এলাম নতুন দেশে

দ্বিজেন শর্মা (২৯ মে ১৯২৯—১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। রমনা পার্ক, ৪ অক্টোবর ২০১৩; ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
দ্বিজেন শর্মা (২৯ মে ১৯২৯—১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। রমনা পার্ক, ৪ অক্টোবর ২০১৩; ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
নিসর্গী ও লেখক দ্বিজেন শর্মা প্রয়াত হলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এখানে তাঁর প্রকাশিতব্য আত্মজীবনী মধুময়পৃথিবীরধূলি থেকে কিছু অংশ নিবেদন করছি

প্রপেলারওয়ালা প্লেন উড়ে চলছে, আমি ও আমার ছেলে টুটুলের (সুমিত্র শর্মা) পাশে খালেদ চৌধুরী, স্ত্রী হাসিনা ও পুত্র সুমন। বোম্বে (মুম্বাই), তেহরান ও তাসখন্দ হয়ে শেষে প্লেন সকালে নামল মস্কোর শেরেমেতোভা বিমানবন্দরে। এয়ারপোর্টে হাজির হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, হায়াৎ মামুদ ও প্রগতি প্রকাশনের একাধিক কর্মকর্তা। হাসান ও মুতী যথাক্রমে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস ও শিক্ষা অ্যাটাশে। আমরা সকলে গেলাম হাসানের আস্তানায়, সোকলনিকি পার্কে। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজ। বিকেলে হায়াতের সঙ্গে আমি ও খালেদ চৌধুরী এলাম প্রগতি প্রকাশন জুবোফ্‌স্কি বুলভারে। দোতলা কয়েকটি কাঠের ঘর। সামনে উঠান। আমরা বসলাম এক বেঞ্চিতে। কিছুক্ষণ পর এলেন ননী ভৌমিক—ননীদা। আমরা সকলে ওপরে গেলাম বাংলা বিভাগে। রাইসা (রাইসা ভাসিলিয়েভনা) তখনো ঢাকা থেকে ফেরেননি। বিভাগ চালাচ্ছেন ভেরা নিকোলায়েভনা। রুশি কর্মচারী ছাড়া আরও কেউ কেউ ছিলেন, নাম মনে নেই। বিভাগের সাদামাটা ব্যবস্থাপনা আমার ভালোই লাগল। দেখলাম উপস্থিত রুশিদের সকলেই বাংলা জানেন ও বাংলা বলেন। কিছুক্ষণ পর ড. রথীন চ্যাটার্জি এলেন। তিনি বাংলা বিভাগের অন্যতম সম্পাদক। রাশিয়ায় ভূতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং রুশি স্ত্রীসহ এখানেই সংসার পেতেছেন। অনেক গল্প হলো।

ফ্ল্যাট না পাওয়া পর্যন্ত আমরা হাসানের বাড়িতেই ছিলাম। রোজই যেতাম তার সঙ্গে দূতাবাসে। রাষ্ট্রদূত তখন শামসুর রহমান—জনসনদা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি, তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। হাসানের মুখে তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আগেই শুনেছিলাম। তাঁর আন্তরিক আলাপে আমরা মুগ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার সহায়ক ভূমিকা ও পরবর্তীকালে এই সম্পর্ক উন্নয়নের কথা মনে রেখেই তাঁর মতো দেশপ্রেমিক এই চৌকস আমলাকে বঙ্গবন্ধু এখানে পাঠিয়েছেন। একসময় আমি ও খালেদ চৌধুরী ফ্ল্যাট পেলাম রেজানস্কি প্রসপ্রেক্টে। শরৎ এসে গেছে। শীতের ছোঁয়া লেগেছে বনে। গাছের পাতায় রং ধরেছে—হলুদ ও লালের অজস্র মিশ্রণ। রুশিরা বলে ‘সোনালি শরৎ’। মাঝেমধ্যে হালকা বৃষ্টি। পাতা ঝরে তরুতলে রং ছড়ায়। বাচ্চারা পাতা কুড়োয়। ভারি সুন্দর এই দৃশ্য। কাছেই থাকে বিজয় পাল। এককালের সিলেটবাসী, যুবক। বিয়ে করেছে এ দেশে। সে প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদক-সম্পাদক। আমরা এক অক্ষর রুশ জানি না, তাই ঘর থেকে বের হওয়া দুষ্কর। বিজয় আসে, বাজার করা থেকে ডাক্তার দেখানো পর্যন্ত সব দায় মাথায় তুলে নেয়। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে অনেক দিন বিজয় ছিল দিশারির মতো। স্থানীয় লোকেরা খুব ভালো। আমাদের নানাভাবে সাহায্য করতে চায়। দোকানে গেলে টুটুল ও সুমনকে আদর করে। একটি জিনিস বড় অদ্ভুত লাগে। শুক্র-শনিবার বিকেলে অনেককে রাস্তার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। বিজয়কে জিজ্ঞেস করলে বলে, ওরা মদ্যপ—মাতাল। সমাজতন্ত্রের দেশে এত মাতাল? ধন্দে পড়ি।

কিন্তু এভাবে জীবনযাত্রা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। খালেদ বলেন, হায়াৎকে নিয়ে একসঙ্গে কোথাও না থাকলে এ দেশে থাকা যাবে না। আমরা তিনজন গেলাম প্রগতির অফিসে। রাইসা তখনো ঢাকায়। ভেরা দপ্তর চালান। তাঁকে আমাদের সমস্যা বলা হলো। ভেরা সহানুভূতি নিয়ে শোনেন। ব্যবস্থাও হয়ে যায়। আমরা তিন পরিবার কালোমেনস্কায়া আন্ডারগ্রাউন্ড (মেট্রো) স্টেশনের কাছে এক বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাটে উঠে আসি। বাড়ির উঠানেই হাইস্কুল। সামান্য দূরে দেৎস্কিসাদ (শিশুদের প্রাক–বিদ্যালয়)। চমৎকার জায়গা। এক পাশে মস্কো নদী, অন্য পাশে বন। বাড়ির গায়ে লাগানো ট্রামলাইন। নিজেরাই যেতে পারি অফিসে। মেট্রোতে চেপে কালোমেনস্কায়া থেকে পার্ক-কুলতুরি স্টেশন। সেখান থেকে হাঁটাপথে অফিস পাঁচ মিনিট দূরত্বে। ভাড়া ৫ কোপেক। ট্রাম ও বাসেও তাই, তা যত দূরেই যাও।

আমরা হায়াতের সংসারে অতিথি। হায়াতের স্ত্রী ফিরোজা বেগম (খুকু), ছেলে সৌম্য ও মেয়ে লোপাকে নিয়ে সংসার। লোপার জন্ম মস্কোয়। খুকু কিছুটা রাশিয়ান ভাষা শিখেছেন। খালেদের স্ত্রী হাসিনা তাঁর সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, দোকানপাট চেনেন, বাজার করেন। কিছুদিন পর খালেদ তাঁর ফ্ল্যাটে সংসার পাতেন। আমি ও আমার ছেলে সেখানে অতিথি এবং এই ব্যবস্থা চলেছে দেবী (দেবী শর্মা) না আসা পর্যন্ত। কিন্তু সমস্যা হলো খালেদকে নিয়ে। এখানকার কোনো খাদ্যবস্তু তিনি মুখে তুলতে পারেন না। চাল, ডাল, সবজি, মাছ ও মাংসের ঘ্রাণ তাঁর অসহ্য। কী রহস্যগুণ জানি না, হাসান বা মুতী সাহেবের বাড়ি গেলে ভালোই খেতে পারেন। আমরা তাই প্রায়ই ওখানে হাজির হই। হাসান ততদিনে সোকলনিকি থেকে চলে এসেছে মুতী সাহেবের বাড়ির আরেক ফ্ল্যাটে। আমরা গেলে দুই পরিবার একত্র হয়, অবিরাম আড্ডা চলে, তারপর চর্ব্য-চৌষ্যের ভোজ। শীতের সময়ও কতবার গেছি। বরফ পড়ছে অঝোরে। মেট্রো থেকে আমরা হাঁটছি। সবকিছু সাদা—পথ, নিষ্পত্র গাছপালা, বাড়িঘর। খালেদ এমনিতে হাঁটতে চান না, কিন্তু এই বন্ধুগৃহে যাত্রায় তিনি অক্লান্ত, অদম্য।

এ দেশ আমার ভালো লাগে। আবাসিক ভবনগুলো সবই ৯, ১১, ১৬ তলা। প্রচুর গাছগাছালি, উন্মুক্ত এলাকা, রাস্তাগুলো অস্বাভাবিক চওড়া—সব মিলিয়ে ভার্টিক্যাল গার্ডেন সিটি, উল্লম্ব উদ্যান-নগরী। মানুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য চোখে পড়ে না। বাড়িঘর, পোশাক-আশাক দেখে চেনার উপায় নেই কে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, কে কারখানার শ্রমিক। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অতি নগণ্য। দোকানে সবাই লাইন দিয়ে সওদা কেনে। প্রয়োজনীয় সবই পাওয়া যায়, তবে বাহুল্য নেই, খাদ্যবস্তু সস্তা। তিন রুমের ফ্ল্যাটভাড়া ২৫ রুবল, আমাদের টাকায় ৫০ টাকা। পরিবহন—ট্রাম, বাস, ট্রলিবাস; মেট্রো–টিকিটের দাম ৫ কোপেক, তা যত দূরেই যাওয়া যাক। রাস্তাঘাট সবই পরিচ্ছন্ন, ঝলমলে। মানুষের সমতা আমাকে মুগ্ধ করে। যে সমাজের স্বপ্ন আমরা দেখি, মনে হয় এটি হলো সেই সমাজ।

আমাকে প্রথম অনুবাদ করতে দেওয়া হয় মিখাইল নেস্তুখের লেখা রেসেসঅবম্যানকাইন্ড। নৃতত্ত্বের এই বই অন্য অনুবাদকদের কেউই নিতে রাজি হননি। দ্রুত অনুবাদ করে ফেলি, দেশের ছাত্রদের কথা এবং আমার ভাবনায় পাঠ্যবইয়ের ভাষা যেমন হওয়া উচিত, মনে রেখে, সুধীন দত্তীয় গদ্যে। রথীন সেটি সম্পাদনা করেন। পরের বইটি নিকোলাই আমোসভের হৃদয়হৃৎপিণ্ড, এক প্রখ্যাত হার্ট-সার্জনের আত্মজীবনী। সম্পাদনা করেন অলেকজান্দর নিকোলয়েভিচ রুমানভ (সাশা)। তিনিই প্রথম ধরিয়ে দেন যে আমার অনুবাদে অনেক বানান ভুল থাকে। দেশে বিস্তর লিখেছি, বানানের কথা ভাবতে হয়নি, প্রুফ রিডাররাই সেগুলো সংশোধন করতেন। এবার সতর্ক হতে হয়, পাছে সম্পাদকেরা না ভাবতে শুরু করেন, আমি বাংলা জানি না। লক্ষ করেছি, তাঁরা বাংলা বানান খুব ভালো জানেন; কিন্তু রচনাশৈলীর সৌন্দর্য বা বৈশিষ্ট্য তেমন বোঝেন না। অনুবাদ শুদ্ধ হলেই তাঁরা খুশি।

আরেকটি সমস্যা ছিল। অনুবাদের বইগুলো কীভাবে নির্বাচিত হতো, জানার উপায় ছিল না। জিজ্ঞেস করলেই বলা হতো আমাদের দেশ থেকে নাকি অর্ডার আছে। আমরা কলকাতা ও ঢাকায় খোঁজ নিয়ে জেনেছি এটা সত্য নয়। তাঁদের পক্ষে বই নির্বাচনের কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। মনে আছে, অরুণ সোমকে সমাজবিদ্যার একটি বই অনুবাদ করতে দিলে তিনি সেটি অনুবাদ নিষ্প্রয়োজন মনে করেন। অতঃপর বিভাগীয় প্রধান রাইসা ভাসিলিয়েভনার সঙ্গে তাঁর যেসব কথাবার্তা হয় তা নিম্নরূপ:

অরুণ: বইটির অনুবাদ আমাদের দেশে কেউ পড়বে না। সমাজবিদ্যার অনেক ভালো বই বাংলায় আছে।

রাইসা: না অরুণ, বইটি আমাদের অনুবাদ করতেই হবে।

অরুণ: কেন?

রাইসা: ওপর থেকে অর্ডার আছে।

অরুণ: চলুন আমাকে নিয়ে ওপরে। আমি তাঁদের বোঝাব।

রাইসা: না অরুণ, ওখানে যাওয়া যায় না।

অরুণ: বুঝেছি, প্রগতিতে ঈশ্বর আছেন।

রাইসা: মানে?

অরুণ: তাহলে তিনি কে, যার কাছ থেকে অর্ডার আসে অথচ তাঁর কাছে যাওয়া যায় না?

কিন্তু বইটির অনুবাদ ঠেকানো যায়নি। সমস্যাটি কেবল প্রগতি প্রকাশনের নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের গোটা উৎপাদনব্যবস্থার, চরম কেন্দ্রিকতার।

অতঃপর মির প্রকাশনার দুটি বই অনুবাদ করি। কেনআমিবাবারবাবারমতনরসায়নেরশতগল্প। এগুলোর ইংরেজি তরজমা দেশ থেকে সঙ্গে এনেছিলাম। রাইসা রাজি হয়ে যান এবং মির প্রকাশনা থেকে অনুমতি আদায় করেন। আসলে বই নির্বাচনে আমার এই স্বাধীনতার পটভূমিতে ছিল অন্য এক ঘটনা। আমি এত দ্রুত চলে আসতে পারব, কর্তৃপক্ষ ভাবতে পারেনি। তাই আমার জন্য আগে থেকে বই নির্বাচন করে রাখা হয়নি।

কিন্তু সুখদিন শেষ হয়ে এল। আমাকে আনা হলো প্রগতির কর্মসূচির আওতায়। যেসব বই আমাকে দেওয়া শুরু হলো, সেগুলো সবই অর্থনীতি, রাজনীতি, মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলস-লেনিনবিষয়ক। অনুবাদের গতিবেগ কমে এল। উপার্জনও। অধিকন্তু এসে জুটল স্মৃতিকাতরতা। ভালো ঘুম হয় না। স্বপ্নে দেখি কলেজে গেছি, ক্লাস রেজিস্ট্রার খুঁজে পাচ্ছি না। ক্লাসে গেছি, ছাত্র নেই। বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। সিলেটের বাড়ির কথা, বরিশালের কথা। চিঠি পাই বাংলা একাডেমির বাজেট অধিবেশনে যোগ দেওয়ার, যেদিন সারা দেশ থেকে সদস্যরা আসেন, সারা মাঠে আড্ডা চলে, সঙ্গে চা-বিস্কুট, দুপুরে ভূরিভোজ। মনশ্চক্ষে সব দেখতে পাই, সকলে আছে, কেবল আমি নেই। সারা দিনে ২-৩ পৃষ্ঠার বেশি অনুবাদ হয় না। খালেদের অবস্থা আরও খারাপ। সারা রাত অনিদ্রায় কাটান। এক লাইনও অনুবাদ করতে পারেন না। অথচ দেশে অনুবাদই তাঁর পেশা ছিল। কাগজ সামনে নিয়ে সারা দিন কাটাকুটি করেন, স্কেচ আঁকেন। কাজের কাজ কিছুই হয় না। হায়াতের অবস্থাও ভালো না। সে বিদেশি ভাষা ইনস্টিটিউশনে খণ্ডকালীন চাকরি নিয়েছে। আরও নানা কাজে-অকাজে ব্যস্ত থাকে। এমনটি প্রায়ই ঘটে—খালেদ চৌধুরীর ফোন: দ্বিজেনদা, আজ কি টিভিতে ‘ভ্‌মিরে ঝিভোৎিনখ্‌’ (জীবজন্তুর জগতে) হবে। বলি, না, প্রভু। তিনি বলেন, তাহলে চলুন চিড়িয়াখানা ঘুরে আসি। কিংবা হায়াৎ জানায়, কাজে মন বসছে না, চলুন ‘ভেদেনখা’ (অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদর্শনী) যাই। এসব ভ্রমণে অর্থের তেমন প্রয়োজন হয় না। দুপুরের খাওয়াসহ দুই রুবলই যথেষ্ট।

জুন মাসের (১৯৭৫) মাঝামাঝি কন্যা মুন্নিকে (শ্রেয়সী শর্মা) নিয়ে দেবী মস্কো এল। কয়েক দিন খালেদ ও হায়াতের সঙ্গে থেকে আমরা নিজ ফ্ল্যাটে চলে আসি। নামেই যাওয়া। দিনরাত একসঙ্গেই কাটে। তিন বধূ দেবী, খুকু ও হাসিনা, একসঙ্গে দোকানে যান, বাজার করেন, গল্প করেন। ইতিমধ্যে আমার ছেলে সুমিত্র (টুটুল) ও হায়াতের ছেলে সৌম্য আমাদের অফিসের কাছে পার্ক-কুলতুরি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তিন পরিবারের তিনজন—মুন্নি, লোপা ও সুমন গেল দেৎস্কি সাদে। জমজমাট সংসার। অচিরে বন্ধু হিসেবে জুটে গেলেন বিশু দাশগুপ্ত, আগে থেকেই হায়াতের চেনা, মস্কোয় বাঙালির মুশকিল আসান। বাংলাদেশের যেসব আহত মুক্তিযোদ্ধা মস্কোয় চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন, তাঁদের দেখাশোনার ভার ছিল বিশুর ওপর। তিনি তাঁদের আপনজন হয়ে উঠেছেন। এই সূত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে তার অবাধ যাতায়াত এবং রাষ্ট্রদূতসহ অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। অচিরেই বিশু আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠলেন এবং মস্কো ছাড়ার পরও এই বন্ধুত্ব অটুট থাকল। ইতিমধ্যে প্রগতিতে যোগ দিয়েছেন কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও অরুণ সোম। তাঁরা থাকেন মস্কোর অন্য এলাকায়। তাঁরা কালোমেনস্কায় আসেন এবং আমরাও যাই তাঁদের বাড়ি। মেলামেশা ও ফোনালাপের পরিসর বাড়ে। মঙ্গলদার স্ত্রী ঊর্মিলা বউদি ঢাকার মুগদাপাড়ার জমিদারবাড়ির মেয়ে। শীতলক্ষ্যার পারের সেই প্রাসাদ আমি দেখেছি। আমরা অনুরোধ করলে রবীন্দ্রসংগীত শোনান। আজও মনে আছে ‘পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি’ গানটি। তাঁকে বলি, মনে পড়ে, মুগদাপাড়ার বাড়ির কথা? বাড়ি থেকে রাস্তা গেছে শীতলক্ষ্যা পর্যন্ত, সেখানে বিশাল ঘাট। এই বাড়ি এখন কলেজ। অরুণের বাড়িতেও আড্ডা বসে। রুশি স্ত্রী লুদমিলা (লুৎসা) রুশি খাবারেও আমাদের আপ্যায়ন করেন।

দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে স্ত্রী দেবী শর্মা
দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে স্ত্রী দেবী শর্মা

হায়াতের সুবাদে রুশি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেও আমাদের আলাপ হয়। একজন সের্গেই সেরিব্রিয়ান্নি, ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের কর্মী। বাংলা, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা ভালোই জানেন। বাংলাদেশের কিছু সাহিত্যও তিনি অনুবাদ করেছেন। আরেকজন কামা ইয়াকুবলেভা, সোভিয়েত নারী পত্রিকার সম্পাদিকা। চেহারায় প্রাচ্যদেশীয় আঁচ। কামার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে এবং কামার চেষ্টায় খালেদ সোভিয়েত নারী পত্রিকার বাংলা সংস্করণের সম্পাদকের কাজটি পান, যা তিনি খুব সহজেই করতে পারতেন। খালেদ তিন বছরে প্রগতির একটিমাত্র বই (সম্ভবত কমিনটার্নেরইতিবৃত্ত) অনুবাদ করেছিলেন। হায়াৎ দেশে ফেরার পরও সের্গেই ও কামার সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যাহত থাকে এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সের্গেই আসতেন বাংলা অনুবাদ বিষয়ে নানা আলোচনার জন্য। সুফিয়া কামালের সাঝেরমায়া রুশ ভাষায় অনুবাদের ব্যাপারে কামার সঙ্গে তাঁরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কামা আমার লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচিন্তা-বিষয়ক একটি প্রবন্ধ রুশ ভাষায় অনুবাদ করে লিয়েস (অরণ্য) পত্রিকায় ছাপান। তিনি ছিলেন সুফিয়া কামালের কন্যাতুল্য এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ঢাকায় আসেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুব ভোরে নিত্যদিনের মতো রেডিওতে বিবিসি ধরি। এটি আমার নিয়মিত রুটিন। হঠাৎ শুনতে পাই ‘দেয়ার ইজ আ ক্যু ইন বাংলাদেশ, হোয়ার অ্যাবাউট অব দ্য প্রেসিডেন্ট ইজ আননোন।’ বজ্রাহত অবস্থা। খবরটি কয়েকবার শুনি। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নাম ঠাহর করতে পারি না। মণি সিংহ তখন মস্কোয়। তাঁকে ফোন করি। তিনি বলেন:

: কে প্রেসিডেন্ট অইছে?

: কামরুজ্জামান।

: এইটা হইতে পারে না। ভালো করি শুইন্যা কও।

: কিছুক্ষণ পর বলি।

: মোশতাক।

: এইবার ঠিক অইছে।

পরের ঘটনাবলি আমাদের সকলের জানা।

ঘটনাটি ঘটে আমার স্ত্রী আসার এক মাস পর। আমি যে তড়িঘড়ি চলে এসেছিলাম, তার কারণ এই যে আমরা সকলেই তখন অস্থিরতা ও আশঙ্কার মধ্যে দিন যাপন করছিলাম। এটা ছিল আমার জন্য বিদেশ যাওয়ার একমাত্র ও শেষ সুযোগ, যা আর খোয়াতে চাইনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লব জয়ী হলো। সফল হলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্র। পুনর্জন্ম ঘটল দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার। দেশে কী ঘটছে, জানার উপায় ছিল না। কিন্তু মস্কোয় আমরা রুশিদের নানা অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে লাগলাম। সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিবৃত্ত ভালোই জানত। আমার দেশ হলো বাংলাদেশ বললেই তারা মৃদু হেসে বলত, ও মুজিবুর রখ্মান? এখন বলতে লাগল, তোমরা তোমাদের নেতাকে খুন করলে কেন? তোমরা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের দিকে চলে গেলে? কী জবাব দেব? কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল-মুতী দেশে ফিরে গেলেন। আমরা একা হয়ে পড়লাম।

আমাদেরসহ প্রগতি প্রকাশনের বাংলা বিভাগে অনুবাদকের সংখ্যা দাঁড়ায় সাত। বাংলাদেশের আমি, হায়াৎ মামুদ ও খালেদ চৌধুরী এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে ননী ভৌমিক, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, অরুণ সোম ও মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ননীদা ও বিষ্ণুদা অনেক দিনের পুরোনো, বাকিরা নবাগত।

প্রতিটি বই অনুবাদের শুরু থেকে মুদ্রণ শেষ হওয়া অবধি সব পর্যায়ের সময়ের একটা হিসাব থাকত। অনুবাদ বা সম্পাদনায় দেরি হলে এবং বই প্রকাশে বিলম্ব ঘটলে গোটা বিভাগের এক মাসের বোনাস কাটা যেত। বড় একটা কেলেঙ্কারি। এই যৌথ জরিমানায় বিভাগের সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হতো এবং দোষী ব্যক্তিদের অবস্থা হতো অতীব করুণ।

মাসের প্রথমে অনুবাদক ১০০ রুবল আগাম পেতেন। এক মাসের মধ্যে যতটা শব্দ অনুবাদ করেছেন, সেই হিসাবে মাসের উপার্জন নির্ধারিত হতো, তা থেকে অবশ্যই বাদ পড়ত আগাম ১০০ রুবল। প্রতিদিন বইয়ের অন্তত ৫ পৃষ্ঠা অনুবাদ না করলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। সব মিলিয়ে আমাদের কজন—আমি, খালেদ, হায়াৎ ও মঙ্গলাদা মাঝেমধ্যে বিপদেই পড়তাম। মাস শেষে আমরা টাকা ধার করতে যেতাম বিষ্ণুদার কাছে। পুরোনো অনুবাদক, সংসারে কেউ নেই, যথেষ্ট উপার্জন, আমাদের উদারহস্তে ধার দিতেন। মঙ্গলাদা বলতেন, ‘চলো হে, বিষ্ণুর কাছে যাই, নইলে বাড়ি গেলে মুখঝামটা খেতে হবে বউয়ের কাছে।’ একবার হায়াতের বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠান। আপ্যায়নের বিরাট আয়োজন। অনেকেই আমন্ত্রিত। সেদিন আবার মাইনের দিনও। হায়াৎ বলল, ‘দ্বিজেনদা, আমি যাব না। আমার টাকাটা নিয়ে আসবেন। মাইনে শ দুয়েক পাব।’ ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে আমার বেতন নিলাম, চাইলাম হায়াতের টাকা। মেয়েটি খাতার পাতা উল্টে মুচকি হাসল। প্রমাদ গুনলাম। সে খাতা দেখিয়ে বলল, ওর মাইনাস ৫। অর্থাৎ মাস শুরুর ১০০ রুবলও উপার্জন করতে পারেনি। তার এ মাসের উপার্জন ৯৫ রুবল। ফিরে এলাম। দেখি বাসায় পরমোৎসব। হায়াৎ হইহই করে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার হাসিমুখ ম্লান করতে চাইলাম না। চুপ করে থাকলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা গেল না। সে এসে বলল, এনেছেন? বৃত্তান্ত বলতেই হলো। হায়াৎ ম্লানমুখে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, বড় দুঃখ পেলাম, দ্বিজেনদা।

এমন দুঃখের অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই আছে।