মুক্তিযুদ্ধ ও 'বন্দী শিবির থেকে'

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

একটা ভাষার ও জাতির বড় কবির যে বৈশিষ্ট্য, তার অধিকাংশই শামসুর রাহমানের ছিল। সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্যটি খালি চোখেই ধরা পড়ে তা হচ্ছে, তাঁর কবিতার একটা বড় অংশের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপ-রূপান্তরের ইতিহাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছে। তাঁর কবিতা অধিকাংশ সময় পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেতনার মর্মশাঁসকে ধারণ করে শিল্পিত হয়েছে। বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২) কাব্যের ক্ষেত্রে এ কথা একেবারে চোখ বুজে বলা যায়। এই কবিতার বইয়ে জাতীয়তাবাদের অ্যাসেন্স, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় চৈতন্য আর শিল্পিতার একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে।

পূর্ব বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেল হয়ে একত্র হয়েছিল, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে আত্মত্যাগের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কারা সেই যুদ্ধে গিয়েছিল, আত্মাহুতি দিয়েছিল? হিন্দু নাকি মুসলমান? শামসুর রাহমানের কবিতা লক্ষ করলে দেখব, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাই সেদিন ক্রিয়াশীল ছিল। এ কারণে কবি যখন মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া মানুষের তালিকা করতে যাচ্ছেন, তাঁর সেই তালিকা কিন্তু পূর্ব বাংলার বাঙালি জনচৈতন্যের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবটিকে অনায়াসে প্রকাশ করেছে। কবি যে মুহূর্তে বলেন, ‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এ কারণে কবি ‘সকিনা বিবি’ আর ‘হরিদাসীর’ আত্মত্যাগের বয়ানকে পাশাপাশি রেখেছেন, সমান মর্যাদা দিয়েছেন। একই প্রবণতা আমরা লক্ষ করি ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়। সেখানে নজরুল আর রবীন্দ্রনাথকে কবি সমানভাবে তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধের মধ্যে একাকার করে দিয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘অজর কবিতা’কে যেমন স্বাধীনতার সমার্থক মনে করেছেন, তেমনি নজরুলের ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’কেও স্বাধীনতা হিসেবে অনুভব করেছেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে সম্প্রদায়ের চিহ্নসূত্র লুপ্ত করতে পেরেছিল, তা শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের পুরাণ ব্যবহারের ধরনেও স্পষ্ট হয়েছে। যেমন ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’ ‘খাণ্ডবদাহন’—এই হিন্দু মিথের ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্গত সৌরভ-সুগন্ধির স্মারক হয়ে উঠেছে। একই ধরনের মিথের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় ‘প্রবেশাধিকার নেই’ কবিতায় ‘দুর্বাসা’ মুনি আর ‘প্রাত্যহিক’ কবিতায় ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’-এর মিথ ব্যবহারের মধ্যে। স্মরণ রাখা দরকার, ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার কবিতা ও সংস্কৃতি থেকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলতে কত কসরতই না করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তার বিপরীতে কবিতায় এসব মিথের ব্যবহার জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং এর ধারক-কবির শক্তি-সাহসকে প্রকাশ করে বৈকি।

শুধু অসাম্প্রদায়িকতা নয়, অন্য অনেক দিক থেকেই কবিতার বইটি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে আছে। সব জাতীয়তাবাদী চেতনার লক্ষ্য থাকে জাতির অধিকাংশ মানুষকে একই আবেগ আর স্বপ্নের ছায়ার নিচে নিয়ে আসা। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী চেতনাও সেই সাধ্য-সাধনাই করেছে। এ জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের সময় পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বারবার অর্থনৈতিক সাম্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদির কথা বলেছে। পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ এসবের প্রশ্নে এক হওয়ার ব্যাকুলতা প্রদর্শন করেছে এবং দিনে দিনে এক হয়েও উঠেছে। ফলে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনে ঘরে তুলেছে সফলতার ফসল। ১৯৭১-এ দ্বিধাহীন চিত্তে প্রায় অস্ত্র ছাড়াই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ঘর ছেড়েছে। স্বাধীনতার আকুল পিপাসা সর্বস্তরের মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিল। আর সবাইকে একই স্বপ্নে শামিল করানোর এই কাজটি করেছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যকার শ্রেণিচেতনা। অর্থনৈতিক সাম্যের যে ধারণা জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে ছিল, তা-ই সাত কোটি মানুষকে এক পতাকার তলে দাঁড় করেছিল। শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্য পড়তে গেলে জাতীয়তাবাদের এই আদর্শটি সহজেই চোখে পড়ে। কবি খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন, স্বাধীনতার জন্য কারা কারা অপেক্ষা করছে বা আত্মত্যাগের জন্য ঘর ছেড়েছে। কবির তালিকা অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। তালিকায় স্থান পেয়েছে ‘হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী’, ‘সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক’, ‘কেষ্টদাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা’, ‘মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি’, ‘রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্শাওয়ালা’ আর ‘রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো সেই তেজী তরুণ’। একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তিনি যখন স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত করেন ‘গ্রাম্য মেয়ে’ থেকে শুরু করে ‘মেধাবী শিক্ষার্থী’ হয়ে ‘মজুর যুবা’ পর্যন্ত। কবিকৃত আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এই তালিকা সমকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার ভেতরবাড়িকে উজালা করে আছে। মুক্তিযুদ্ধ যে একটা জনযুদ্ধ ছিল, এখানে যে সবাই ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার হিসাব মেলাতে মিলিত হয়েছিল, এটা যে গরিব মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত ছিল, বন্দী শিবির থেকেতে সেটি কবি বলে ফেলেছেন এক নিশ্বাসে।

কেবল তা-ই নয়, জাতীয়তাবাদী চেতনা সব সময় স্বজাতির আত্মত্যাগকে গৌরবান্বিত করতে চায়। এই প্রবণতা প্রকাশ করেছে ‘মধুস্মৃতি’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তরে’ আর ‘তার উক্তি’ কবিতায়। একই সঙ্গে ‘শহীদ মিনার’-এর সূত্র ধরে বায়ান্নর স্মৃতিকে স্মরণ করতেও কসুর করেননি কবি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে বড় কবির সাহিত্য জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার যে দায়িত্ব নেয়, শামসুর রাহমানের বন্দী শিবির থেকে সেই দায়িত্বও পালন করেছে। উদাহরণ দেখা যাক, ‘অথচ জানে না ওরা কেউ/ গাছের পাতায়, ফুটপাতে/ পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে/ পথের ধুলায়/ বস্তির দুরন্ত ছেলেটার/ হাতের মুঠোয়/ সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি’ (‘বন্দী শিবির থেকে’)। ‘গেরিলা’ কবিতার ওই চরণ, ‘তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর/ সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া’ অথবা ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,/ নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’—একই উদ্দেশ্যকে মূর্ত করেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের এসব লাইনের চৈতন্য আর এর প্রতিটি শব্দ সাত কোটি বাঙালির আকাঙ্ক্ষার স্মারকে পরিণত হয়েছে। এভাবে ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যটি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিচিত্র প্রবণতাকে ধারণ করে চব্বিশ বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিকল্প হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও দলিল। এ কারণেই বোধ করি শামসুর রাহমান বাঙালির বড় কবি, যিনি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কাব্যভাষায় গ্রেপ্তার করতে পেরেছিলেন।

বন্দী শিবির থেকে–এর বাংলাদেশ সংস্করণের প্রচ্ছদ
বন্দী শিবির থেকে–এর বাংলাদেশ সংস্করণের প্রচ্ছদ

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক যেটা করেছেন, তাকে এককথায় বলা যায় ‘মেলোড্রামা’। হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের কাঁচা বর্ণনায় অধিকাংশের কাব্য-কবিতা ঠাসা। একমাত্রিক খণ্ডচিত্রই যেন ওই সব রচনার অন্বিষ্ট। কিন্তু প্রকৃত শিল্পী তো কাঁচামালের কারবার করেন না, কাঁচামালকে শিল্পে পরিণত করেন। শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতায় এই শিল্পিতার বিষয়টি সহজেই চোখে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য অসম্ভব আবেগের ব্যাপার। কিন্তু কবি যখন সেই আবেগের বিষয়কে কবিতায় রূপ দেন, তার প্রকাশের মধ্যে থাকতে হয় শৈল্পিক সংযম। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সাহিত্যিক এখানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যে যা দেখেছেন লিখে ফেলেছেন, লক্ষ লক্ষ বুলেট নিক্ষেপ করেছেন কাগজে, ক্রাইম স্টোরি লেখার মতো করে...।’ কিন্তু শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ এই অভিযোগের খড়্‌গ থেকে মুক্ত বলেই মনে হয়। এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি কবিতাই আশ্চর্য শৈল্পিক সংযমে অসংযমকে ধারণ করেছে। নীরবতা দিয়ে সশব্দকে ধারণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে ‘উদ্বাস্তু’ কবিতাটিই লক্ষ করা যাক। কবি ঢাকা শহরে পাকিস্তানি তাণ্ডবের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে, ‘আমার চাদ্দিকে দালান কেবলি যাচ্ছে ধসে,/ আমার সম্মুখে/ এবং পেছনে/ দেয়াল পড়ছে ভেঙে এক এক, যেন/ মাতাল জুয়াড়ী কেউ নিপুণ হেলায়/ হাতের প্রতিটি তাশ দিচ্ছে ছুড়ে। আমি/ কত ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে হাঁটি/ করাল বেলায়। জনসাধারণ ছিন্ন/ মালার মুক্তোর মতো বিক্ষিপ্ত চৌদিকে।’

মুক্তিযুদ্ধকালীন ধ্বংসের এমন ঠান্ডা অথচ বিধ্বংসী রক্ত বলকে ওঠার মতো বর্ণনা বাংলাদেশের সাহিত্যে বিরল। ‘পথের কুকুর’, ‘প্রতিটি অক্ষরে’ ‘আমারও সৈনিক ছিল’ ‘বন্দী শিবির থেকে’, ‘না, আমি যাব না’, ‘কাক’—এই কবিতাগুলোও এই তালিকায় অনায়াসে যুক্ত হতে পারে।

শিল্পীর থাকতে হয় অসংখ্য চোখ বা সামগ্রিকতা বোধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাজারো ঘটনা ঘটেছে। হাজারো মানুষের মধ্যে এই যুদ্ধ হাজারো মাত্রায়, হাজারো কৌণিকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, আলো ফেলেছে। জনগোষ্ঠীর কবি হিসেবে এগুলোর অনুবাদ হাজির করেন বড় কবিরা। কবি তো আকাশ থেকে ভাষা পান না। ভাষা পান তাঁর চারপাশ থেকে।

শামসুর রাহমানের কবিতাগুলো দেখলে এটি স্পষ্ট বোঝা যায়। মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র দিক তিনি দেখেছেন আর বাণীবদ্ধ করেছেন। যখন বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলার ‘শান্তিপ্রিয় ভদ্রজনও সমস্বরে’ বলে উঠেছিল, ‘যুদ্ধই উদ্ধার’, তখন সেই ভাষা আর চেতনা তিনি যে তাঁর স্বজাতির মুখ থেকেই নেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একই সঙ্গে জাতির রূপান্তরের সত্যও ঝলক দিয়ে ওঠে কবিতার প্রতিটি শব্দের মধ্যে, প্রতিটি লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁকে। আবার যেমন ‘গ্রামীণ’ নামক কবিতায় কবি দেখিয়েছেন একাত্তরে মানুষ কীভাবে বদলে যাচ্ছিল। একাত্তর তো বদলে দিয়েছিল লাখো বাঙালিকে। যাঁরা আগে থেকেই বদলে যাচ্ছিলেন প্রতিরোধের জন্য, তাঁরা তো আছেনই। কিন্তু গণ্ডগ্রামের এক কৃষক, যে কিনা কোনো দিন ‘রাখাল’, ‘দোতারা’ আর ‘আলুথালু পরান বধূরে গৃহকোণে ফেলে রেখে কড়ির লোভে পরদেশী’ হয়নি, তার ‘তরুণ রক্তে সহস্র বাসুকি কেন ফণা তুলল?’ সে কেন ‘হঠাৎ গণ্ডগ্রামে অস্ত্রাগারে হাত বাড়াল?’ এই বদলে যাওয়ারই সুলুকসন্ধান করেছেন শামসুর রাহমান। গণ্ডগ্রামের ওই রূপান্তরিত লোককে দিয়ে বলিয়েছেন, ‘যাকে ভালোবাসি সে যেন পুকুরে ঘাটে ঘড়া রোজ/ নিঃশঙ্ক ভাসাতে পারে, যেন এই দুরন্ত ফিরোজ,/ আমার সোদর, যেতে পারে হাটে হাওয়ায় হাওয়ায়,/ বাজান টানতে পারে হুঁকো খুব নিশ্চিন্তে দাওয়ায়...’। এই কারণগুলো কি শুধু এই আক্ষরিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ? নাকি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরাধীনতার গ্লানি, নিত্যকার অনিশ্চয়তা আর শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস? এ কারণে বলতেই হবে শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কেবল মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক বর্ণনা নয়। এই কাব্যের অনেক কবিতার ভেতরের বিষয়ের ভিত্তি ২৪ বছরের ইতিহাসের পথরেখায় খোঁজ করার দাবি রাখে। মুক্তিযুদ্ধকে দেখার ক্ষেত্রে কবির দারুণ সামগ্রিকতার পরিচয় রয়েছে এখানে।

ত্রিশ লাখ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার হয়েছিল। কিন্তু বাকিরাও কি মর্মে-হত্যার শিকার হয়নি? এই মর্মে-হত্যাও তো গণহত্যার আওতাভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের কাব্য-কবিতা সাধারণত এই হত্যা সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকে। বন্দী শিবির থেকে অকথিত, অনুল্লেখিত এসব হত্যার এক অসাধারণ দলিল হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে আছে এসব হত্যার শ্বাসরোধী বর্ণনা। চেখে দেখা যাক কয়েকটি লাইন, ‘আমিও নিজেকে ভালোবাসি/ আর দশজনের মতন। ঘাতকের/ অস্ত্রের আঘাত/ এড়িয়ে থাকতে চাই আমিও সর্বদা।/ অথচ এখানে রাস্তাঘাটে/ সবাইকে মনে হয় প্রচ্ছন্ন ঘাতক।/ মনে হয়, যে কোনো নিশ্চুপ পথচারী/ জামার তলায়/ লুকিয়ে রেখেছে ছোরা, অথবা রিভলবার, যেন/ চোরাগোপ্তা খুনে/ পাকিয়েছে হাত সকলেই।’ (‘না, আমি যাবো না’)

প্রতিমুহূর্তের এই মর্মান্তিক গণহত্যার ভাষ্য রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলোতে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। ‘দখলি স্বত্ব’ কবিতার বোধ আরও গভীর ও ভয়াবহ। যুদ্ধের কারণে ফেলে আসা বাড়িতে আবার ফেরার কথা মনে উঠতেই কবির মনে হয়েছে, ‘অথচ আমার/ বাড়ির দখলি স্বত্ব হারিয়ে ফেলেছি।/ সব কটি ঘর জুড়ে বসে আছে দেখি/ বিষম অচেনা এক লোক-/ পরনে পোশাক খাকি, হাতে কারবাইন।’ কী ঠান্ডা অথচ ভয়ংকর বোধ! ‘পথের কুকুর’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অবরুদ্ধ মানুষের বোধ শিল্পিত হয়েছে এভাবে, ‘সমস্ত শহরে/ সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি, দাগছে কামান/ এবং চালাচ্ছে ট্যাঙ্ক যত্রতত্র। মরছে মানুষ/ পথে ঘাটে ঘরে, যেন প্লেগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর।/ আমরা ক’জন শ্বাসজীবী—/ ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের শাণিত চিৎকার/ কানে আসে, যাই জানালার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই/ পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ/ একটি জিপের দিকে, জিপে/ সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি/ অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর।’ অবরুদ্ধতা, ক্ষোভ আর মর্মে-হত্যার এমন নিচু স্বরের অথচ গগনবিদারী শিল্পীত রূপায়ণ কথাসাহিত্য আর কাব্যসাহিত্য উভয় শাখাতেই বিরল। বন্দী শিবির থেকেতে কবি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ধ্বংস, দ্রোহ, অসহায়তা, আত্মপ্রত্যয়, বিশ্বাসঘাতকতা, উদ্বাস্তুতা, অন্তর্ঘাত, স্বপ্ন, সার্থকতা, নিঃস্বতার এমন নিবিড় সূক্ষ্ম আর বিস্তৃত বর্ণনা হাজির করেছেন যে অনেক সময় মনে হয় এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতার ঘাটতি পূরণ করে উপন্যাসের দৈন্য ঘোচানোর দিকে পা বাড়িয়েছে। কারণ বাস্তবের বিস্তৃত, খুঁটিনাটি বর্ণনাই তো উপন্যাস।

 জাতীয়তাবাদ আর মুক্তিযুদ্ধের গভীর গণমুখী দলিল হিসেবে পড়া যায়, বাংলাদেশের সৃজনশীল সাহিত্যে এমন টেক্সট বিরল। বন্দী শিবির থেকে আর এর কবি শামসুর রাহমানকে এই দৃষ্টিতে পড়া যায়। সমকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনার গভীর তলকে স্পর্শের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অ্যাসেন্স উপলব্ধির প্রশ্নে, শিল্পিতার প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সাধারণ মানুষের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন চিহ্নিত করার প্রশ্নে, পাকিস্তানি শাসনের চব্বিশ বছরের ইতিহাসের ইশারা ধারণ করার প্রশ্নে বন্দী শিবির থেকে বাংলাদেশের কবিতায় এক বিরল অভিজ্ঞতাই বটে।