কবিতার ইতিহাস হয়ে ওঠা

কোনো কোনো মানুষ ইতিহাস তৈরি করেন। আবার কোনো কোনো মানুষ নিজেই ইতিহাস হয়ে যান। ২৪ বছরের যুবক নূর হোসেন নিজেই ইতিহাস হয়েছিলেন।

তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়। মিছিলে প্রকম্পিত রাজপথ, স্লোগানে মুখরিত বাতাস, অঙ্গীকারে উদ্বেলিত দেশ। যেকোনো মূল্যে স্বৈরাচারকে হটাতে হবে। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে যে মিছিলের শুরু, নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত সেই মিছিল চলেছে অবিরাম, ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে।

সেই মিছিলের সহযাত্রী ছিলেন নূর হোসেন। সহযাত্রী বললে পুরোটা বলা হয় না, আসলে তিনি ছিলেন সেই মিছিলের অন্যতম নায়ক, যে মিছিল মৃত্যুতে থেমে থাকে না, যুগে যুগে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে নতুন মিছিল রচনায়।

দুর্ভাগ্য, স্বৈরাচারের পতন দেখে যেতে পারেননি নূর হোসেন। কিন্তু তার পতন ত্বরান্বিত করেছেন নিজের জীবন দিয়ে, আন্দোলনের দীর্ঘ কাফেলায় সবচেয়ে দৃশ্যমান ফলকটি স্থাপন করে।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান এঁকে নূর হোসেন মিছিলে নেমেছিলেন। স্বৈরাচারের গুলি তাঁর বুক বিদ্ধ করেছে, খুনের ধারায় ভিজে গেছে রাজপথ। বন্দুকধারী পুলিশ সহযাত্রীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তাঁর লাশ। তারপর রাতে গোপনে দাফন করেছে জুরাইন কবরস্থানে। কিন্তু তারা নূর হোসেনের লাশ সেখানে আটকে রাখতে পারেনি। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে যেমন একুশের লাশ জীবন্ত মানুষের মতো কথা বলে, তেমনি মৃত্যুর পরও নূর হোসেনরা আমাদের সাহস জোগান, আন্দোলনকে নিয়ে যান অভীষ্ট লক্ষ্যে।

সেদিন দরিদ্র বেবিট্যাক্সিচালকের সন্তান নূর হোসেন হয়ে গেলেন বাংলাদেশের সন্তান। সেই আত্মত্যাগী যুবককে নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, গান রচিত হয়েছে অনেক। ছবিতে, গল্পে, নাটকে, কথিকায় ভাস্বর হয়ে আছেন নূর হোসেন। তার চেয়েও বেশি আছেন মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে।

শামসুর রাহমান, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, নূর হোসেনকে নিয়ে আমাদের জানামতে তিনটি কবিতা লিখেছেন। সবচেয়ে আলোচিত ও আলোড়িত কবিতার নাম ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ (নূর হোসেনকে নিয়ে তাঁর অপর দুটি কবিতা হলো ‘একজন শহীদের মা বলছেন’ ও ‘আলো ঝরানো ডানা’)।

‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’-এ মিছিলে উদ্দীপ্ত ১০ নভেম্বরের আগের রাতের ঢাকা শহরের ভীতিকর পরিবেশের বর্ণনা আছে। আছে কীভাবে নূর হোসেন সারা রাত বিনিদ্র থেকে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন পরের দিনের মিছিলের জন্য, কৃষ্ণাঙ্গ চাদর মুড়ি দেওয়া আতঙ্কগ্রস্ত শহরও তাঁর শিরায় শিরায় জ্বেলেছে আতশবাজি, বুকের ভেতরে জেগেছে ক্ষিপ্র জাগুয়ার। কেননা, তাঁর কবজিতে জ্বলজ্বল করছে ভবিষ্যৎ। জীবনানন্দের কবিতার মায়াবী আঙুল তাঁর মনে তখন বিলি কেটে দেয়। পরদিন সকালটি ছিল অন্য রকম। অপরূপ সূর্যোদয়, ডালিমগাছের সতেজ পাতা—সবকিছু নূর হোসেনকে যোদ্ধার সাজে পাঠাচ্ছে রণাঙ্গনে। তার পরই শামসুর রাহমান সেই মোক্ষম সময়ের বর্ণনা দেন এভাবে—

‘উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে

রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান,

বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ

শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সিসা

নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।’

তখন নূর হোসেন ও বাংলাদেশ হয়ে পড়ে অবিভাজ্য সত্তা। সময় যেমন মানুষকে তৈরি করে, তেমনি সময় কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় নানা পঙ্‌ক্তি। যেমন উনসত্তরে আসাদ শামসুর রাহমানকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন ‘আসাদের শার্ট’ নামের আরেক অবিস্মরণীয় কবিতা। রাষ্ট্রপালিত ঘাতকের হাতে নূর হোসেন খুন হয়েছেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। আর শামসুর রাহমান কবিতাটি লিখেছেন ১৬ ডিসেম্বর। তারপর থেকে সেই কবিতা ও নূর হোসেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিশিখা হয়ে ওঠেন; তিন বছরের ব্যবধানে স্বৈরাচার গদি ছাড়তে বাধ্য হয়।

নূর হোসেনের আত্মদানের ত্রিশ বছর পর আজ আমরা সেই আন্দোলন ও নূর হোসেনকে কীভাবে দেখব? যে নূর হোসেন স্বৈরাচারীর হাতে খুন হয়ে গণতন্ত্রের পতাকা আমাদের হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা কি তার মর্যাদা রাখতে পেরেছি? বুকে-পিঠে যে মুক্তির কথা লিখে জীবন দিয়েছেন নূর হোসেন, সেই মুক্তি কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি? হয়তো পারিনি। গণতন্ত্র সত্যিকারের গণতন্ত্র হতে না পারলেও নূর হোসেন জীবন দিয়ে স্বৈরাচারের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন, পটুয়া কামরুল হাসান তারই নাম দিয়েছিলেন ‘বিশ্ব বেহায়া।’

গণতন্ত্রকে কলঙ্কমুক্ত করতে হলে আমাদের মাথার ওপর থেকে ‘বিশ্ব বেহায়ার’ ছায়া সরাতেই হবে।

বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়

শামসুর রাহমান

সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও

শিশিরের মতো

জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়

জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ

বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে

ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,

কখনো অত্যন্ত ক্ষীপ্র জাগুয়ার তাকে

প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে

চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,

এতটুকু ঘুমোতে দেয়নি।

কাল রাত ঢাকা ছিল প্রেতের নগরী,

সবাই ফিরেছে ঘরে সাত তাড়াতাড়ি। চতুর্দিকে

নিস্তব্ধতা ওঁৎ পেতে থাকে,

ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি

কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক।

মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃসঙ্গ্যকে।

আরও বেশি তীব্র করে তোলে

প্রহরে প্রহরে, নূর হোসেনের চোখে

খোলা পথ ওর

মোহন নগ্নতা দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দুর্বার। অন্ধকার

ঘরে চোখ দুটো অগ্নিঘেরা

জানালা, কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যত।

এমন সকাল তার জীবনে আসেনি কোনোদিন,

মনে হয় ওর; জানালার কাছে পাখি

এরকম সুর

দেয়নি ঝরিয়ে এর আগে, ডালিমের

গাছে পাতাগুলি আগে এমন সতেজ

কখনো হয়নি মনে। জীবনানন্দের

কবিতার মায়াবী আঙুল

তার মনে বিলি কেটে দেয়। অপরূপ সূর্যোদয়,

কেমন আলাদা,

সবার অলক্ষে নূর হোসেনের প্রশস্ত ললাটে

আঁকা হয়ে যায়,

যেন সে নির্ভীক যোদ্ধা, যাচ্ছে রণাঙ্গনে।

উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে পিঠে

রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান,

বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ

শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা

নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো ক’রে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।

 প্রকাশ: সাপ্তাহিক একতা