তালগোল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘এই, কে রে, দুরন্ত নাকি?’

থমকে দাঁড়ায় দুরন্ত। রাস্তার ওপাশে খুপরি চায়ের দোকানগুলোর দিকে চোখ যায়। সেখানে ঝাপসা আঁধার। টিমটিম করে অবশ্য কুপি জ্বলছে। এতে বরং ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

‘কী রে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় আয়, এদিকে আয়।’

শুরুতে চিনতে না পারলেও এখন কেমন চেনা চেনা লাগছে এ গলা। পন্টি ভাই। মাঝখানের কোনো দোকানে বসে আছে।

বছর দুয়েক আগেও পাড়ার মাঠে পন্টি ভাই ওদের সঙ্গে ফুটবল-ক্রিকেট খেলত। নাইনে ওঠার পর হুট করে মিশে গেল ধাড়িদের দলে। তার পর থেকে কেমন দূরত্ব। দেখলেও পাত্তা দেয় না। মুরব্বিয়ানা ভাব। হুট করে আজ ডাকছে কেন?

‘কী হলো, ভয় পাচ্ছিস কেন? আয়।’

মোহে পড়ে যায় দুরন্ত। কিন্তু ওর হাতে সমুচা, বিস্কুট আর চানাচুরের প্যাকেট। মেহমান এসেছে। তা আবার কে? পাশের বাড়ির চিনু আন্টি। দুরন্তকে দেখলেই মাকে বলবেন, ‘ছেলে তো বড় হয়ে যাচ্ছে, আপা, একটু খেয়াল রাখবেন।’

কথার ভঙ্গিটা এমন, নিজেকে তখন চোরের মতো লাগে দুরন্তর। আস্তে করে সরে যায় ও। পেছন থেকে ঠিকই কানে আসে, ‘এটাই কিন্তু নষ্ট হওয়ার বয়স, আপা! একদম চোখে চোখে রাখবেন।’

এই যে এখন ও নাশতা নিয়ে যাচ্ছে, মচমচ করে সমুচা খাবেন, কুড়মুড় করে চানাচুর চিবোবেন, কুটকুট করে বিস্কুট ভাঙবেন, আর বলবেন, ‘স্কুলে ভুলেও একা ছাড়বেন না, আপা। সঙ্গে যাবেন, ছুটির পর নিজেই নিয়ে আসবেন। এখন ওদের লাফানোর বয়স। একদম ঘোড়ার লাগামের মতো টেনে ধরবেন।’

এবার ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে দুরন্তর দুর্গতি শুরু। উঠতে-বসতে এক শ একটা বিধিনিষেধ। আর দুর্গতিও যেন ওত পেতে থাকে। এ জন্য দুরু দুরু ভাবটা থাকেই। পন্টি ভাইয়ের এ ডাকের মধ্যে কোন প্যাঁচ পাক খেয়ে আছে কে জানে!

পন্টি নিজেই ছুটে আসে। দুরন্তর গালে ঠোকনা মেরে বলে, ‘কী রে, এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি কি বাঘ-ভালুক নাকি? খেয়ে ফেলব তোকে?’

চুপসে যায় দুরন্ত। হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘না না, ভয় পাব কেন? একটু তাড়া আছে, ভাবছিলাম ওখানে যাওয়া ঠিক হবে কি না।’

দুরন্তর হাতের সমুচা, চানাচুর আর বিস্কুটের দিকে চোখ যায় পন্টির। দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘এগুলো মেহমানের জন্য নিয়ে যাচ্ছিস বুঝি?’

অবলীলায় সমুচার মোড়ক খুলে একটা তুলে নেয় সে। চিবোতে চিবোতে বলে, ‘দু শ টাকা দে তো, কালকেই দিয়ে দেব।’

‘ও মা, আমি এত টাকা পাব কোথায়?’ আকাশ থেকে পড়ে দুরন্ত।

পন্টি বলে, ‘সেকি রে, ক্লাস এইটে পড়া একটা ছেলের কাছে দেড় শ-দু শ টাকা থাকবে না, এটা কেমন কথা? এটা কোনো ব্যাটাছেলের কথা হলো? ঠিক আছে যা, এক শ টাকাই দে। কাল ঠিক দিয়ে দেব।’

এবার টনক নড়ে দুরন্তর। তাই তো। ও তো ব্যাটাছেলে। টাকা না থাকা তো প্রেস্টিজের ব্যাপার! এখন কী করা যায়? কিন্তু বাবা-মা এখনো ওকে সেভাবে টাকাপয়সা দেন না। কখনো পঞ্চাশ বা এক শ টাকা খরচ করলে পইপই করে হিসাব নেন। এর মধ্যে টাকা ও জমাবে কী করে?

কিন্তু এসব পন্টি ভাইকে বলা যাবে না। মান খসে পড়বে। তার মতো দেমাগি ছেলেকে দেড়-দু শ টাকা ধার দিলে বরং মান বাড়বে। খাবারগুলো কেনার পর কিছু টাকা অবশ্য দুরন্তর কাছে আছে। কিন্তু শ খানেক থেকে অনেক দূরে। তা ছাড়া বাবা-মাকে না বলে কিছু করা এখনো শেখেনি ও। শিখতে পারবে বলেও মনে হয় না। এখন ছোট আপুর কাছ থেকে যদি বলে-কয়ে কিছু নেওয়া যায়।

পন্টিকে রান্নাঘরের পেছনে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে ঢোকে দুরন্ত। ঢুকেই হকচকিয়ে যায়। স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন দুরন্তর বজলু মামা। বেরিয়েই পড়লেন এক খ্যাপাটে লোকের পাল্লায়। ‘টাকা দে-টাকা দে’ বলে অনেক দূর পর্যন্ত সে তাড়া করেছে মামাকে। শেষে বাসে উঠে রক্ষা। এখনো ‘টাকা দে’ বুলি চক্কর দিচ্ছে মাথায়।

বুয়া কালামের মা মামার মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে বলছেন, ‘কয়ডা টেকা দিলেই পারতেন, মামা। কামেল ফকিররা এমুন নাছোড়বান্দা অয়।’

এই হুলস্থুলে পন্টির কথা একদম ভুলে গেল দুরন্ত।

এদিকে রান্নাঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে খেতে পন্টি বেচারার হালুয়া টাইট। দোকানে বাকি খাওয়া আর এর-ওর কাছে ধার করাটা এখন বিচ্ছিরি স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর। মহল্লার গোঁয়ার ছেলে নাদিমের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে ভুলে গিয়েছিল ও। নাদিম ওকে হুঁশিয়ার করেছে, ‘কালকের মধ্যে টাকাটা না দিলে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে।’ এ জন্যই তো দুরন্তকে কাত করার ধান্দা।

মনে মনে দুরন্তর মাথায় চৌদ্দটা চাঁটি মারল পন্টি। কিন্তু দুর্গতির কি এখানেই শেষ? চুলায় ভাত বসিয়ে রেখে গিয়েছিল কালামের মা। ভাতের ফ্যান উতরে ছ্যারছ্যার করে পড়ছিল। শব্দ শুনে দৌড়ে এল সে। বড় চামচে ফ্যান তুলে খোলা জানালা দিয়ে ছুড়ে মারল। খানিকটা এসে পড়ল পন্টির গায়ে। অমনি ক্যাঙারুর মতো লাফ দিল সে। মুখ থেকে বেরোল বিচিত্র শব্দ ‘কেঁউ’। ভাগ্যিস, সেভাবে লাগেনি। নির্ঘাত ঝলসে যেত গা।

পন্টির আজব শব্দ শুনে ভড়কে গেছে কালামের মা। ভূতের ভয় আছে তাঁর। রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। বজলু মামা তখন মাথা মুছতে মুছতে তাঁর ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, তাঁকে পেয়ে অকাতরে মনের কথা ঝাড়ল কালামের মা। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘মামা, রান্নাঘরের পিছে কেমুন একটা শব্দ হইল!’

মামা ছুট দিলেন তা দেখতে। এদিকে পন্টি সদর দরজার পাশে ঘাপটি মেরে রাগে ফুঁসছে। আসুক দুরন্ত, আগে একটা রাম চাঁটি, তারপর টাকা নিয়ে পিঠটান। ব্যস্ত পায়ে কেউ ছুটে আসছে ভেতর থেকে। এ নিশ্চয়ই দুরন্ত। তৈরি হয়ে যায় পন্টি। কায়াটা দরজায় আসতেই ‘টাকা দে’ বলে চাঁটি মারতে উদ্যত হয় সে। বজলু মামা অমনি ভয়ে আধমরা। সেই খ্যাপাটে লোক রূপ বদলে এখানেও হাজির! তবে কি তিনি সত্যিই কামেল ফকির? বিকট সুরে চিৎকার জুড়ে দেন তিনি। ওদিকে পন্টি এক দৌড়ে পগার পার!