প্যারিসে নভেরার প্রদর্শনী

নভেরা আহমেদ, প্যারিস
নভেরা আহমেদ, প্যারিস

প্যারিসে আত্মগোপন করে ছিলেন শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার ও বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রদূত নভেরা আহমেদ। কিন্তু প্যারিসপ্রবাসী শিল্প-সমালোচক আনা ইসলামের সঙ্গে তাঁর গোপন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। আনা ইসলাম বহু দিন ধরে নভেরার বহু অজানা তথ্য মানুষের গোচরে নিয়ে আসছেন। প্যারিসে আজই শুরু হওয়া নভেরার রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনী নিয়ে তাঁর রচনা

৪১ বছর পর প্যারিসে ভাস্কর নভেরা আহমেদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে আজ, ১৬ জানুয়ারি। তার আগে ১৯৭৩ সালে জুলাই মাসে প্যারিসে গ্যালারি রিভগেসে তাঁর প্রদর্শনী হয়েছিল। ১৯৬৯ থেকে ২০১৪ সাল—এই চার দশকেরও বেশি সময়ে সৃষ্ট মোট ৫১টি শিল্পকর্ম এই রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ৪২টি চিত্রকর্ম ও নয়টি ভাস্কর্য।

শঁতামেলের মেষ
শঁতামেলের মেষ

পৃথিবীর বহু শিল্পীই নজরে এসেছেন তাঁর সময়ের অনেক পড়ে। সে শিল্পীদের অনেকে তাঁদের ক্ষেত্রে ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সমকাল তাদের চিনতে পারেনি। কেউ কেউ সমকালেও শিল্পরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভাস্কর নভেরা এই ব্যতিক্রমীদের একজন। তাঁর স্বামী গ্রেগোয়া ব্রনসের উদ্যোগে এই প্রদর্শনীর কিউরেটর প্যাট্রিক আমিন প্রকাশ করেছের একটি সুদৃশ্য ক্যাটালিগ। দুই মাসব্যাপী (১৬ জানুয়ারি-১৬ মার্চ) এই রেট্রোসপেকটিভের গুরুত্ব নানা কারণে।

নভেরা দীর্ঘকাল প্যারিসে, কিন্তু দৃশ্যপট থেকে অনুপস্থিত। নভেরার অবর্তমানে অনুমানে ও কল্পনায় বিভিন্ন লেখালেখিতে তাঁর সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ও অবাস্তব কাহিনি তৈরি হয়েছে। নভেরা এমন এক ব্যক্তিত্ব, শিল্পকর্মের চেয়ে যাঁর ব্যক্তিজীবন বেশি চর্চিত। এখন সময় এসেছে শিল্পকর্মে তাঁর অবদানসহ সামগ্রিক মূল্যায়নের।

কর্মসূত্রে নভেরার বাবা সৈয়দ আহমেদ কর্মরত ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলে। ক্যাটালগের তথ্য অনুযায়ী নভেরার জন্ম সুন্দরবনে, ১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ। চাচা আদর করে নাম রাখেন নভেরা। ফার্সি শব্দ ‘নভেরা’র অর্থ নবাগত, নতুন জন্ম। পরবর্তী জীবনে নভেরা শব্দটি যথার্থই অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের ভাস্কর্য আধুনিক ভাষা পেয়েছিল। কিশোরী বয়সে বিয়ের বিপক্ষে ছিলেন। তাই বাবার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে হতে চেয়েছেন ভাস্কর। বাবা মেয়েকে আইনশাস্ত্র পড়তে পাঠিয়ে দেন লন্ডনে, ১৯৫১ সালে। ভাস্কর হওয়ার অদম্য স্পৃহায় স্বাধীনচেতা নভেরা যোগ দেন সিটি অ্যান্ড গিল্ড স্টোন কার্ভিং ক্লাসে। পরে ক্যাম্পারওয়েল স্কুলে পাঁচ বছর পড়ে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা পেয়ে দুই বছরের জন্য যান ফ্লোরেন্সে।
দেশে ফিরে ১৯৫৭ সালে শুরু করেন শহীদ মিনারের কাজ। সহযোগী ছিলেন শিল্পী হামিদুর রহমান। পরের বছরই ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার নভেরাদের স্টুডিও ধ্বংস করে দেন। সে বছরই ঢাকায় প্রথম মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন। দেশে ফিরে নভেরার ভাস্কর্যচর্চা শুরু করেন করেন সুলভ উপকরণ দিয়ে। ’৬০ সালে ‘ইনার গেজ’ শিল্পকর্মের ভাস্কর্য প্রদর্শনী ছিল নভেরার শিল্পভাবনার ধ্রুপদ অভিজ্ঞান। এর মাধ্যমে ভাস্কর হিসেবে তিনি সমীহ অর্জন করেন।
প্রদর্শনীর ৫১টি শিল্পকর্মের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য এ স্বল্প পরিসরে লেখা অসম্ভব। নভেরার সৃষ্টি মানে ব্যক্তি নভেরারও আমূল অন্বেষণ। নির্জনতাপ্রেমী এই অসামান্য ভাস্কর বিনা প্রচারে ও আড়ম্বরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। তাঁর সৃষ্টিশীল মনন, দক্ষতা ও ব্যক্তিস্বভাবের সঙ্গে স্বদেশের ইতিহাসযাপিত পরিবেশের সংযোগ ও সংঘর্ষে রচিত হয়েছে এসব শিল্পকর্ম। দেশ থেকে দূরে থাকলেও দেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড়। নভেরার চিত্রকর্ম মানেই শিকড়ের সঙ্গে মৌলিক আত্মীয়তা। ‘অপুর ভুবন’, ‘আলোর পথ’, ‘মানবতা’, ‘নিঃসঙ্গ’, ‘সূর্যাস্ত’, ‘বর্ষাকাল’, ‘সূর্যাস্ত কক্সবাজার’, ‘পাখির কলতান’—এসব চিত্রকর্মে স্পষ্ট যে, হাজার কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশ নামের দেশটি সমান্তরালভাবে দীর্ঘ সময় ধরে নভেরার সঙ্গে পরিক্রমা করছে।
এই প্রদর্শনী আত্মপ্রচারে কুণ্ঠিত নভেরার আত্ম-উন্মোচনের ইতিহাস। এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো নভেরার সৃষ্টিকর্ম, সৃষ্টিপ্রেরণা, সৃষ্টিচেতনার সমাপ্তি ঘটেনি, এখনো তা অফুরান। এবার তাঁর উদ্বোধন হলো আরও একবার। ফরাসিতে ‘ভ্যারলিলাজ’ মানে ‘উদ্বোধনী দিন’। কিন্তু নভেরার স্বামী গ্রেগোয়া বলেছেন, আমন্ত্রণপত্রে লেখা হয়েছে ‘উভ্যারতুর’ মানে ‘উন্মোচন’।
আমরা এমন এক সময়ে উপনীত, যখন দেশে নতুন প্রজন্মের অনেকেই নভেরার নাম সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা জানেন না, নভেরা আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনারের প্রধান স্থপতি। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্যারিসে সাক্ষাতের বাসস পরিবেশিত খবরে নভেরার পরিচিতি ‘ভাস্কর’ নয়, ‘স্থপতি’ লেখা হয়েছিল।
আমাদের সময়ের জীবন্ত কিংবদন্তি নভেরার বয়স এখন ৭৫ বছর। ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা নভেরার সৃজনশীলতায় কোনো যতি টানতে পারেনি। কিন্তু ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে স্ট্রোকের ফলে বর্তমানে তাঁর স্বাস্থ্য নাজুক। হুইলচেয়ারে বসেই তিনি চলাফেরা ও তাঁর কাজকর্ম করেন। তবে শরীর দুর্বল হলেও তাঁর প্রবল মনোবল এখনো অক্ষুণ্ন। বই পড়া ও ধ্যান—এসবের মধ্য দিয়ে তাঁর দিনের অনেকটা সময় কাটে। তিনি আনন্দ খুঁজে পান রবীন্দ্রনাথে, আর বৌদ্ধ দর্শনে পান আত্মার প্রশান্তি।
শহীদ মিনার প্রধান স্থপতি যে নভেরা আহমেদ, এই কৃতিত্বটুকু দিতে আমাদের অনেকেরই দ্বিধা। তাঁকে ব্রাত্য করে রাখতে চেয়েছেন সংকীর্ণ মনের মানুষেরা। কিন্তু নভেরা তো আমাদের শিল্পকর্মের ইতিহাসে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।