হাছন রাজার পিয়ারী

হাছন রাজা, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
হাছন রাজা, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

হাছন রাজার বয়স যখন ১৭, তখন তাঁর ৩৯ বছর বয়সী একমাত্র বড় ভাই মারা যান। এই ভাইই মূলত রামপাশার জমিদারি দেখতেন। ভাই মারা যাওয়ার সময় তাঁর পিতার বয়স ছিল ৭৭ বছর। পুত্রশোকে কাতর হয়ে পুত্রের চল্লিশার আগের দিন পিতাও মারা গেলেন। এটা এক দিকে তাঁকে যেমন অভিভাবকহীন করে ফেলল, অন্যদিকে রামপাশা আর লক্ষ্মণশ্রীর দুই জমিদারি চলে এল এই কিশোরের ওপর। তবে জমিদারি দেখভাল করতেন তাঁর মা হুরমত জাহান। আদরের পুত্র তখন বল্গাহীন হরিণের মতো ছুটে বেড়ান। লেখাপড়া বেশি কিছু করেননি, উঠতি বয়সী একটু বড় ছেলেদের সঙ্গে মিশে বেপরোয়া জীবন যাপন শুরু করেন। তাঁকে বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না, তাঁর বিরুদ্ধে বিচার দেওয়ার সাহসও ছিল না কারও। তখন যেন কোনো দলছুট ঘোড়ার মতো ছুটে গিয়েছিলেন নদীর কিনারে-ঘাটে-হাটে-মাঠে যত কুঞ্জবন, কে পারে ঠেকাতে সেই রাজা হাছন?

তাঁর এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন:

ধন কড়ি তোর কিছুই চায় না হাছন রাজায়

সোনার বরণ বউ আমার তারে নিতে চায়

সর্বলোকে জানে হাছন রাজা লম্পটিয়া

নিশ্চয়ই জানিও ভোমর নিব যে কাড়িয়া।।

এ হয়তো সেই বৃন্দাবনের কানাই, যমুনার বদলে নিজের বাড়ির পাশের সুরমা বা কাপনা নদীর তীরে যে সারাক্ষণ মত্ত থাকত রাই শিকারে। আর এসব নিয়েই গান লিখেছিলেন তিনি:

সুন্দরী রাধে গো তোর কানাইয়্যা যাইব ছাড়ি

তাই ভাবিয়া হাছন রাজা, ফিরে বাড়ি বাড়ি

কানাইয়া ছাড়িয়া গেলে লোকে বলবে এড়ি

কানাইয়ারে বান্ধিয়া রাখ পায়ে দিয়া দড়ি।।

যৌবোনোন্মাদ বিত্তবান আর দশটা সামন্তপ্রভুর জীবন যেমন ছিল, হাছনের জীবনও ছিল তেমন। তাঁর হাতি-ঘোড়া ছিল, ঘোড়দৌড় করাতেন, প্রতিযোগিতায় তাঁর ঘোড়া কখনো হারত, কখনো জিতত। ষাঁড়ের লড়াই করাতেন, পাখিকে পাখি দিয়ে শিকার করাতেন। এসব পৈশাচিকতার মধ্য দিয়ে আদিকাল থেকেই সামন্তপ্রভুরা যেভাবে জীবন কাটাতেন, তিনিও ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু অন্যদের চেয়ে হাছন একটু অন্য রকম—ছোটবেলা থেকে তিনি দুর্বল ছন্দে ছড়া-কবিতা লিখতে পারতেন। এ ধরনের লেখালেখির প্রতিভা তাঁর বাবা আর বড় ভাইয়ের মধ্যেও ছিল। বড় ভাই ওবেদুর রেজা (বা রাজা) মুখে মুখে তাৎক্ষণিক ছড়া তৈরি করে কথা বলতেন। আবার হাছন রাজার চেয়ে তিন বছরের বড় বৈমাত্রেয় বোন ছহিফা বানু ছিলেন ভালো কবি। তিনি সিলেটের প্রথম মুসলিম নারী কবি হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর দুটি কাবিতার বইও ছিল। ফারসি, উর্দু ও বাংলায় কবিতা লিখতেন তিনি। এই পারিবারিক পরিবেশ হাছনকে পদ্য লেখার অনুপ্রেরণা দিতে থাকে। তিনি কুড়া, ঘোড়া, হাতি এমনকি গ্রামের কোনো সাধারণ লোককে নিয়েও মশকরা করে ছড়া-কাব্য লিখেছেন তাঁর শৌখিন বাহার কাব্যগ্রন্থে:

ডাইনে আড়া চিটের কুড়া অতি উত্তম হয়

বাউযে আড়া চিটের কুড়া মন্দ যে নিশ্চয়

বড় চিটের কুড়া মন্দ জানিও নিশ্চয়

মধ্যমান চিটের কুড়া অতি উত্তম হয়।

পিঙ্গলা চৌখি কুড়া অতি নেক্কার

জোওয়ান মদ্দির সীমা নাই হিম্মত অপার

শাওলা চক্ষুর কুড়া ভালো তার খেছাল

শিকারেতে গেলে সে না করে গোলমাল।।

ঘোড়া পুষতেন হাছন রাজা। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর আর চান্দমুশকি। মোট ৭৭টি ঘোড়ার নাম রেখেছিলেন তিনি। তাদের ডাকতেন সেই নামে। এই ঘোড়ার রূপ-গুণ বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও তিনি ছড়া-কাব্য লিখতেন। নারীর শরীরের গঠন এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেমন হলে তাদের আচরণ কেমন হয়, লিখেছেন এসব নিয়েও:

মধ্য ক্ষীণা, ভাষা আঁখি, পদ্মিনী কামিনী

পতিহীনা হইলেও সে শ্রেষ্ঠ রমণী

মাথা ছোট আওরত, বে আক্কল হয়

বাট্টী আওরত দোষণীয়, সর্বলোকে কয়।

এভাবে নানা রকম শৌখিনতার পেছনেই তাঁর সময় কাটতে লাগল। আনন্দবিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের একমাত্র বাসনা। আর দশটা জমিদারের মতো তিনিও ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা, আনন্দ-অভিসার—এসবের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করলেন মধ্য বয়স। কিন্তু দুটি বড় ঘটনা বদলে দিল হাছনের জীবনবোধ।

প্রথমটি ছিল একটা বড় ভূমিকম্প। ১৮৯৭ সালে আসাম অঞ্চলে বিশাল এক ভূমিকম্প হয়। এক মাসব্যাপী এই ভূকম্পন চলতে থাকলে হাছন রাজা খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শোনা যায়, ভূমিকম্পের ভয়ে এ সময় তিনি নাকি প্রায়ই ঘরের বাইরে—রাস্তায় বা মাঠে হাঁটাহাঁটি করে রাত কাটিয়ে দিতেন। তাঁর লেখায় আছে:

ভূমিকম্পের মাসে বন্ধু ফিরে দেখা দিল

প্রেমের ফান্দে বন্দী করিয়া অন্তরে ছাপাইল।

এর সাত বছর পর ১৯০৪ সালে হাছন রাজার বয়স যখন ৫০ বছর, তখন ৮৫ বছর বয়সে মারা যান তাঁর মা হুরমত জাহান বানু। পাঁচ লাখ একর জমির অধিপতি দোর্দণ্ড প্রতাপ ও ক্ষমতাশালী এই মানুষটিকে যখন নিজের হাতে সাড়ে তিন হাত মাটির তলায় নামিয়ে রাখলেন হাছন, দেখলেন, যেসব কারণে এই ভূমির মালিকানা নিয়েছিলেন, কিছুই তাঁর কোনো কাজে লাগেনি। পৃথিবীর বস্তুগত সম্পদ তাঁর কোনো কাজেই আসছে না। অথচ এই সম্পদ রাখার ও আহরণ করার জন্য জীবদ্দশায় কত কিছুই না করতে হয়েছে তাঁদের—মামলা-মোকদ্দামা, লাঠিয়ালবাহিনী দিয়ে যুদ্ধ, মারামারি, হানাহানি, রক্তারক্তি। তবে সবই এখন অসার।

এর মধ্যে চিশতিয়া তরিকার এক ফকির মাহমুদ শাহর সঙ্গে পরিচয় হয় হাছনের। তাঁর কাছে দীক্ষা নিলেন তিনি। এ সময় শৌখিন বাহার–এর চটুল ছড়া-কাবিতা বাদ দিয়ে লিখতে শুরু করলেন নতুন নতুন গান:

যখন মরিয়া যাইবায় মাটিতে হইবে বাসা

তখন কোথায় রইবে আমার রঙ্গের রামপাশা

না রইবো মোর ঘরবাড়ি না রইবো সংসার

না রইবো লক্ষণসিরি নাম পরগনার।

একসময় বিষয়-সম্পত্তির প্রতি মোহ উঠে যায় তাঁর। প্রিয় সন্তানের আহার-বিহার আর পরবর্তী প্রজন্মের লেখাপড়ার জন্য মোট সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ রেখে প্রায় বারো আনা সম্পদ মানুষের কল্যাণে দিয়ে দেওয়ার আয়োজন করেন তিনি।

একদা নারীর যে রূপ-যৌবনোন্মাদ হাছন দেখেছিলেন, এই রূপের স্বরূপ বদলে যায় তাঁর কাছে। এখন তাঁর চোখে যে রাইয়ের দেখা মেলে, সে যেন তাঁরই আত্মার আরেক রূপ। তিনি বলেন:

হাছন রাজার হইলো জ্বালা, দেখিয়ে সুন্দরী বালা

দৌড়িয়া দাফিয়া হাছন রাজা গাঙের ঘাটে গেলা

আঞ্জা করি ধরি তাইরে কোলে তুলিয়া লইলা

মানুষ বলিয়ে ধরে দেখে নূরের পুতুলা।

হাছনের কাছে ‘বালা’ বিবর্তিত হয়ে গেল ‘নূরের পুতুলা’য়, তত দিনে তাঁর মধ্যে হয়েছে ভিন্ন এক রূপান্তর। তাই হাছন গাইছেন:

রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ

                                দেখিলাম রে।

আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল মোরে।

এ সময় এক নতুন ধরনের লেখা শুরু হয় তাঁর—নানা প্রতীকী নামে নানা নারীর নাম ধরে কাব্য লেখা। এক গানে শাশুড়িকে উদ্দেশ করে লিখলেন:

তুই মোরে কলঙ্কিনী কইলে গো ভবজানের মা

তুই মোরে কলকঙ্কিনী কইলে।

এখানে ‘ভবজান’ অর্থ সংসারের মোহ, ভবের প্রেম, দুনিয়াদারির প্রতি ভালোবাসা।

আর ভবজানের মা হলো এই জগৎ-সংসারের জন্মদাতা। তাঁর কাছেই কবির অনুযোগ; ভবজানের মা, তাঁর শাশুড়ির কাছে তিনি বললেন, এই ভবের মায়া থেকে যেন মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু সংসারের বেড়াজাল থেকে যখন মুক্ত হতে পারলেন না, বললেন:

স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল

কেমনে করিবে হাছন বন্ধের সনে মিল।

শুধু এই ভবজানই নন, সহচরী-সঙ্গিনীদের তিনি ডাকতেন নানা নামে। যেমন ইস্তাম্বুলের সুলতান সুলেমানের হারেমের খাস বাদিদের নিয়ে কাব্য করতেন সুলেমান, নানা বিশেষণে তাদের সুন্দর সুন্দর নাম দিতেন—কাউকে পরি, কেউ তারা, কেউ কোনো নদী, কেউ সুগন্ধ প্রদানকারী ফুল। আবার অযোদ্ধার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তাঁর উপপত্নী বা সঙ্গিনীদের ডাকতেন নানা ফুলের নামে। সেসব নিয়ে তিনিও লিখতেন কাব্য, বানাতেন গান।

হাছন রাজাও এঁদের মতোই। তবে খানিকটা পার্থক্য ছিল—পিয়ারীদের নামের সঙ্গে ‘জান’ শব্দটি যুক্ত করে তাঁদের ডাকতেন তিনি, কাব্য করতেন তাঁদের নামে। সাধারণত ‘জান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় ‘জাহান’-এর সংক্ষেপিত রূপে। যেমন, নূর জাহানকে নূরজান। কিন্তু হাছন এই শব্দটি ব্যবহার করলেন তাঁর কলিজা বা প্রাণরূপে। হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে তাঁর আসরে এবং তাঁর আকর্ষণে কুল-মান-ঘরবাড়ি-সংসার ছেড়ে আসা ১৬ জন খাস সঙ্গিনী শেষ জীবন পর্যন্ত থেকেছেন হাছনের সঙ্গে। তাঁদের কয়েকজনের নাম আরবজান, মিশ্রীজান, সোনাজান, সুরজান, দিলারাম। এঁদের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়তমা ছিলেন দিলারাম নামের এক তরুণী। তাঁকে নিয়ে হাছনের লেখা গান:

ধর দিলারাম ধর দিলারাম ধর দিলারাম ধর

হাছন রাজারে বাইন্ধ্যা রাখ দিলারাম তোর ঘর।

শুধু সঙ্গিনী নয়, তিনি দিয়েছিলেন নিজেরও একটি নাম—হাছনজান। বলা ভালো, হাছনজান হাছন রাজার দেওয়া কোনো নারীর নাম নয়, এটা তাঁরই আরেক সত্তা। তাই হাছনজান যে মুহূর্তে পিয়ারীর মধ্যে বুঁদ হলেন, তখনই শোনা গেল:

নিশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে

হাছন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিল রে

ছটফট করে হাছন রাজা দেখিয়া চাঁনমুখ

হাছনজানের মুখ দেখিয়া জন্মের গেল দুখ রে।

এরপর তিনি লিখলেন:       

হাছনজানের রূপটা দেখি ফাল দি ফাল দি উঠে

চিরা বারা হাছন রাজার বুকের মাঝে কুটে।

চিড়া কুটার সময় বারা বানাতে গাইলের ভেতর থাকা সেদ্ধ ধান যেমন করে নিষ্পেষিত হয়, ধানের খোসার ভেতর থেকে চিড়া হয়ে বেরোতে যে তীব্র বেদনার ভেতর দিয়ে তাকে অতিক্রম করতে হয়, হাছন রাজার তাঁর নিজের ভেতর হাছনজানের সেই রূপ দেখে এমন ছটফটানি শুরু হয়ে যায়।

আর এই হাছনজানের ভেতরেই শেষ অবধি হাছন রাজা খুঁজে পেয়েছেন তাঁর পিয়ারীর সন্ধান।

প্রকৃত অর্থে এক হাছন রাজার ভেতরে বাস করতেন দুই হাছন—একজন সামন্তপ্রভু দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী, আরেকজন হাছনজান। দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী সম্পদলিপ্সু, কামাতুর ভোগবাদী, জমিদার। তাঁকে মনে রাখার দরকার নেই আমাদের। আদতে আমরা যাঁকে চিনি, তিনি ওই হাছনজান, হাছনজানের রাজা। এটি সুরমা ও কাপনাপাড়ের সামন্তপ্রভুর আরেক দেহমানবিক রূপ; যিনি আমাদের মধ্যে আছেন এবং তিনিই আমাদের জীবনের জন্য দেন নতুন নতুন ভাবনার খোরাক। হাছনের সঙ্গে তাঁর পিয়ারীদের সম্পর্ক কেমন, হাছনজানের রাজা নামে আমার এক নাট্যাখ্যানে ব্যাখ্যা করেছিলাম তার রূপ। সেই অংশটি দিয়েই শেষ করব লেখাটি:

সে আমারে নাচায় লাফায়

যে আমার চিত্ত ভরে কাঁপায়

কখনো সে সুরমা বা কাপনার পাড়

কখনো হেরেম মোর, কখনো বাগাড়

কোন জাত কোন পাত কার ঝি, কার পরিবার

কিছুই বিচারি নাই যখন ক্ষমতা আমার

যখন সকলে তারা হয় মুখোমুখি

সকলের মাঝে আমি অন্য কিছু দেখি

কখনো পিয়ারী মোর কখনো যে মাতা

কখনো রমণী কোনো, কখনো বিধাতা।