শহীদ কাদরীর শুরু থেকে শেষ

>

বইপত্র

শহীদ কাদরী

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৭

৭২ পৃষ্ঠা, দাম: ২০০ টাকা।

গোধূলিরগান, শহীদ কাদরীর শেষতম কবিতার বইটি নিয়ে লিখতে বসে পয়লা যা মনে এল, অকিঞ্চিৎকর এই পুস্তকের মধ্যে বাস করছেন অখণ্ড শহীদ কাদরী! গত শতকের পঞ্চাশ দশকের অন্যতম এ কবির কাব্যজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্বের স্বাক্ষর আছে সদ্য প্রকাশিত বইটিতে।

জানি, কথাগুলো অনেকের কাছে অতিশয়োক্তি মনে হচ্ছে। হওয়ারই কথা। কেননা, কবির চারটি কাব্যগ্রন্থ যখন প্রকাশিত, তখন বর্তমান বইয়ের সাপেক্ষে এ দাবি তোলা যায় কোন মুখে। কিন্তু গোধূলিরগান-এ অন্তর্ভুক্ত কবিতার প্রেক্ষাপট ও কবিতাগুলোর রচনাকাল খেয়াল করলে আমাদের কথার যথার্থতা পাওয়া যাবে বৈকি। যুক্তি-প্রমাণসহ সে কথায় পরে আসছি।

আগে বলে নিতে হবে, গত বছর কবির মৃত্যুর পর কীভাবে পাওয়া গেল এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি। বইয়ের শুরুতে ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা’ নামে কবি সাজ্জাদ শরিফের ছোট্ট একটি ভূমিকা আছে। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন, ‘এ বইয়ের মূল পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন কবিপত্নী নীরা কাদরী। কবির অপ্রকাশিত অনেকগুলো কবিতাও সে পাণ্ডুলিপিতে ছিল। আরও ছিল নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগ্রন্থিত কিছু কবিতা।’ সব মিলিয়েই এই বই। এতে আছে দুটি পর্ব কবির স্বরচিত ২২টি কবিতা এবং ‘ভাষান্তর’ অংশে রয়েছে তাঁর অনুবাদকৃত বিভিন্ন দেশের ৯ কবির ১৩টি কবিতা।

শহীদ কাদরী। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
শহীদ কাদরী। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

শহীদ কাদরীর জীবন ও কবিতা নিয়ে বিচিত্র মিথ আমাদের জানা, আছে তাঁর কবিতা সমন্ধে পূর্বধারণাও-নাগরিক কবি তিনি, নগরমনস্কতা ও মননশীলতা তাঁর কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে ইত্যাদি।

গোধূলিরগানকবিতার বইয়েও এসব বিদ্যমান। কিন্তু আলোচ্য বইটির বিশিষ্টতা অন্যত্র। এখানে উজ্জ্বল হয়ে আছে শহীদের প্রথম জীবনের বেশ কিছু কবিতা। যেমন, ১৯৫৪ (১৩৬০) সালে স্পন্দন পত্রিকায় ছাপা হওয়া ‘জলকন্যার জন্যে’ কবিতাটি: ‘...তবু তো দেখছি আকাশকে আহা, গভীর নীল/ ফাইলের আড়ে কর্মের ফাঁকে দৈবাৎ যদি ছন্দমিল/ আজও পেয়ে যাই, গাঢ় উল্লাসে নেচে ওঠে মন/ আকাশের নীল মেঘে নেয় আহা, তৃষিত নয়ন।’

এ কবিতার ক্যানভাসজুড়ে নিসর্গের সঙ্গে নগরের মিতালিতে যে ঘনঘোর আবহের জন্ম হয়, তা বোধ করি মনকে একধরনের প্রশান্তির কাছে নিয়ে যায়, নাকি নিয়ে যায় কবিতায় উল্লিখিত সেই হ্রদের কাছে, স্থিতির কাছে? এই ধাঁধাই ছন্দোবদ্ধ ও অন্ত্যমিলসম্পন্ন কবিতাটিকে অনবদ্য করে তোলে শেষমেশ।

১৯৬৭-তে কালবেলায় প্রকাশিত আরেকটি কবিতা ‘মত্ত দাদুরি ডাকে’। চাকরি পাওয়ার আনন্দে উল্লসিত কবি গদ্যে আঙ্গিকে লেখা এ কবিতায় বিদায় জানাচ্ছেন নানা কিছুকে: ‘বিদায়! অস্তগোধূলি, সূর্য, রাশি, জলতরঙ্গ, রেশম, গম, তিসি।...বিদায়! মধ্যরাতের দীর্ঘ রাস্তা, উঁচু স্তম্ভের আলো, সস্তা রেস্তোরাঁর ম্লান টেবিল, কান্নার করাত, বৃষ্টি, শিলা।...’ গোটা কবিতা শুধু কিছু প্রাণী, বস্তু আর অবস্তুগত উপাদানে ঠাসা। নেই একটিও উপমা।

তবে কবিতাটি বলার মতো হয়ে ওঠে এর ছোট ছোট বাক্য, নির্মেদ প্রবহমানতা এবং অবশ্যই অভাবনীয় শিরোনামের জন্য। মধ্যযুগের কবি বিদ্যাপতি একদা তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছিলেন ‘মত্ত দাদুরি, ডাকে ডাহুকী’। তার অনেক পরে এসে শহীদ যখন আলোচ্য কবিতার শিরোনাম দিলেন ‘মত্ত দাদুরি ডাকে’ (আনন্দিত ব্যাঙ ডাকে), মুহূর্তে নাগরিক মানসে পৌঁছে বদলে গেল কবিতাটির কাল-পাত্র; এমনকি ভাব, অর্থ আর অনুভূতিও। বিদ্যাপতির সেই ‘ভরা মাহ ভাদর’-এর আবহ পাল্টে গিয়ে এখানে রচিত হলো নগরের প্রেক্ষাপট। আর রূপান্তরের এই খেলা অতঃপর কবিতাকে করে তুলল অনন্য, নতুন।

১৯৫৪ থেকে ১৯৭৮-এর কালপর্বে লেখা এমন আরও কয়েকটি-‘হারজিত’, ‘নাবিক’, ‘পরিক্রমা’, ‘ভ্রম্যমাণের জার্নাল’-কবিতাগুলোতে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সময়ের যে শহীদ কাদরীর দেখা মেলে, সেখানে কখনো তিনি তরুণতর কবি, কখনো-বা আস্তে আস্তে কবি হিসেবে পরিণত। আবার একই বইয়ে সংকলিত হয়েছে তাঁর শেষ জীবনের বেশ কিছু কবিতাও। ফলে লেখার শুরুতে যা বলা হয়েছে, ‘এই পুস্তকের মধ্যে বাস করছেন অখণ্ড শহীদ কাদরী’, কথাটি মানতে এখন কারও আর আপত্তি থাকবে না নিশ্চয়।

হানাহানি, অস্ত্রমুখরতা, দুঃসময়, যুদ্ধ, প্রেম, শান্তির আকাঙ্ক্ষা-শহীদের কবিতার এসব চেনা অনুষঙ্গের সঙ্গে এ বইয়ে বেশি মাত্রায় স্পষ্ট হয়েছে কবির ক্লান্তি, বেদনাবোধ, নৈরাশ্য ও ঘরে ফেরার আকুতি।

নাম কবিতা ‘গোধূলির গান’-এর দিকে তাকানো যাক: ‘জানি না/ ক্লান্তির আর্তি ছাড়া/ অন্য কোনো ধ্বনি ছিল কি না/ সন্ধ্যা নদীর স্বরে/ কে যেন মন্ত্রের মতো/ উচ্চারণ করে/ কবেকার ভুলে যাওয়া নাম।...হন্তারকরা নিরাপদে হেঁটে যায়। এবং হঠাৎ/ একটি অচেনা পাখি/ দ্যুলোক-ভূলোকজুড়ে/ বারবার রটিয়ে দেয়/ আমার নতজানু পরিণতি/ আমার অন্ধকার পরিণাম।’

 ২০১৬ সালে লেখা এ কবিতায় বিধৃত ‘নতজানু পরিণতি’ আর ‘অন্ধকার পরিণাম’ কি দেশান্তরি কবির ঘরে ফিরতে না পারা? তাঁর স্বদেশ হন্তারকদের করায়ত্ত হওয়া? না হলে একই কবিতায় কেন লিখবেন ‘কবেকার ভুলে যাওয়া নাম’-এর কথা? নিজের ব্যক্তিক পরিণতি খোলাসা করার মধ্য দিয়ে যে মুহূর্তে সামাজিক পরিণতি উন্মোচিত করেন তিনি, কবির অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের মেলবন্ধন ঘটে তখন।

বলা সংগত হবে, বাংলাদেশে পঞ্চাশের পুরোধা কবিদের ভেতরে একমাত্র শহীদ কাদরীই কবিতায় অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎকে সবচেয়ে সার্থকভাবে মেলাতে পেরেছেন। ফলে তাঁর কাব্যে মানুষ হত্যা, ইতিহাসের অন্ধকার পর্যায়সহ বৈশ্বিক, সামাজিক বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতি এবং সেই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বলিষ্ঠভাবে প্রতিভাত হয় বটে, তবে তা স্লোগানের একমাত্রিকতায় পর্যবসিত হয় না মোটেই; স্লোগান হওয়া থেকে কবিতাকে তিনি বিরত রাখতে পারেন, পেরেছেন। গোধূলিরগান-এর কবিতাগুলোতে এই ছাপ বারবারই মিলবে।