ধাবমান

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে এপিক অ্যাকটরস নাট্যদল প্রদর্শিত ধাবমান নাটকের দৃশ্য
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে এপিক অ্যাকটরস নাট্যদল প্রদর্শিত ধাবমান নাটকের দৃশ্য

সেই সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে ছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, বাংলা সাহিত্যে মানুষ ও পশুর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর কাহিনি রচিত হয়েছে। মানুষ ও পশুর সম্পর্ক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের একটি গল্পে এমন একটি দৃশ্য আছে: ছোট্ট এক বালিকা মস্ত এক গাভির খুটো ধরে টানছে আর বলছে, এই পুটি, আয় না।

শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, বাংলা সাহিত্যে পশু ও মানুষের গল্প অনেকেই লিখেছেন। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিনী’ অথবা শরৎচন্দ্রের ‘গফুর’-কে মনে করে আমাদের চোখে এখনো জল আসে। বিশ্বসাহিত্যে এই একই বিষয়ে বিস্তর অসাধারণ গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। যেমন, মেলভিলের ক্রুদ্ধ শ্বেত তিমি মাছ ও মানুষের লড়াই নিয়ে লেখা উপন্যাস মবিডিক। অথবা অ্যানাসেওয়েলের ব্ল্যাকবিউটি, যাকে একটি অশ্বের আত্মজীবনী বলে ভাবা হয়। পৌরাণিক সাহিত্যেও মানুষ ও পশুর সম্পর্ক নিয়ে গল্পের অভাব নেই। আধুনিক সময়ে ডিজনি ফিল্মসের কল্যাণে আমরা বিস্তর কার্টুন ছবি পেয়েছি। যেমন, লায়ন কিং। এখানে পশু কেবল কথাই বলে না, মানুষের মতো ভাবেও; এবং তার রাগ-বিরাগ সবই মানুষের মতো।

ধাবমান শুধু মানুষ ও পশুর সম্পর্কের গল্প নয়। এই নাটক অন্য একটি বাস্তবতার প্রতিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেটি হলো—পশু ও মানুষ পাশাপাশি বাস করবে, সেটাই স্বাভাবিক। একসময় মানুষ এভাবেই বাস করত, অনেক ক্ষেত্রে এখনো করে। কিন্তু পশুর চেয়ে মানুষ অনেক বেশি শক্তিশালী, তার হাতে রয়েছে মারণাস্ত্র, চাইলেই সে যেকোনো পশুকে নিধন করতে পারে। তাই এই পশু যদি আমাদের নিকটাত্মীয়ই হবে, তাহলে তাকে হত্যা নয়—তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আমাদের।

সম্প্রতি নিউ জার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মঞ্চে ধাবমান মঞ্চস্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নাট্যদল এপিক একটরস ওয়ার্কশপের উদ্যোগে। নির্দেশনা দিয়েছেন নিউইয়র্ক-নিউ জার্সির সুপরিচিত নাট্যাভিনেতা ও সংগঠক গোলাম সারোয়ার হারুন। প্রবাসের—প্রধানত অপেশাদার শিল্পীদের নিয়েও এমন একটি জটিল নাটকের সফল মঞ্চায়ন যে সম্ভব, এপিক সে কথাই প্রমাণ করল। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও প্রমাণিত হলো, প্রবাসে-এই ‘তৃতীয় বাংলা’য় নাট্যচর্চা সাবালকত্বপ্রাপ্ত হয়েছে।

ধাবমান নাটক হিসাবে নয়, কথাকাহিনি হিসেবে লিখেছিলেন সেলিম আল দীন, অপূর্ব কাব্যময় ভাষায়। নিজেকে হয়তো সে কারণে তিনি কথক-কবি হিসেবে সম্বোধন করেছেন। স্বচ্ছ পাহাড়ি জলধারার তীব্র গতিময়তায় নির্মিত এই কাহিনি আমাদের একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে মনুষ্য সমাজের নৈকট্য ও দূরত্ব বিষয়ে সচেতন করে, মিটিয়ে দেয় এই দুইয়ের মিল ও অমিল সম্বন্ধে আমাদের ধন্ধ।

গল্পের ভেতরে প্রবেশ করামাত্র আমরা পরিচিত হই দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে। তারা যথাক্রমে মানুষ ও প্রাণী—একদিকে নহবত, তার স্ত্রী সুবতী ও তাদের একমাত্র বিকলাঙ্গ পুত্র এসহাক, অন্যদিকে হামেলা ও তার পুত্র সোহরাব—যেন একান্নবর্তী একটি পরিবার—তারা একে অপরের সুখে সুখী, দুঃখে দুখী।

সোহরাব স্বাস্থ্যবান ও বীর, মোষের লড়াইতে সারা গ্রামে সে সেরা। এতে ঈর্ষা জাগে বিকলাঙ্গ পুত্র এসহাকের। একটি কল্পিত স্বপ্নের কথা বলে সে দাবি করে সোহরাবকে বিসর্জন দিলে তার পা নিরাময় হবে। বিস্মিত সোহরাবের মা হামেলা নহবতকে বলে, ছিঃ মানুষ! আমারও তোমার মতোই একটা পুত্র। তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হয় নহবত ও সুবতী, হায় হায় আওয়াজ তোলে তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। মাংসের গন্ধ পেয়েছে লোভী কসাইয়ের দল, উদ্যত ছোরা হাতে তারা ঘিরে ধরে সোহরাবকে। নহবত আর্তচিৎকার করে, ‘বাপ হয়্যা যদি পুত্রের মাংস না খাই, তবে আমাগো নাম মানুষ কেন?’ সোহরাব শেষবারের মতো তার মানবভ্রাতা এসহাকের শরীরের গন্ধ নেয়। গৃহপালিতের মৃত্যু তার পালনকারীর হাতে—এই অভিশাপ মানুষ ও পশু উভয়েই মেনে নেয়। যারা তাকে রক্ষা করবে বলে কথা দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তাঁদের হাতেই নিহত হয় সোহরাব।

কাহিনি হিসেবে মবিডিকের মতো তীব্র অন্তর্বিরোধিতা হয়তো এই গল্পে নেই, কিন্তু আছে এক ভিন্ন নৈতিক দাঢ্যতা। মেলভিলের কাছে শুভ ও অশুভের লড়াই-ই ছিল মুখ্য—যে শুভ-অশুভের নির্ধারণ হয়েছে নীতিশাস্ত্র দ্বারা। কিন্তু ধাবমানের বিবেচনা অন্যত্র—পশু অশুভ নয়, মানুষই অশুভ—এই উপলব্ধি। পশুকে মানুষের সম্মান দেওয়ার জন্য যে অন্তর্দৃষ্টি চাই, চাই যে নৈতিক দৃঢ়তা, মেলভিল সেই দৃঢ়তা অর্জন করতে পারেননি। যা অর্জিত হয়েছে ধাবমান আখ্যানে।

ঢাকায় নাটকটি দেখার পর সারা হলঘরে সহর্ষ সাধুবাদ ও উল্লাসধ্বনি শুনেছিলাম। নিউ জার্সির নাট্যমঞ্চে ছিল প্রায়-স্তব্ধতা। পরিণত বয়সের মানুষদের আমি দেখেছি চোখের জল মুছতে। দুই বাক্‌রুদ্ধ তরুণীকে দেখেছি একে অপরকে ধরে সান্ত্বনা দিতে। যেন সোহরাব একটি বাক্‌হীন পশু নয়, তার মৃত্যুতে আমাদের সবার খুব কাছের—খুব প্রিয় একজনকে আমরা হারিয়েছি।

ঢাকায় ঢাকা থিয়েটার থেকে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন শিমূল ইউসুফ। খুব সাহসী কাজ করেছিলেন তিনি। সোহরাবের ভূমিকায় বেছে নিয়েছিলেন একটি মেয়েকে—(সম্ভবত তাঁরই কন্যা)। মোষটিকে তিনি এতটাই স্বাভাবিক মানুষের মতো উপস্থিত করেছিলেন যে অনেক সময় এই বোধ থাকে না যে সোহরাব প্রকৃতপক্ষে একটি পশু। সেলিম আল দীনের কাহিনির মূল চেতনার সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।

অপর পক্ষে নিউ জার্সির এই মঞ্চায়নে গোলাম সরোয়ার হারুন সম্ভবত আমাদের ভেতর-বিশ্বাসে অনবরত সূক্ষ্ম কশাঘাত করার জন্য সোহরাবের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন একটি মুখোশ। তাঁর এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দর্শক হিসেবে আমি একমত হতে পারেনি। সেলিম আল দীন যে ধাবমান নির্মাণ করেছেন, তার উদ্দেশ্যই ছিল পশুর মানবিকতা প্রতিষ্ঠা—তার ‘হিউম্যানাইজেশন’। কিন্তু ওই মুখোশের কারণে—আমার মনে হয়েছে—সে মানবিকতা ক্ষুণ্ণ হয়; দর্শকদের অনবরত মনে করিয়ে দেওয়া হয় আনুভূতিক অর্থে সে যত মানবিকই হোক না কেন, সোহরাব আসলে একটি মোষ।

দ্বিতীয়বারের মতো ধাবমান দেখে আমার এ-ও মনে হয়েছে, নাটকটির রচয়িতা সেলিম আল দীন প্রকৃতই একজন বিশ্বমানের নাট্যকার-লেখক। খুব কম বয়সে তাঁকে আমরা হারিয়েছি। এতে বাংলা নাটকের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, খুব সহজে তা পূরণ হওয়ার নয়।