স্মৃতির উত্তরাধিকার

>দেশভাগের পর বাস্তু ত্যাগ করতে হয়েছিল বহু মানুষকে। বিভক্ত বাংলার এক পার থেকে তাঁরা অন্য পারে গিয়েছিলেন নতুন জীবনের খোঁজে। তাঁদের তৃতীয় প্রজন্মের কাছে সেই স্মৃতির উত্তরাধিকারটি কেমন? বাংলাদেশ ও ভারতে চালানো এক গবেষণায় তার রূপ বুঝতে চেয়েছেন লেখক
কলকাতায় নানির বাড়ির সামনে বাংলাদেশের মেয়ে তুনাজ্জিনা শাহরিন। ছবি: লেখক
কলকাতায় নানির বাড়ির সামনে বাংলাদেশের মেয়ে তুনাজ্জিনা শাহরিন। ছবি: লেখক

তুনাজ্জিনা শাহরিন ঢাকা থেকে পাস করা তরুণী চিকিৎসক; আর সঞ্চিতা ভট্টাচার্য কলকাতা নিবাসী গ্রন্থাগারিক। তাঁদের ভেতরে আপাত কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু তাঁদের ভেতরে মিল এক জায়গায়—১৯৪৭ সালে দুজনের পূর্বপ্রজন্মকেই নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে একটি নতুন দেশে এসে বাসা বাঁধতে হয়েছে। ’৪৭-এ বাংলা প্রদেশের ভাগ হওয়ার সাক্ষী যাঁরা, তাঁরা হলেন তাঁদের তৃতীয় প্রজন্ম।
তুনাজ্জিনার নানির পরিবারকে ১৯৪৬-এর কলকাতার দাঙ্গা বাস্তুচ্যুত করেছিল, আর সঞ্চিতার দাদু ও দিদিমা সরাসরি দাঙ্গার মুখে না পড়লেও দাঙ্গার আঁচ তাঁদের সন্তানাদি নিয়ে প্রায় এক বস্ত্রে নড়াইলের গ্রাম থেকে চলে আসতে বাধ্য করে। তুনাজ্জিনা যেমন তাঁর নানির কাছ থেকে নানির ছোটবেলার গল্প শুনেছেন, শুনেছেন ’৪৬-এর দাঙ্গার কথা; গল্প শুনে নিজের মনের ভেতরে তাঁর পূর্বপ্রজন্মের কলকাতার বাড়ির ছবি এঁকেছেন, তেমনি সঞ্চিতা শুনেছেন গ্রামের স্কুলে তাঁর দাদুর প্রধান শিক্ষকতা করার গল্প, শুনেছেন সেই গ্রামের বাড়ির সামনে থাকা মাঠে তাঁর মামার ফুটবল খেলার গল্প, জেনেছেন দাদুর প্রতিবেশীদের নাম।
১৯৪৭ সালের ইংরেজের অধীন ভারত বিভক্ত হওয়ার পর সাত দশক অতিক্রান্ত প্রায়। সেই সময় ভারত বিভক্তির সঙ্গেই দুই টুকরো হয়েছিল সাবেক বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ। ’৪৭-এর ভারত বিভক্তির সময় অকল্পনীয় হিংসা ও হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে এক কোটি কুড়ি থেকে চল্লিশ লাখ মানুষ অতি অল্প সময়ের মধ্যে সদ্য গঠিত পাকিস্তান বা ভারত থেকে—তাদের ভিটেমাটি-জীবিকা থেকে উৎখাত হয়ে ‘নিজের’ দেশ থেকে সদ্য গঠিত ‘নতুন’ দেশে স্থানান্তরিত হয়। এক ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে বাংলা বা পাঞ্জাবের বাসিন্দা হিন্দু, মুসলমান ও শিখরাই এই বিভাগের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।

গোটা বিশ্বের ইতিহাসে এই সংখ্যক মানুষের একসঙ্গে উৎখাত হয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার কোনো নজির নেই। এই ৭০ বছরের মধ্যবর্তীকালে বিভক্ত ভারতের পূর্বভাগ, যা পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত হয়েছিল, সেটি পরবর্তী ২৫ বছরের কম সময়ের ভেতরে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ।
’৪৭-এর ভারত বিভাগ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিশদ ইতিহাস এর মধ্যে লেখা হয়েছে। একই সঙ্গে কেন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে সেই ঘটনাগুলো ঘটেছিল, তার সবিস্তার বিশ্লেষণও করেছেন ঐতিহাসিক আর সমাজবিজ্ঞানীরা। সাম্প্রতি বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য এই দুই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের কিছু কথ্য ইতিহাস নথিবদ্ধ ও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু যা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি, রচিত হয়নি তার কথ্য ইতিহাস—সেটি হলো বিভাগ-পরবর্তী সময়ের প্রজন্ম; বিশেষত তৃতীয় প্রজন্মের ভেতরে সেই বিভাগের স্মৃতি এবং ওই সংক্রান্ত আবেগ—তা সে ভালো-মন্দ যা-ই হোক—কতটা প্রবাহিত হয়েছে, এ নিয়ে কোনো গবেষণা বা কথ্য ইতিহাস লেখা হয়নি। ঢাকা ও কলকাতার গ্যেটে ইনস্টিটিউট পরিচালিত এই নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে ২০১৫ সালে ‘স্মৃতির উত্তরাধিকার’ নামে যে গবেষণা করা হয়, সেই সূত্র ধরেই তুনাজ্জিনা ও সঞ্চিতার প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করছি।
শুধু তুনাজ্জিনা ও সঞ্চিতা নয়, গবেষণায় আরও ১৮ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, যাঁদের পূর্বপ্রজন্মকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। মোট ২০টি সাক্ষাৎকার থেকে কিছু বিশেষ ধারা ও বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যায়।
বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভারত ভাগ, বিশেষত বাংলা ভাগের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করার কারণে দেশভাগ ও দাঙ্গার সরাসরি শিকার মানুষদের সঙ্গে নানান সময় কথাবার্তা বলার সুযোগ ঘটেছে আমার। সেই সব আলাপচারিতার সময় খেয়াল করেছি, হিন্দুদের মুসলমানের প্রতি আর মুসলমানদের হিন্দুর প্রতি কখনো কখনো দ্বেষ বা রাগের প্রকাশ ঘটেছে। তবে বহু বছর পার হওয়ার কারণে ওই দ্বেষ-রাগ অনেকটাই স্তিমিত। ‘স্মৃতির উত্তরাধিকার’ গবেষণার সময় ধারণা করেছিলাম, তৃতীয় প্রজন্মের ভেতরও হয়তো তেমন মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ করা যাবে। কিন্তু এই তৃতীয় প্রজন্মের তারুণ-তরুণীদের অনেকেই তাঁদের পূর্বপুরুষকে যে হিংসার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তার বর্ণনা বা পরিবারের কোনো সদস্যের হত্যার বিবরণ দিলেও তাঁদের ভেতর অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো দ্বেষ-রাগের প্রকাশ দেখিনি।
দেশ বিভাগের ভেতর দিয়ে গেছেন এমন অনেকেই কখনো কখনো পুরোনো দিনের কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হন। কিন্তু প্রায় ৭০ বছর পর তৃতীয় প্রজন্মের কাছে দেশভাগ এখন একটি ঐতিহাসিক সত্য এবং তাঁরা এখন যে যে দেশে আছেন, সেই দেশের নাগরিক হিসেবেই পরিচিত হতে চান। তাঁদের কাছে পিতামহ-মাতামহ, পিতামহী-মাতামহীদের দেশ বা তার গল্প গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেই দেশকে এখন আর নিজের দেশ বলে মনে করেন না তাঁরা।
আবশ্য দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার সময় সবাই বলেন যে সীমানায় নিয়মকানুন শিথিল হলে তাঁরা নিজেদের পূর্বপুরুষের বাড়িঘর দেখতে যেতে পারেন কিংবা অন্য দেশে থেকে যাওয়া বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন, বাড়াতে পারেন যোগাযোগের গভীরতা। মোদ্দা কথা, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ আছে সবারই।
পূর্ব থেকে পশ্চিম কিংবা পশ্চিম থেকে পূর্ব বাংলার—যে দিক থেকেই তাঁদের পূর্বপুরুষেরা অন্য দিকে যান না কেন, তৃতীয় প্রজন্ম নিজেদের অজান্তেই একটি বিশেষত্ব বহন করছেন। সেটি হলো আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক প্রভাব। এর মধ্যে যেমন আছে বাচনভঙ্গি, তেমন রয়েছে পোশাক-আশাক, খাদ্য—সবকিছুই। এমনকি এই বিশেষত্ব যে তাঁরা বহন করছেন, তৃতীয় প্রজন্মের মানুষেরা সহজে এটা চিহ্নিতও করতে পারেন। এখন যেসব সমাজে তাঁরা বাসবাস করছেন, তার চারদিকের মানুষজন তাঁদের যে একটু অন্য চোখে দেখেন—ব্যাপারটি নিয়ে যে তাঁরা সচেতন, তাঁদের কথায় এর প্রমাণ মেলে। যেমন পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা পরিবারগুলোকে স্থানীয়রা ‘বাঙাল’ বলে কিছুটা হেয় করে থাকেন; একইভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় যাওয়া মানুষকে ‘ঘটি’ বলে কটাক্ষ শুনতে হয় এখনো। পূর্ব বাংলা থেকে আসা মানুষকে কলহপ্রিয় বা ‘দজ্জাল’ বলে পরিচিতি দেওয়া হয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গে। আবার পূর্ব বাংলা—যা এখন বাংলাদেশ—সেখানে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ভেতর ‘হিন্দুয়ানি’র প্রভাব আছে। এ সবই তৃতীয় প্রজন্ম নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন। এমনকি ধর্ম এক হলেও পূর্ব বাংলা থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারীরা—অর্থাৎ হিন্দু উদ্বাস্তুরা চান তাঁদের ছেলে বা মেয়েদের বিয়ে হোক তাঁদেরই মতো বাঙালদের সঙ্গেই। ঠিক তেমনটি ঘটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় আসা মুসলমানদের ভেতরও। সম্ভবত পারিবারিক বা সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা বজায় রাখার প্রবণতা থেকেই এটি ঘটে।
আরেকটি বৈশিষ্ট্য নজর করার মতো—এই গবেষণায় ভারত-বাংলাদেশে বসতি স্থাপনকারী অনেকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের সাক্ষাৎকারগুলোতে গল্প আছে অনেক বেশি এবং সেগুলো অনেক বিশদ। তাতে খুঁটিনাটি বর্ণনা অনেকটাই বেশি। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই যে ’৪৭ বা তৎপরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব মুসলিম পরিবার পূর্ব বাংলায় এসেছে, এদের অধিকাংশেরই পরিবারের কেউ না কেউ ভারতে থেকে গিয়েছিলেন। এই পরিবারগত যোগাযোগ থাকার কারণেই হয়তো বাংলাদেশ থেকে পাওয়া সাক্ষাৎকারগুলোতে অনেক বেশি তথ্য ও পারিবারিক গল্প এসেছে।

নড়াইলে দাদুর গ্রামে সোনা মিয়ার সঙ্গে কলকাতার সঞ্চিতা ভট্টাচার্য
নড়াইলে দাদুর গ্রামে সোনা মিয়ার সঙ্গে কলকাতার সঞ্চিতা ভট্টাচার্য

তা ছাড়া বাংলাদেশের দিকে গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো উর্দুভাষী বাংলাদেশিদের সাক্ষাৎকার। ’৪৭ বা তার পরপর পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব ভারতের বিহার প্রদেশ থেকে বহু উর্দুভাষী মুসলমান এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে। তাঁদের একটি বড় অংশ এসেছিলেন কলকাতা ও বিহারের রাজধানী পাটনার দাঙ্গার শিকার হয়ে। বাঙালি মুসলমানের কাছে এই উর্দুভাষীরা ‘বিহারি’ বলে পরিচিত ছিলেন। ’৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় উর্দুভাষী বা বিহারিদের একটি অংশ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়, রাজাকার বাহিনী গঠন করে বাঙালি নিধনে অংশগ্রহণ করে।
’৭১-এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাঙালি নিধনে অংশ নেওয়া বিহারিদের অপরাধের দায় চাপে সমগ্র উর্দুভাষী বিহারিদের ওপর। ’৪৭-এর পর ’৭১-এ এই গোষ্ঠী আবার দ্বিতীয়বারের মতো উদ্বাস্তু হয়। সুতরাং তাঁদের সাক্ষাৎকারে স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে অগ্রজদের কাছ থেকে শোনা ১৯৭১-এর গল্প। তাঁরা যেমন ১৯৪৭-এ তাঁদের পরিবারের দাঙ্গা চাক্ষুষ করার গল্প বলেন, তার চেয়ে বেশি বলেন ১৯৭১ ও তার পরবর্তী সময়ে নানান উদ্বাস্তু ক্যাম্পে কষ্টকর জীবন কাটানোর অভিজ্ঞতার কথা। ’৭১ থেকে একটি নাগরিকত্বহীন পরিস্থিতি থেকে কী করে নিজেদের উর্দুভাষী বাংলাদেশি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, তার বর্ণনাও উঠে এসেছে অনেকের সাক্ষাৎকারে। ’৭১ বা তারপর থেকে যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হয়েছে, এর সঙ্গে আপাতভাবে ’৪৭-এর ভারত ভাগের সরাসরি যোগ নেই—এমন মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু ১৯৪৬-’৪৭-এর দাঙ্গা ও ভারত ভাগ না হলে তাঁদের ’৭১-এর অভিজ্ঞতা হতোও না। ’৪৭-এর উদ্বাস্তু হওয়ার কারণেই তাঁদের ফের ’৭১-এর উদ্বাস্তু হতে হয়।
এবার আবার ঢাকার তুনাজ্জিনা ও কলকাতার সঞ্চিতার গল্পে ফেরা যাক। নানির কাছ থেকে তাঁর শিশু বয়সের কলকাতা শহরের বাড়ি এবং কী পরিস্থিতিতে তাঁদের সেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল, তার বর্ণনা শুনলেও কখনো কলকাতায় এসে নানির ছোটবেলার বাড়ি দেখার সুযোগ হয়নি তুনাজ্জিনার।
একইভাবে কলকাতায় সঞ্চিতাও তাঁর দাদু ও দিদার কাছে তাঁদের নড়াইলের মল্লিকপুর গ্রামের গল্প শুনেছেন। কিন্তু তাঁরও কখনো সুযোগ ঘটেনি মল্লিকপুরে আসার। এই গবেষণার অংশ হিসেবে তুনাজ্জিনা আর সঞ্চিতা তাঁদের নানি এবং দাদু ও দিদার ‘বাড়ি’ দেখার সুযোগ পান। এই অভিজ্ঞতা যে তাঁদের বিপুলভাবে আবেগতাড়িত করেছিল, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
কলকাতায় নানির আদি বাড়ি দেখার পড় তুনাজ্জিনা লেখেন, ‘ছাদটা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। অযত্নে একেবারেই জরাজীর্ণ অবস্থা, যদিও ছাদের চিলেকোঠা দুটো মোটামুটি এক রকম আছে। একটা ঘরে পাখি পালন করেন বাড়ির মালিক, অন্যটি বন্ধ ছিল। ছাদের এক পাশে মাটির ভাঙা বাসন স্তূপ করে রাখা। ছড়ানো-ছিটানো কিছু ফুলের টব। পাঁচিলের গায়ে একটা পুরোনো ডালিম গাছ দেখতে পেলাম। অনেকটা বনসাইয়ের মতো লাগছিল দেখতে। বেশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম।’
১৯৫০ সালে যখন তুনাজ্জিনার নানি আশরাফি বেগমের সদ্যবিধবা মা কলকাতা ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিন মেয়ের মধ্য থেকে দ্বিতীয় মেয়ে সাফদারি বেগমকে তিনি রেখে এলেন কলকাতায়, তাঁর সন্তানহীনা জায়ের কাছে। তো এই কলকাতা ভ্রমণের মাধ্যমে তুনাজ্জিনা তাঁর ‘মেজ নানু’র পরিবারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন এবার।
আর সঞ্চিতা নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লেখেন, ‘বাংলাদেশে আসার আগের কদিন আমি ঘুমতে পারিনি। আমার দাদুভাই, দিদা, মাসি ও মামাদের কাছ থেকে শোনা জায়গাগুলো দেখতে পাব ভেবে আমার উত্তেজনার শেষ ছিল না।’
নড়াইলের মল্লিকপুরের রাস্তায় সঞ্চিতার সঙ্গে আচমকা দেখা হয় অশীতিপর সোনা মিয়ার। সঞ্চিতার ‘দাদুভাই’ অর্ধেন্দু শেখর ভট্টাচার্যের নাম শুনে সোনা মিয়া তাঁকে জানান, তাঁর বাবা পোজো মিয়া অর্ধেন্দু শেখরের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ে পড়াতেন। অর্ধেন্দু শেখর ছিলেন প্রধান শিক্ষক আর পোজো মিয়া তাঁর সহকারী। অতি দ্রুত সোনা মিয়া হয়ে ওঠেন সঞ্চিতার ‘সোনা দাদু’। অর্ধেন্দু শেখরের নাতনি সঞ্চিতাকে দেখে আবেগে সোনা মিয়ার চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে। ‘সোনা দাদু’ সঞ্চিতাকে বাড়িতে নিয়ে যান। আর সেখান থেকে রওনা দেওয়ার আগে সোনা মিয়া নিজের বাগানের চারটে আম দেন সঞ্চিতাকে। তাঁর চাওয়া, এ আমগুলো নিয়ে কলকাতার বাড়িতে ফিরে সঞ্চিতা মা-মাসি-মামাদের যেন বলতে পারেন তিনি তাঁর দাদু-দিদার গ্রামের ফল নিয়ে এসেছেন।
১৯৪৬-এর দাঙ্গা ও পরের বছরের দেশভাগ সপরিবার মল্লিকপুর ছাড়তে বাধ্য করেছিল অর্ধেন্দু শেখরকে। এর ৭০ বছর পর অর্ধেন্দু শেখরের নাতনি সঞ্চিতা সেই মল্লিকপুরে গিয়ে তাঁর ‘দাদুভাই’য়ের সহকর্মীর ছেলে সোনা মিয়াকে দাদু ডেকে ফেললেন, কয়েক মুহূর্তের ভেতর দুই অনাত্মীয় আত্মীয় হয়ে উঠলেন অনায়াসে।