচ্চিত্র আমদানির মতো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখক যেমন লিখেছেন, তেমনি বাংলা চলচ্চিত্রে সর্প সিনেমা ও সুফিবাদ কীভাবে এসেছে, সেটিও তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। এ ছাড়া সমসাময়িক চলচ্চিত্রগুলোর সমালোচনা তো আছেই। আলোচনাভুক্ত সমসাময়িক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রগুলো হলো—আন্ডার কনস্ট্রাকশন, মেঘমল্লার, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, পিঁপড়াবিদ্যা, সুতপার ঠিকানা, মোস্ট ওয়েলকাম, জিরো ডিগ্রী, আয়নাবাজিশুনতে কি পাও?

ফাহমিদুল হকের এ বই চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহী সিরিয়াস পাঠকদের মনের খোরাক জোগাতে সক্ষম হবে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে তিনি যেহেতু কিছু তাত্ত্বিক কাঠামো দিয়ে চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে বুঝতে চান, তাই ফিকশনপ্রিয় পাঠক ও চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে তাঁর প্রবন্ধগুলো নীরস ঠেকতে পারে। কিন্তু নির্মোহভাবে চলচ্চিত্রকে বোঝার অভ্যাসও তো আমাদের করা দরকার।