আফতাব ও আনজুমের বেদনা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

পাঁচ সন্তানের মধ্যে ও ছিল চতুর্থ। জানুয়ারি মাসে ঠান্ডায়, কুপির আলোতে (কারণ লোডশেডিং) দিল্লির দেয়ালঘেরা শহর শাহজাহানাবাদে ওর জন্ম। যে ধাই ওকে দুনিয়ায় বের করে এনেছিল আর দুটো শাল দিয়ে পেঁচিয়ে তুলে দিয়েছিল মায়ের হাতে, সেই আহলাম বাজি ওর মাকে বলেছিল, ‘ছেলে হয়েছে।’ তখনকার অবস্থাটা বুঝলে বাজির ভুলকে ঠিক বলেই মনে হবে।

পোয়াতি হওয়ার প্রথম মাসে জাহানারা বেগম আর তার স্বামী ঠিক করেছিল বাচ্চাটা ছেলে হলে নাম রাখবে আফতাব। ছয় বছর ধরে তারা আফতাবের জন্য অপেক্ষা করেছিল। ওর যে রাতে জন্ম হলো, সেটা ছিল জাহানারা বেগমের জীবনের সবচেয়ে সুখের রাত।

পরদিন সকালে, যখন রোদ খানিকটা চড়ে গিয়েছে আর ঘরটাও সুন্দর ওমে ভরপুর হয়ে উঠেছে, ছোট্ট আফতাবের শালের প্যাঁচ খুলে দেখছিল সে। ওর ছোট্ট শরীরটা সে খুঁটে খুঁটে দেখছিল—চোখ-নাক-মাথা-বগল-হাত-পায়ের আঙুল—বেশ তুষ্টি আর অলস আনন্দ নিয়ে। এ সময়ই সে আবিষ্কার করেছিল, ওর শরীরের বালক-অঙ্গের নিচে গুঁটি মেরে রয়েছে একটা ছোট, অগঠিত, কিন্তু নিঃসন্দেহে, বালিকা-অঙ্গ।

নিজের পেটের সন্তানকে দেখে কোনো মা কি আতঙ্কিত হতে পারে! জাহানারা বেগম হয়েছিল। তার প্রথম অনুভূতিটা ছিল যেন তার হৃৎপিণ্ডটা কুঁকড়ে যাচ্ছে আর হাড়গুলো সব ছাই হয়ে যাচ্ছে। পরের প্রতিক্রিয়াটা ছিল আরেকবার দেখে নেওয়া, কোনো ভুল হয়ে গেল না তো। আর তৃতীয় প্রতিক্রিয়ায় যে জিনিসটা সে জন্ম দিয়েছে, সেটার কাছ থেকে কুঁকড়ে সরে গিয়েছিল। তার চতুর্থ প্রতিক্রিয়া ছিল বাচ্চা এবং সেই সঙ্গে নিজেকেও শেষ করে দেওয়া। পঞ্চম প্রতিক্রিয়া ছিল সন্তানকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে এই ধরিত্রীর বুকের ফাটলে তার জানা পৃথিবী আর অজানা পৃথিবীর মাঝে তলিয়ে যাওয়া। সেই অতলের ঘূর্ণিপাকে তার জানা সবকিছু—একেবারে ছোট্ট থেকে সবচেয়ে বড়—কিছুরই আর কোনো অর্থ ছিল না। উর্দুতে—যে একমাত্র ভাষা জানা ছিল তার—সবকিছু, শুধু জীবন আছে এমন নয় সবকিছুরই—কার্পেট, জামাকাপড়, বই, কলম, বাদ্যযন্ত্র—সবারই লিঙ্গ আছে। সবকিছুই হয় পুংলিঙ্গ নাহয় স্ত্রীলিঙ্গ, হয় পুরুষ নয় তো নারী। সবার জন্য, শুধু ওর বাচ্চার জন্য ছাড়া। হ্যাঁ, সে এটাও জানত যে ওর বাচ্চার মতন যারা, তাদের জন্যও একটা শব্দ আছে—হিজড়া।

তার ষষ্ঠ প্রতিক্রিয়া ছিল নিজেকে পরিষ্কার করা এবং এটা নিয়ে এই মুহূর্তে কাউকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নেওয়া। এমনকি তার স্বামীকেও না। সপ্তম প্রতিক্রিয়া ছিল আফতাবের পাশে শোয়া আর বিশ্রাম নেওয়া। যা হোক, এটা আসল যোনি নয়, সে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল। যোনিপথ খোলা নেই (সে ভালো করে দেখেছিল)। এ শুধু দেহের একটা বাড়তি অংশ, বাচ্চাদের হতেই পারে। হয়তো এটা বন্ধ হয়ে যাবে অথবা সেরে যাবে কিংবা কোনো না কোনোভাবে চলে যাবে। তার জানা প্রতিটি দরগায় সে মানত করবে আর সর্বশক্তিমানের কাছে চাইবে করুণা ভিক্ষা।

প্রথম যেদিন সে ঘর থেকে বের হতে পারল, জাহানারা বেগম তার বাচ্চা আফতাবকে নিয়ে হজরত সারমাদ শাহিদের দরগায় গিয়েছিল। প্রথমবার সে যখন ভিড় পার হয়ে একটা ছোট লাল কুঠুরিতে ঢুকতে পেরেছিল, জাহানারা শান্ত হতে পেরেছিল। এক কোনায় সে তার কোলের মধ্যে ঘুমানো বাচ্চাকে নিয়ে বসে গিয়েছিল। এরপর সে যখন আরেক কোনায় এক স্বচ্ছপ্রায় বৃদ্ধকে দেখতে পেল, যার ত্বক কাগজের মতো আর দাড়িতে আলেয়ার মতো আলো জড়ানো, যে সমানে আগুপিছু দুলে যাচ্ছে, নীরবে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে—যেন তার হৃদয় খানখান হয়ে গেছে, তখন জাহানারা বেগমও নিজের চোখের জল ছেড়ে দিল। ‘এই আমার ছেলে—আফতাব’, সে ফিসফিসিয়ে হজরত সারমাদকে বলেছিল, ‘আমি ওকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। ওকে দেখে রাখবেন। আর আমাকে শেখান কী করে আমি ওকে ভালোবাসব।’

হজরত সারমাদ তার ফরিয়াদ শুনেছিল।

২.

আফতাবের জীবনের প্রথম কয়েক বছর জাহানারা বেগমের গোপন ব্যাপারটা নিরাপদেই ছিল। যত দিন সে ওর বালিকা-অঙ্গটি সেরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল, সে ওকে নজর-ছাড়া করত না; এবং ওকে ভয়ংকরভাবে আগলে আগলে রাখত। আফতাব যখন পাঁচ বছরের, তখন ওকে চুড়িওয়ালির গলিতে ছেলেদের উর্দু-হিন্দি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। আফতাব সাধারণের চেয়ে ভালো ছাত্র ছিল; কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকেই এটা পরিষ্কার ছিল যে আফতাবের আসল প্রতিভা সংগীতে। ওকে ওস্তাদ হামিদ খানের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল ওর বাবা-মা। তরুণ ওস্তাদ খান ছিলেন অসাধারণ সংগীতজ্ঞ। বাচ্চাদের দলকে শাস্ত্রীয় সংগীত শেখাতেন। ছোট্ট আফতাব একটা ক্লাসও বাদ দিত না। নয় বছর হতে হতে সে রাগ ইমন, দুর্গা আর ভৈরবীতে পুরো বিশ মিনিটের বড়া খেয়াল গাইতে পারত এবং রাগ পুরিয়া ধানেশ্রীতে শুদ্ধ রেখাবে কণ্ঠস্বর আলতো করে ছুঁয়ে খেলিয়ে যেতে পারত, যেমন করে হ্রদের জলের উপরিতলে একটা চ্যাপ্টা পাথর-টুকরো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। সে লক্ষ্ণৌ দরবারি ঠাঁট এবং দক্ষতার সঙ্গে চৈতি ও ঠুমরি গাইতে পারত। প্রথম দিকে লোকে চমৎকৃত হতো, এমনকি বাহবাও দিত। তবে শিগগিরই অন্য বাচ্চাদের মধ্যে কানাঘুষো আর খোঁচাখুঁচি বেড়ে গেল—ছেলেটা মেয়ে, ছেলেটা ছেলেও না মেয়েও না, ছেলেটা ছেলেও আর মেয়েও!

খোঁচাখুঁচিটা যখন অসহ্য হয়ে উঠল, আফতাব গানের ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিল। কিন্তু ওস্তাদ হামিদ খান ওর ওপর অনেক আশা রাখতেন। তাই ওকে একাই আলাদাভাবে শেখাতে চাইলেন। সুতরাং, গানের ক্লাস চলতে লাগল; কিন্তু আফতাব স্কুলে একেবারেই না-ফিরে যেতে গোঁ ধরল। তত দিনে জাহানারার যেটুকু আশা ছিল, তা-ও কমবেশি উবে গেছে। খুব উদ্ভাবনী কিছুর অজুহাত দিয়ে জাহানারা আফতাবের খতনা কয়েক বছরের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল। শেষ পর্যন্ত সে তা-ই করেছিল, যা তার করতেই হতো। সে তার সমস্ত সাহস একসঙ্গে করল এবং স্বামীকে বলল। আর স্বস্তি পেল এই ভেবে যে শেষ অবধি পরিবারের কারও সঙ্গে সে এই দুঃস্বপ্ন ভাগ করে নিতে পেরেছে।

তার স্বামী মুলাকাত আলি, একজন হাকিম, মানে ভেষজ ঔষধির চিকিৎসক ছিলেন। ভালোবাসতেন উর্দু আর ফারসি কবিতা। নিজের চাকরির সময়ের বাইরে বাড়িতে রোগী দেখতেন। কবিতা নিয়ে মুলাকাত আলির উচ্ছ্বাস তাঁর হেকিমি কাজের বাইরে কেবল শখমাত্র ছিল না। তিনি তাঁর অতিমানবীয় দক্ষতায় সব রোগের জন্যই অস্বস্তিকরভাবে প্রযোজ্য এবং অন্ত্যমিলযুক্ত কোনো না কোনো দ্বিপদী বলে দিতে পারতেন। যখন জাহানারা বেগম তাঁকে আফতাবের কথা জানালেন, সম্ভবত জীবনে প্রথমবারের মতো মুলাকাত আলি ঘটনাটার জন্য কোনো জুতসই দ্বিপদী দিতে পারেননি। প্রাথমিক ধাক্কার ঘোর কাটাতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল তাঁর। যখন সংবিৎ ফিরল, আরও আগেই কেন তাঁকে জানানো হয়নি—এ জন্য বকলেন স্ত্রীকে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, তাঁর ছেলের সমস্যার কোনো সহজ মেডিকেল-সমাধান আছে। তাঁরা নয়াদিল্লি যাবেন একজন ডাক্তার খুঁজে বের করতে। এক সপ্তাহ বাদে দুঃখী আফতাবকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন তাঁরা। ডা. গুলাম নবির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। গুলাম নবি নিজেকে একজন ‘সেক্সোলজিস্ট’ বলতেন।

নিজেকে চাঁছাছোলা ও বৈজ্ঞানিক মেজাজের সোজা কথার মানুষ বলতে গর্ব করতেন ডা. নবি। আফতাবকে পরীক্ষা করার পর তিনি বলেছিলেন, ডাক্তারিমতে ও ঠিক হিজড়া—পুরুষের শরীরে আটকে পড়া একজন নারী নয়, যদিও কার্যক্ষেত্রে শব্দটা ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, আফতাব সমন্বিত যৌনতার এক বিরল উদাহরণ, যার পুরুষ ও নারী উভয় বৈশিষ্ট্য আছে। যদিও বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে, ওর পুরুষ বৈশিষ্ট্যই বেশি জোরালো। তিনি বলেছিলেন, কোনো এক সার্জনের কথা, যিনি ওর বালিকা-অঙ্গটি সেলাই করে বন্ধ করে দেবেন। কিছু ওষুধের ব্যবস্থাপত্রও দিতে পারবেন। তবে তিনি বলেছিলেন, সমস্যাটা শুধু বাইরের নয়, চিকিৎসায় অবশ্যই কিছু কাজ হবে; কিন্তু ওই যে ‘হিজড়া স্বভাব’, ওটা যাওয়ার সম্ভাবনা খুব নেই। (স্বভাবের জায়গায় তিনি ‘ফিতরাত’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন)। তিনি সম্পূর্ণ সাফল্যের গ্যারান্টি দিতে পারেননি। মুলাকাত আলি সে সময় যেকোনো খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে প্রস্তুত, আশা পেলেন। ‘স্বভাব’? তিনি বলে উঠলেন, ‘স্বভাব কোনো সমস্যা নয়। সবারই এ রকম ও রকম—কোনো না কোনো স্বভাব আছে...স্বভাব সব সময়ই সামলানো যায়।’

যদিও ডা. নবির কাছ থেকে ফিরে মুলাকাত আলি তাঁর সমস্ত ধ্যানজ্ঞান, সব শক্তি একদিকেই নিবদ্ধ করলেন: সার্জারির জন্য কীভাবে টাকা জোগাড় করা যায়। একই সঙ্গে আফতাবের মধ্যে পুরুষালি চিন্তা জাগাতে তিনি শুরু করেছিলেন সাংস্কৃতিক প্রকল্পও। কবিতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা তিনি আফতাবকে দিলেন, অন্যদিকে ঠুমরি ও চৈতি গাইতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। গভীর রাত পর্যন্ত আফতাবকে তাঁদের যুদ্ধবাজ পূর্বপুরুষের আর যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের বীরত্বের গল্প শোনাতেন তিনি। তাতে অবশ্য আফতাব খুব একটা গা করত না। কিন্তু যখন চেঙ্গিস খান কীভাবে একা হাতে অন্য গোত্রের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে নিজের প্রেমিকাকে উদ্ধার করেছিলেন—সেই গল্প শুনত, সে চাইত ওই প্রেমিকা নারী হতে।

ওর ভাইবোনেরা যখন স্কুলে যেত, আফতাব ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচের চিটলি কবর—বকরির একটা ছোট্ট মাজার আর এর পাশের ব্যস্ত রাস্তা, যা মতিয়ামহলে মিশেছে, তার দিকে তাকিয়ে থাকত।

বসন্তের এক সকালে এক লম্বা, লঘু-নিতম্বিনী নারীকে দেখতে পেল আফতাব। পরনে তার গাঢ় লিপস্টিক, সোনালি হাই-হিল আর উজ্জ্বল, চকচকে সবুজ স্যাটিন সালোয়ার কামিজ। আফতাব ওই লিপস্টিক পরা নারীর মতো আর কাউকে কখনো দেখেনি। সে খাঁড়া সিঁড়ি দিয়ে তিরবেগে নামল, যখন সেই নারী খাসির পায়া, চুলের ক্লিপ, পেয়ারা কিনছিল আর তার স্যান্ডেলের ফিতা লাগাচ্ছিল।

ও সেই নারী হতে চেয়েছিল।

সেই তুর্কমান গেট পর্যন্ত ও তার পিছু পিছু গেল; আর ওই যে নীল দরজার ভেতরে সে হারিয়ে গেল, তার বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল আফতাব।

কোনো সাধারণ নারীর অমন পোশাক পরে শাহজাহানাবাদের রাস্তা ধরে ওভাবে শাঁ-শাঁ করে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। ওই নারী ওরকম পোশাক পরতে পারত, ওইভাবে হাঁটতে পারত, কারণ সে নারীই ছিল না। সে যা ছিল, আফতাব তা-ই হতে চেয়েছিল। ওই নারীর মতো সে-ও তার রাঙানো নখওয়ালা আর চুড়িভরা হাত বাড়িয়ে মাছের কানকো আলতো করে তুলে দামদস্তুর করার আগে মাছটা কত তাজা, তা দেখতে চেয়েছিল। রাস্তায় জমে থাকা জলের ওপর দিয়ে যেতে সে তার সালোয়ারটা ততটুকুই ওঠাতে চেয়েছিল, যতটুকুতে ওর রুপার নূপুরজোড়া দেখা যায়।

আফতাবের বালিকা-অঙ্গটা শুধুই একটা বাড়তি অংশ ছিল না।

নীল দরজাওয়ালা যে বাড়িতে ওই দীর্ঘাঙ্গিনী থাকত, তার বাইরে ঘুরঘুর করত আফতাব। ও জানল যে সেই নারীর নাম বোম্বাই রেশম। আর ওখানে ওর মতো আরও সাতজন থাকে। ওদের একজন ওস্তাদ ছিলেন, ওদের গুরু—কুলসুম বাই। ওদের সবার বড়, পরিবারের কর্ত্রী। আফতাব জানল, এই বাড়ির নাম ‘খোয়াবগাহ’—স্বপ্নপুরি।

প্রথম দিকে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হতো, কারণ খোয়াবগাহর বাসিন্দারাও মুলাকাত আলিকে চিনত এবং তাঁকে চটাতে চায়নি। কিন্তু আফতাব নাছোড়। কয়েক মাস ধরে ওদের এটা-ওটা করে দিয়ে, ব্যাগ, বাদ্যযন্ত্র টেনে দিয়ে, ওদের পা টিপে দিয়ে শেষ পর্যন্ত খোয়াবগাহতে ঢোকার অনুমতি পেল আফতাব।

খোয়াবগাহতে আফতাবের প্রথম আসল বন্ধু হয়েছিল নিম্মো গোরখপুরি। আফতাবকে সে শুধাল, ‘জানিস, কেন ঈশ্বর হিজড়াদের বানিয়েছেন?’

‘না, কেন?’

‘এটা একটা পরীক্ষা। তিনি ভেবেছেন, এমন কিছু একটা তৈরি করি—মানে একটা জীবন্ত কিছু—যে কোনো দিন সুখী হতে পারবে না। তাই আমাদের বানিয়েছেন।’

কথাটা আফতাবের শরীরে ঘুষির মতো লাগল, ‘কী বলো? তোমরা সবাই খুশি এখানে! এ তো খোয়াবগাহ!’

আফতাব প্রচণ্ডভাবে চাইছিল নিম্মোকে বলতে যে ও ভুল বলছে, কারণ সে খুশি, এত খুশি সে জীবনেও হয়নি। নিম্মো যে ভুল, সে নিজেই তার জীবন্ত প্রমাণ।

নিম্মো কী বোঝাতে চেয়েছিল, তা আফতাব বুঝল চৌদ্দ বছর বয়সে। ওর শরীর হঠাৎই ওর সঙ্গে যুদ্ধ করে বসল। লম্বা আর পেশিবহুল হয়ে গেল সে। মুখে দাড়ি গজালে ও আতঙ্কিত হয়ে বার্নল আর বোনদের হেয়ার রিমুভার দিয়ে সব মুছতে গিয়ে ধরা পড়ল। ওর গলায় দেখা দিল উঁচু কণ্ঠাহাড়, যা ওঠা-নামা করত। ও চাইত গলা থেকে ওটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। তারপর সবচেয়ে নির্দয় পরিবর্তন, যার জন্য ওর কিছুই করার ছিল না—গলা ভেঙে গেল। ওর মিষ্টি, তীক্ষ্ণ স্বরের জায়গা দখল করে নিল একটা মোটা, পুরুষালি কণ্ঠস্বর। চুপচাপ হয়ে গেল সে। নেহাত ঠেকে না গেলে কথা বলতে চাইত না। গান গাওয়া বন্ধ করল। গান যখন আফতাবকে ছেড়ে গেল, সাধারণ মানুষ যাকে আসল পৃথিবী বলে জানে, হিজড়ারা যাকে বলে ‘দুনিয়া’, সেখানে আর থাকার কোনো কারণ দেখল না সে।

এক রাতে কিছু টাকা আর বোনদের সুন্দর জামাগুলো চুরি করে খোয়াবগাহে চলে গেল আফতাব। এভাবেই পনেরো বছর বয়সে তার বাড়ি—যেখানে ওর পরিবার কয়েক শতাব্দী ধরে আছে—সেখান থেকে মাত্র পনেরো শ গজ দূরে একটা সাধারণ দরজা দিয়ে অন্য এক জগতে প্রবেশ করল আফতাব। রাতে একটা ছোট অনুষ্ঠানে খোয়াবগাহের সবুজ ওড়না পরিয়ে দিয়ে রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে হিজড়া-সমাজে তুলে নেওয়া হলো ওকে। আফতাব হলো আনজুম, ওস্তাদ কুলসুম বাইয়ের দিল্লি ঘরানার শিষ্য। জাহানারা বেগম আর কখনোই ওর ওখানে যায়নি, যদিও ওদের প্রায়ই দেখা হতো হজরত সারমাদ শাহিদের দরগায়। কখনো কখনো ওরা অনেকক্ষণ একজন আরেকজনের হাত ধরে রাখত। মুলাকাত আলি তাঁর পুত্রের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। আনজুমের সঙ্গে কখনোই তিনি দেখা করেননি, কথাও বলেননি।

পরের বছরগুলোতে আনজুম ছিল দিল্লির সবচেয়ে বিখ্যাত হিজড়া। খোয়াবগাহতে থাকতে শুরু করে আনজুম। শেষ পর্যন্ত সে যে রকম পোশাক পরতে চায়—গয়না, পুঁতি বসানো মোলায়েম কুর্তা, প্লিট দেওয়া পটিয়ালা সালোয়ার, শারারা, ঘারারা, রুপার নূপুর, কাচের চুড়ি আর ঝোলানো কানের দুল। নাক ফুঁড়িয়ে একটা পাথরের নাকছাবি পরত সে, চোখে কাজল, আর নীল আইশেড এবং ঠোঁটে দিয়েছিল মধুবালার ধনুকের আকৃতির মুখের মতো চকচকে লাল লিপস্টিক। বোম্বাই রেশমের মতন সুন্দরী ছিল না আনজুম; কিন্তু আরও সেক্সি ছিল, আরও আকর্ষণীয়—যেমন কোনো নারী হতে পারে। ওর ওই চেহারা একই সঙ্গে আরও উদ্ভাসিত, দুঃসাহসী রকম নারীত্বের পাশে এলাকার আসল যে নারীরা—এমনকি যারা পুরো বোরকাও পরত না—তাদেরও অস্পষ্ট আর দিশেহারা করে দিত। আনজুম নিতম্বকে একটু বেশি দোলানো শিখে গেল। পাশাপাশি শিখে গেল হিজড়াদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তালি—যা বন্দুকের আওয়াজের মতো ফুটত। যার অনেক অর্থই হতে পারে—হ্যাঁ, না, হয়তো অথবা অশ্রাব্য কিছু। শুধু আরেকজন হিজড়াই বুঝতে পারে কোন তালির কী অর্থ।

আনজুমের আঠারোতম জন্মদিনে কুলসুম বাই খোয়াবগাহে ওর জন্য পার্টি দিলেন। সারা শহরের হিজড়ারা জড়ো হলো। জীবনে প্রথমবারের মতো শাড়ি পরল আনজুম—একটা লাল ডিসকো শাড়ি, সঙ্গে পিঠখোলা চোলি। সে রাতে ওর মনে হয়েছিল, সে বিয়ের রাতের নববধূ। ও সজাগ হয়ে দেখল, ওর যৌনসুখ ওর পোশাকের ভেতর থেকে ফুঁড়ে বেরোচ্ছে পৌরুষত্বের রূপ নিয়ে। এটা যে প্রথমবারের মতো হচ্ছে তা নয়; কিন্তু কোনো কারণে—হয়তো শাড়ির কারণে—যে লজ্জাটা ও পাচ্ছিল, তা ছিল খুব তীব্র। উঠোনে বসে নেকড়ের মতো গোঙাচ্ছিল সে। ওর দুই পায়ের মাঝখানে আর নিজের মাথায় আঘাত করছিল, আর নিজেকে দেওয়া ব্যথায় নিজেই চিৎকার করছিল।

আনজুম শান্ত হলে কুলসুম বাই নিজের ঘরে ওর সঙ্গে এমন স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন, যেমনটা আগে কখনোই হয়নি, ‘লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই’, ওস্তাদ ওকে বললেন। কারণ, হিজড়ারা সর্বশক্তিমানের পছন্দের মানুষ। পরের ঘণ্টাগুলোতে আনজুম জানল, বুলবুল আর গুড়িয়া—দুজনই হিন্দু, তাই প্রথাগত (প্রচণ্ড বেদনাদায়ক) লিঙ্গ-কর্তন অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে এসেছে ওরা। বোম্বাই রেশম আর হিরা তা-ই করতে চেয়েছিল। তবে যেহেতু তারা মুসলিম, আর ইসলাম বলে আল্লাহর দেওয়া লিঙ্গ না পাল্টাতে। সুতরাং, তারা ভাগ্য মেনে নিয়েছে। কুলসুম বাই নিজে বোম্বাই রেশম আর হিরার সঙ্গে একমত নন। তিনি ও নিম্মো গোরখপুরি সার্জারি করিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি ডা. মুখতারকে চেনেন, যিনি বিশ্বস্ত আর মুখ বন্ধ রাখবেন; আর পুরোনো দিল্লির সব গলি আর কোনাকাঞ্চিতে কথা রটিয়ে বেড়াবেন না। তিনি আনজুমকে ভেবে দেখতে বললেন এবং সে কী করতে চায়—সিদ্ধান্ত নিতে বললেন। সিদ্ধান্ত নিতে আনজুমের পুরো তিন মিনিট লাগল।

ডা. মুখতার ডা. নবির চেয়ে বেশি ভরসার ছিলেন। তিনি বললেন, তিনি পুরুষাঙ্গটা সরিয়ে দেবেন আর ওর যোনিটাকেও বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। তিনি বড়িও দেবেন, যাতে গলার মোটা স্বর কমে আসে আর স্তন গজায়। সার্জারিটা কঠিন ছিল, সেরে ওঠাটা তার চেয়ে আরও কঠিন। তবে দিন শেষে একটা স্বস্তি। আনজুমের মনে হলো, ওর রক্ত থেকে একটা ধোঁয়াশা উঠে গেল আর সে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারল।

অবশ্য দেখা গেল ডা. মুখতারের তৈরি করা যোনিটা আসলে ছিল একটা ভুয়ামি। এটা কাজ করত, কিন্তু যেভাবে তিনি বলেছিলেন সেভাবে না, এমনকি আরও দুটো কারেক্টিভ সার্জারির পরেও না। যদিও আনজুমের ভালোবাসার জন্য সবাই কাঙাল ছিল, সুখ দেওয়ায় যে অত্যন্ত দক্ষ; সেই লাল শাড়ি পরা অবস্থায় পাওয়া সুখই ছিল ওর জীবনের শেষ যৌন আনন্দ। আনজুম ওর তালি দেওয়া শরীর আর অংশত বাস্তবায়িত স্বপ্ন নিয়ে আরও ত্রিশ বছরের বেশি সময় ছিল খোয়াবগাহে।

ছেচল্লিশ বছর বয়সে যখন সে বলল যে ও চলে যেতে চায়, তত দিনে মুলাকাত আলি গত হয়েছেন। জাহানারা বেগম শয্যাশায়ী, ছোট ছেলে সাকিবের সঙ্গে থাকে চিটলি কবরে ওদের পুরোনো বাড়ির এক অংশে। আনজুম মাঝেমধ্যে সেখানে যেতে পারে, তবে থাকার জন্য নয়। খোয়াবগাহে নতুন প্রজন্মের বাসিন্দারা এসে উঠেছে। পুরোনোদের মধ্যে আছে শুধু ওস্তাদ কুলসুম বাই, বোম্বাই রেশম, রাজিয়া আর মেরি।

আনজুমের আর কোথাও যাওয়ার নেই।

দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস থেকেদ্বিতীয় অধ্যায় ‘খোয়াবগাহ’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।