আঁধার ঘনিয়ে এলে এক গ্রামে

শিল্প ও সাহিত্য
শিল্প ও সাহিত্য

একটা সময় ছিল, যখন আমি ইংল্যান্ডে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘোরাঘুরি করেও চাঙা থাকতে পারতাম, তখন আর যাই হোক, বেড়ানোটা আমার বেশ লাগত। কিন্তু এখন আমার এই বয়সটার কারণেই আমি খুব সহজেই দিশেহারা হয়ে যাই। আর সে কারণে রাত্তির নামার ঠিক পরপর গ্রামে পৌঁছেই দিক হারিয়ে ফেললাম আমি। আমার মোটেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি সেই গ্রামটাতেই এসে পৌঁছেছি, যেখানে এই কিছুদিন আগেই আমি থাকতাম আর যার ওপর আমার এত প্রভাব, প্রতিপত্তি হয়েছিল।
কোনো কিছুই আমি চিনতে পারছিলাম না। আর দেখলাম যে আমি গ্রামের ম্লান আলোকিত এবং দুপাশে এদিককার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পাথরের ছোট বাড়িগুলোর সারবাঁধা রাস্তা ধরে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়েই চলেছি। কোথাও কোথাও রাস্তাগুলো এত সরু ছিল যে আমার হাতের ব্যাগ অথবা কনুই কোনো একটা অমসৃণ দেয়ালে ঘষা না লাগিয়ে এগোতেই পারছিলাম না। তারপরও হাল ছাড়লাম না, গ্রামটার চকে পৌঁছানোর আশায় অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছিলাম; সেখানে পৌঁছে অন্তত দিকের একটা দিশা পাব, অথবা গ্রামের কারওর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। কিছুক্ষণ পরে যখন কোনোটাই হলো না, একটা ক্লান্তি ভর করল আমার ওপর; আর আমি ঠিক করলাম, আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হয় যেকোনো একটা কুটিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো, দরজায় কড়া নাড়া এবং আশা করা যে এমন কেউ হয়তো দরজাটা খুলবে, যে আমাকে মনে করতে পারে।
একটা নড়বড়ে দেখতে দরজার সামনে থামলাম আমি, যার ওপর দিকের কড়িটা এত নিচু ছিল যে আমি দেখতেই পারছিলাম ভেতরে ঢুকতে হলে আমাকে প্রায় কুঁজো হতে হবে। দরজার ধার ঘেঁষে গলে বেরোচ্ছিল ম্লান আলো এবং আমি হাসি আর কথার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। জোরে জোরে দরজায় শব্দ করলাম যেন ভেতরের মানুষজন আলাপের মাঝেও শুনতে পায় আমাকে। কিন্তু ঠিক তখনই আমার পেছনে কেউ বলে উঠল, ‘হ্যালো!’
আমি ঘুরে দেখলাম বছর বিশেকের এক নারী, পরনে বিবর্ণ জিনস আর একটা জীর্ণ জাম্পার, একটু দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে।
‘আপনি খানিক আগেই সোজা আমাকে পেরিয়ে এসেছেন।’ সে বলল, ‘আমি আপনাকে ডাকার পরও।’
‘তাই নাকি? তা, আমি দুঃখিত। ও রকম করা আমার ঠিক হয়নি।’
‘আপনি ফ্লেচার, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, একটু আত্মপ্রসাদ নিয়েই।
‘ওয়েন্ডিও তাই ভেবেছিল যখন আপনি আমাদের ঘরটা পেরিয়ে আসেন। আমরা সবাই দারুণ নাড়া খেয়েছিলাম। আপনি তো ওই দলটারই একজন, তাই না? ডেভিড ম্যাগিস আর অন্য সবাই।’
‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, ‘কিন্তু ম্যাগিস খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল না। আমার অবাক লাগছে, তোমরা ওকে নিয়ে এত ভেবেছ। অন্য আরও অনেকেই ছিল, অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব মানুষ।’ আমি হড়হড় করে অনেকগুলো নাম বলে ফেললাম আর বেশ আগ্রহের সঙ্গে দেখলাম মেয়েটা প্রতিটা নামই চিনতে পেরে মাথা নাড়ল। ‘কিন্তু এ তো তোমাদের সময়েরও অনেক আগের কথা,’ আমি বললাম, ‘আমার তো অবাক লাগছে যে তুমি এতসব কিছু জানো!’
‘আমদের সময়ের আগের কথা, কিন্তু আমরা সবাই আপনাদের দলটার ওপর এক্সপার্ট। সেই সময় যেসব বুড়ো এখানে ছিল, তাদের চেয়ে আমরা ওসব সম্পর্কে বেশি জানি। ওয়েন্ডি আপনার ফটো থেকেই আপনাকে চিনতে পেরেছিল।’
‘আমি জানতাম না তোমাদের কম বয়সীদের আমাদের ব্যাপারে এত আগ্রহ রয়েছে। দুঃখিত, একটু আগেই আমি তোমাকে পেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম। দেখতেই পাচ্ছ, বেশ বুড়ো হয়ে গেছি। ঘোরাঘুরি করলে আমি একটু এলোমেলো হয়ে যাই।’
দরজার ওপাশে আমি বেশ সশব্দ কথোপকথন শুনতে পেলাম। দরজায় বেশ জোরে জোরেই ঘা দিলাম আমি, বেশ অধৈর্য হয়েই, যদিও মেয়েটার সঙ্গে আমার আলাপ এখানেই শেষ হয়ে যাক তা-ও চাইছিলাম না।
আমার দিকে এক মুহূর্ত তাকাল সে, তারপর বলল, ‘আপনাদের সময়ের সবাই এই রকমই। ডেভিড ম্যাগিস বছর কয়েক আগে এখানে এসেছিলেন। ’৯৩-এ, বা হয়তো ’৯৪ হবে। তিনিও এ রকমই ছিলেন। খানিকটা দিশেহারা। আপনাদের সবাই মনে হয় কিছুদিন পর এ রকম হয়ে যান, সব সময় এত ঘোরাঘুরি।’
‘তো ম্যাগিস এসেছিল? দারুণ তো! কী জানো? ও আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল না। এ রকম ধারণায় তোমাদের গা ভাসানো ঠিক না। সে যাক, তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে এই বাড়িটায় কারা থাকে।’ আবার দরজায় ঘা দিলাম আমি।
‘পিটারসনসরা,’ মেয়েটি বলল, ‘ওরা বেশ পুরোনো গেরস্ত। মনে হয় আপনাকে চিনতে পারবে।’
‘পিটারসনস।’ আমিও বললাম, কিন্তু নামটা আমার স্মৃতিকে কোনো নাড়া দিল না।
‘আমাদের বাড়িতে আসুন না কেন? ওয়েন্ডি খুব ছটফট করছিল। আমরা বাকিরাও। আমাদের জন্য সত্যিই এটা একটা সুযোগ, ওই সময়ের কারও সঙ্গে সত্যি সত্যি কথা বলার।’
‘আমারও তাই করতে খুব ভালো লাগবে। কিন্তু আগে আমার একটু কোথাও বসা দরকার। তুমি বলছিলে, পিটারসনসরা, হ্যাঁ।’
আমি দরজায় আবার বাড়ি দিলাম, এবার বেশ রাগের সঙ্গেই। রাস্তার ওপর উষ্ণতা আর আলো ছড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত এটা খুলল। দোরে একজন বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে। খুব খেয়াল করে সে দেখল আমাকে, তারপর শুধাল, ‘আরে ফ্লেচার না? তাই তো!’
‘হ্যাঁ, কেবলই আমি গাঁয়ে ঢুকলাম। বেশ কয়েক দিন ধরেই আমি ঘোরাঘুরির মধ্যে আছি।’
মানুষটা একমুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, ‘বেশ, মনে হয় তোমার ভেতরে আসাই ঠিক হবে।’
দেখালাম আমি একটা খরখরে কাঠ আর ভাঙা আসবাবে ঠাসা, গাদাগাদি করা, অগোছালো ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েছি। ফায়ার প্লেসে জ্বলতে থাকা একটা কাঠের টুকরো সারা ঘরের একমাত্র আলোর উৎস, যে আলোয় আমি বুঝতে পারলাম ঘরের ভেতরে আরও কয়েকখানা ঘাড়-গোঁজা শরীর রয়েছে। বুড়ো মানুষটা এমন ক্ষোভের সঙ্গে আগুনের পাশের চেয়ারটার দিকে নিয়ে গেল আমাকে, বোঝা গেল একটু আগে সে এই চেয়ারটা ছেড়েই উঠেছে। বসার পর টের পেলাম, খুব সহজে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার চারপাশে অথবা ঘরের অন্যদের দেখতে পারছি না আমি। কিন্তু আগুনের উষ্ণতাটা ডাকছিল আমাকে, একমুহূর্তের জন্য আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি, আর একটা ভালো লাগার অবসাদ আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। আমার পেছন থেকে ভেসে আসছিল কণ্ঠস্বর, জানতে চাইছিল আমি ভালো আছি কি না, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি কি না, আমার ক্ষুধা পেয়েছে কি না। আমি যতটা পারলাম উত্তর দিলাম, যদিও বুঝতে পারছিলাম যে আমার উত্তরগুলো একেবারেই যথেষ্ট ছিল না। ধীরে ধীরে প্রশ্ন থেমে গেল আর আমারও মনে হলো, আমার এই আসাটা একটা বেশ ভারী অস্বস্তি তৈরি করেছে, কিন্তু আমি এই উষ্ণতাটুকুর জন্য আর বিশ্রামের এই সুযোগটুকুর জন্য এতটাই কৃতজ্ঞ ছিলাম যে আমার আর কিছু গায়েই লাগছিল না।
যা হোক, আমার পেছনের নীরবতাটুকু যখন বেশ কয়েক মিনিট ধরে ঝুলে রইল, গৃহকর্তার সঙ্গে আরেকটু সভ্য আচরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম আর আমি আমার চেয়ারখানা ফেরত দিলাম। তখনই—এটা করতে গিয়েই—চিনতে পারার একটা তীব্র অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। আমি প্রায় চোখ বুজেই একটা বাড়ি বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, যে বছরগুলোতে আমি এই গ্রামটাতে ছিলাম, তখন যে বাড়িটা আমার ঘর হয়ে গিয়েছিল, এটা সেই বাড়িটাই। আমার দৃষ্টি নিমেষেই ওই দূরের কোণটায় গিয়ে পড়ল—এই মুহূর্তে যেটা ঢেকে আছে অন্ধকারে—ওই জায়গাটা যেটা ছিল আমার কর্নার, যেখানে একসময় আমার তোশকটা ছিল, যেখানটায় আমি বইয়ের পাতা উলটে কিংবা যে-ই আসত তার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বহু শান্তিময় মুহূর্ত পার করেছি।
গ্রীষ্মের দিনগুলোতে তাজা বাতাস চলাচলের জন্য জানালা এবং প্রায়ই দরজাও খোলা থাকত। সেই সময়ে বাড়িটার চারদিকে ছিল খোলা মাঠ আর বাইরে থেকে আমার সুহৃদদের ভেসে আসত কণ্ঠস্বর, লম্বা ঘাসের বিছানায় অলস শুয়ে, কবিতা অথবা দর্শন নিয়ে তর্কে লিপ্ত। অতীতের সেই অমূল্য অংশগুলো আমার কাছে এত জোরালো হয়ে ফিরে এল যে আমি ওই কোণটায় ছুটে যাওয়া থেকে নিজেকে কোনোমতে আটকালাম, এতটুকুই শুধু পারলাম।
কেউ আবার আমার সঙ্গে কথা বলছিল, সম্ভবত আর কিছু জিজ্ঞেস করছিল, কিন্তু আমি প্রায় শুনলামই না। শরীরটা তুলে, ছায়ার ভেতর দিয়ে আমার কোণটাকে দেখলাম, আর এখন আমি ছোট বিছানাটাও বেশ বুঝতে পারছিলাম, একটা পুরোনো পরদায় ঢাকা, আমার তোশকটা যেখানে ছিল, কম-বেশি সে জায়গাটা জুড়েই আছে। বিছানাটা প্রচণ্ড লোভনীয় মনে হলো। আর দেখলাম আমি বুড়ো মানুষটাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়েছি।
‘দেখুন’, আমি বললাম, ‘আমি জানি এটা একটু বেখাপ্পা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন, আমি অনেকটা পথ এসেছি। আমার আসলেই একটু শুতে হবে, একটু চোখ বুজতে চাই, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য হলেও। তারপর আমি খুব খুশি মনেই আপনারা যা যা জানতে চান সব বলব।’
ঘরের ভেতরে শরীরগুলো অস্বস্তিভরে নড়ছিল দেখতে পেলাম। তারপরও একটা নতুন স্বর বলে উঠল, ‘ঠিক আছে তাহলে। ঘুমাও। আমাদের কথা ভাবতে হবে না।’
অবশ্য ততক্ষণে আমি আমার কোণটার দিকে এগোতে শুরু করেছি। বিছানাটা ভেজা ভেজা আর স্প্রিংগুলো আমার শরীরের ভারে ককিয়ে উঠল, কিন্তু বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুতে না শুতেই বহু দীর্ঘ পথযাত্রার ক্লান্তি চেপে ধরল আমাকে। ঘুমের ঘোরে ভেসে যেতে যেতে আমি শুনলাম বুড়ো মানুষটা বলছে, ‘এটা ফ্লেচারই, ঠিকই আছে। ঈশ্বর, ও একদম বুড়ো হয়ে গেছে।’
একটা নারীকণ্ঠ বলে উঠল, ‘আমরা কি ওকে এ রকমই ঘুমাতে দেব? ও হয়তো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জেগে যাবে, তখন আমাদের সব্বাইকে ওর সঙ্গে জেগে বসে থাকতে হবে।’
‘ওকে ঘণ্টাখানেক ঘুমাতে দাও’, অন্য কেউ একজন বলল, ‘যদি তারপরও ও ঘুমিয়ে থাকে, আমরা জাগিয়ে দেব।’
এ পর্যন্ত এসে আমাকে গ্রাস করল প্রবল ক্লান্তি।
ঘুমটা একটানা কিংবা আরামের ছিল না। ঘুম আর জাগরণের মাঝে দুলছিলাম আমি, সারাটা সময়ই ঘরের ভেতরে আমার পেছনে কথা-বলা কণ্ঠগুলো নিয়ে সচেতন ছিলাম। একসময় বুঝলাম, একজন নারী বলছে, ‘আমি ভাবতেই পারছি না ও কীভাবে মাকে জাদু করেছিল। এখন কেমন নোংরা বোঁচকার মতো লাগছে।’
আমার আধো ঘুমে আমি নিজের সঙ্গেই তর্ক করছিলাম শব্দগুলো কি আমার উদ্দেশ্যেই নাকি, সম্ভবত, ডেভিড ম্যাগিসকে নিয়ে; কিন্তু তার আগেই আমি আরও একবার ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
পরেরবার যখন উঠলাম, ঘরটা ততক্ষণে আরও অন্ধকার আর ঠান্ডা হয়ে গেছে। নিচু স্বরে কণ্ঠগুলো তখনো আমার পেছনে কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি ওদের আলাপের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি যেভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা নিয়ে আমার এখন একটু সংকোচ লাগল। আর ক্ষণিকের জন্য দেয়ালের দিকে মুখ করে যে অবস্থায় শুয়ে ছিলাম, সেভাবেই পড়ে রইলাম—স্থির। কিন্তু আমার কোনো আচরণে হয়তো বোঝ যাচ্ছিল যে আমি জেগে গেছি, কারণ এক নারীকণ্ঠ কথাবার্তার মধ্যেই বলে উঠল, ‘আহ, দেখ দেখ।’ কিছু ফিসফিসানি বয়ে গেল, তারপর শুনতে পেলাম কেউ একজন আমার কোণটার দিকে আসছে। আমার কাঁধে একটা আলতো হাতের ছোঁয়া পড়ল, চোখ তুলে এক নারীকে আমার ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখলাম। ঘরটা পুরোপুরি দেখার জন্য যথেষ্ট হয় শরীরটাকে এতখানি আমি ঘোরাইনি, কিন্তু বুঝতে পারলাম, ঘরে চুল্লির অন্তিম জ্বলন্ত কাঠের আলোটুকুই আছে, আর সেই নারীর মুখখানা শুধু আবছায়াতেই দেখা যাচ্ছিল।
‘তো ফ্লেচার’, সে বলল, ‘আমাদের একটু কথা বলা দরকার, আমি অনেকটা সময় তোমার ফিরে আসার অপেক্ষা করেছি। প্রায়ই ভেবেছি তোমার কথা।’
আমি তাকে আরেকটু স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করলাম। চল্লিশের ঘরে হবে বয়স, আর এমনকি আবছায়াতেও আমি তার চোখে দেখেছিলাম একটা তন্দ্রালু বিষণ্নতা। কিন্তু মুখটি আমার স্মৃতির জলে সামান্যতম তরঙ্গও তুলতে পারল না।
‘দুঃখিত’, আমি বললাম, ‘আমি আপনাকে মনে করতে পারছি না। কিন্তু একটু আগেই যদি আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে থাকে তো ক্ষমা করবেন। আজকাল আর আমার কোনো খেই থাকে না।’
‘ফ্লেচার’, সে বলল, ‘যখন আমরা একজন আরেকজনকে চিনতাম, তখন আমি কম বয়সী আর সুন্দরী ছিলাম। আমি তোমাকে দেবতাজ্ঞান করতাম, তোমার সবকিছুই আমার জিজ্ঞাসার উত্তর মনে হতো। আর এখন তুমি আবার ফিরে এসেছ। আমি তোমাকে বলতে চাই, তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছ।’
‘এটা খুবই অন্যায় হলো। ঠিক আছে, অনেক বিষয় নিয়েই আমি ভুল ছিলাম। কিন্তু আমি কখনোই এমন দাবি করিনি যে আমার কাছে কোনো উত্তর আছে। আমি ওই সময় যা বলেছি তা হলো, এটা আমাদের দায়িত্ব, আমাদের সবার, বিতর্কটা সমৃদ্ধ করা। এখানকার যেকোনো হেজিপেজির চেয়ে আমরা অনেক বেশি জানতাম। যদি আমাদের মতো মানুষেরা এই দাবিতে বিলম্ব করেই থাকে যে আমাদের তখনো যথেষ্ট জ্ঞান হয়নি, তো তাহলে সেখানে আর কে-ই বা কিছু একটা করার মতন ছিল? কিন্তু আমি কখনো বলিনি যে আমার কাছে কোনো উত্তর আছে। নাহ, আপনারা আমার ওপর অন্যায়ই করছেন।’
‘ফ্লেচার’, সে বলল, তার কণ্ঠ ছিল অদ্ভুত নরম, ‘তুমি আমার সঙ্গে ভালোবাসাবাসি করতে, কম-বেশি যতবারই আমি এখানে তোমার ঘরটায় এসে ঘুরে গেছি। এই কোনাটা, আমরা কত সব রকমের সুন্দর নোংরা কাজগুলো করেছি। অদ্ভুত না, আমার শরীর তোমাকে দেখলেই একসময় কেমন শিহরিত হতো। আর এই তো তুমি একটা বদ-গন্ধওয়ালা ন্যাকড়ার বোঁচকা। কিন্তু আমাকে দেখ, আমি এখনো আকর্ষণীয়। মুখে একটু ভাঁজটাজ পড়েছে, কিন্তু যখন আমি গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তখন আমার শরীরটা দেখানোর মতো পোশাক পরি; অনেক পুরুষই আমাকে চায়, কিন্তু তুমি? কোনো নারী এখন আর তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। দুর্গন্ধি ন্যাকড়া আর মাংসের একটা বোঁচকা।
‘আমার আপনার কথা মনে পড়ছে না’, আমি বললাম, ‘আর ভালোবাসাবাসির এখন আমার সময়ও হয় না। অন্য বিষয় নিয়ে ভাবতে হয় আমাকে—আরও গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়। ঠিক আছে, মানছি ওই সময় অনেক কিছুতেই আমার ভুল ছিল। কিন্তু সেই ভুল ঠিক করার জন্য আমি যথেষ্টের চাইতেও বেশি করেছি। দেখতেই পাচ্ছেন, আমি এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি কখনো থামিনি। আমি ঘুরেছি আর ঘুরেছি, যে যে ক্ষতি আমি একদিন হয়তো করেছিলাম তা পূরণ করার জন্য। এখনকার অন্য যে কারওর চেয়ে সেটা বেশিই বলা যায়। আমি বাজি ধরতে পারি ম্যাগিসও, মানে ধরুন, সব ঠিকঠাক করার জন্য এতটা পরিশ্রম করেনি।
নারীটি আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
‘দেখ দেখি, আমি এ রকমই করতাম একসময়, তোমার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতাম। কী জঘন্য নোংরা। আমি নিশ্চিত যত সব জীবাণুরা তোমার শরীরে গিজগিজ করছে।’ কিন্তু সে আমার চুলে আঙুল চালাতেই থাকল। আমি এতে কোনো রকম কাম অনুভব করতে ব্যর্থ হলাম, যেটা হয়তো সে আশা করছিল। বরং স্পর্শটা আমার কাছে মাতৃস্নেহের মতো লাগল। সত্যি বলতে কী, আমার মনে হলো আমি শেষ পর্যন্ত একটা নিরাপদ আশ্রয়ের গুটিতে পৌঁছেছি, আর আমার আবার ঘুম পেতে লাগল। কিন্তু হঠাৎই সে থেমে গেল আর আমার কপালে জোরে একটা চাটি মারল।
‘আমাদের আর সবার সঙ্গে এসে বসো না কেন তুমি? তোমার ঘুম তো হয়েছে। অনেক কিছু তোমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে।’ বলে সে উঠে গেল।
প্রথমবারের মতো শরীরটাকে যথেষ্ট ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখলাম আমি। দেখলাম নারীটি হেঁটে আগুনের পাশে চেয়ারে বসল। আরও তিনজনকে দেখলাম, তাদের মধ্যে একজন সেই বুড়োটা, যে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল। বাকি দুজন নারী।
বুড়ো মানুষটা খেয়াল করল, আমি নড়ছি আর অন্যদেরও দেখিয়ে দিল। বুঝলাম তারা বেশ খানিকক্ষণ ধরেই আমাকে খেয়াল করছে, কথা বলছে আমাকে নিয়ে। আমি এটাও বুঝতে পারছি, বাইরে যে মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হলো, তার আর তার সঙ্গীদের ওপর আমি কী আছর করতে পারি, এটা নিয়েও আলাপ করছে ওরা।
‘ওদের বোঝানো এত সহজ’, বুড়োটা হয়তো বলেছে, ‘আর আমি দেখলাম ওদের একজন ওকে নিয়ে যেতেও এসেছে।’
উত্তরে কোনো সন্দেহ নেই, একজন নারী বলেছে, ‘কিন্তু এখন ও আর তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। আমাদের সময় আমরা ওদের কথায় পড়েছিলাম, কারণ ওদের পুরো দঙ্গলটাই সুদর্শন আর যুবক ছিল। কিন্তু এখন ওরা বিকল। পুরোনো দিনের কথার ঘোর আর নেই। যাই হোক না কেন, ওদের মতো মানুষেরা তাদের অবস্থান বদলেছে। ওরা কী যে বিশ্বাস করে নিজেরাই জানে না।
বুড়োটা হয়তো মাথা নেড়েছিল, ‘ওই মেয়েটা কীভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছিল আমি খেয়াল করেছি। ঠিক আছে, ওকে একটা দুস্থ দলার মতো লাগছে। কিন্তু ওর অহমে ঠিকঠাক একটু বাতাস পেলেই, কম বয়সীদের প্রশংসা পেলেই, কীভাবে ওরা ওর কথা শুনতে চায়, তা বের হলেই ওকে আর ঠেকানো যাবে না। একদম আগের ঘটনাই ঘটা শুরু করবে। ও রকম কম বয়েসী মেয়েরা, বিশ্বাস করার মতো ওদের সামনে খুব কম কিছুই আছে। এমনকি এ রকম একটা বদবোদার ভবঘুরেও ওদেরকে একটা আশা দিতে পারে।’
যখন ঘুমিয়ে ছিলাম, আমাকে নিয়ে ওদের ভেতরে এ রকমটাই কথা চলছিল। কিন্তু এখন ওরা অপরাধীর নীরবতা নিয়ে আমার সামনে বসে আছে। খানিকক্ষণ পর আমি উঠে দাঁড়ালাম। অপেক্ষা করলাম একমুহূর্ত, কেউ কিছু বলে কি না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি ঘুমিয়েই ছিলাম, কিন্তু তোমরা কী বলাবলি করছিলে তা-ও আমি আন্দাজ করে নিয়েছি। বেশ, তোমাদের জেনে ভালো লাগবে, আমি এখন সেটাই করব যার ভয় তোমরা করছিলে। এই দণ্ডে আমি ওই কম বয়েসীগুলোর বাড়িতে যাব। আমি বলব ওদের সব শক্তি, সব স্বপ্ন, বাইরের দুনিয়ায় কিছু করার, কিছু পাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা দিয়ে ওদের কী করা উচিত। নিজেদের দেখ, কী দুর্বিষহ। নিজেদের বাড়িতে গুঁজে বসে রয়েছ, কোনো কিছু করতে ভয়, আমাকে ভয়, ম্যাগিসকে ভয়, ওই সময়ের যে কাউকে ভয়। যা হোক, এত বছর ধরে তোমরা ওদের কাছে আলস্যের গুণগান করার পরও ওই কম বয়েসীরা এখনো অতটা তলিয়ে যায়নি। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমি তোমাদের সব কাজ বেকার করে দেব।’
‘দেখেছ’, বুড়োটা অন্যদের বলল, ‘আমি জানতাম এ রকমই হবে। আমাদের ওকে থামাতে হবে, কিন্তু কী করব আমরা?’
ঘর পার হয়ে দরজার দিকে ধেয়ে গেলাম আমি, আমার ব্যাগটা ওঠালাম আর বাইরে রাতের আঁধারে বেরিয়ে এলাম।
যখন আমি বেরোই, মেয়েটা তখনো দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই। মনে হলো যেন ও আমাকে মনে মনে আশা করছিল। ও মাথা ঝাঁকাল আর আমাকে পথ দেখিয়ে এগোতে শুরু করল।
কাজুও ইশিগুরোর ‘আ ভিলেজ আফটার ডার্ক’ গল্পের অংশবিশেষের অনুবাদ।