'অসুখী দিন' শেষে আবার উপন্যাসে

>

শাহীন আখতার
শাহীন আখতার

নতুন বছরে নতুনের আবাহনে সবাই নিজের মুখোমুখি হন, করেন নতুন পরিকল্পনা। লেখকেরাও এর বাইরে নন। এই আয়োজনে শাহীন আখতার লিখেছেন ২০১৮ সালে লেখালেখি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা

সবে আমার উপন্যাস লেখা শেষ হয়েছে, যা প্রথমা থেকে অসুখী দিন নামে ২০১৮-এর ফেব্রুয়ারির বইমেলায় বের হবে। এখনো আমার কম্পিউটার টেবিল আর পড়ার টেবিল বোঝাই এই উপন্যাসের বিভিন্ন সময়ের খসড়া, নোটস আর নানা তথ্য-উপাত্তে। এই সমস্ত কিছু সরানো মানে দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকা কোনো আত্মীয় বা সঙ্গীকে বিদায় জানানোর মতো বেদনাদায়ক। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে কাজটা করতে হবে। তারপর উপন্যাসের মানুষগুলোর সঙ্গে আমার হয়তো দেখা হবে কালেভদ্রে, যখন বইয়ের পাতা ওল্টানো বা পাঠ করার ইচ্ছা হবে এর কোনো অংশবিশেষ।

ময়ূর সিংহাসন প্রকাশের চার বছর পর অসুখী দিন আমার পঞ্চম উপন্যাস। তিন-চার বছর ধরে যাঁরা উপন্যাস লেখেন, আমার মনে হয় তার মধ্যে সেই লেখকেরা বসবাস করেন। আমিও এই দীর্ঘ সময় অসুখী দিন-এর বাইরে শারীরিক ও মানসিকভাবে পা ফেলিনি। শোকে, অসুখে ছিটকে পড়লেও এর মাঝে আশ্রয় খুঁজেছি। তাড়াতাড়ি ফিরতে চেয়েছি। উপন্যাসটা শেষ হওয়া মানে একটা শূন্যতায় নিপতিত হওয়া।

আমার মধ্যে এখন সেই শূন্যতা বিরাজমান। আরেকভাবে বলা যায়, উপন্যাস লেখাটা আমার কাছে লম্বা এক ভ্রমণের মতো। নতুন নতুন লোকালয়, অদেখা সময় আর অচেনা পথে বিচরণ। নানা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে চলতে চলতে শেখা। লেখা শেষ হওয়া মানে ভ্রমণটা শেষ হলেও এর রেশ থেকে যায়। তীব্রভাবেই থেকে যায়। তাই ২০১৮ সালে কী নিয়ে লিখব, এখনই স্পষ্ট করে বলা কঠিন।

তবে বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি ২০১৮ সালের শুরুর কয়েক মাসে দু-একটা ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করব। লিখবও। কিন্তু তুষ্ট হব না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আঁকড়ে ধরা যায় কেবল লিখতে থাকা উপন্যাসের জমাটবাঁধা ভাবনাগুলোকে। এই কল্পিত জগৎটা নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন বলেই হয়তো তা সম্ভব। এ ছাড়া আরও কিছু কারণে আমি ২০১৮-এর মাঝামাঝি পরবর্তী উপন্যাসের নোট নিতে থাকব। আবছা একটা প্লট তখন মাথায় থাকবে। নোট নিতে নিতে বছর শেষে তার একটা চেহারা ভেসে উঠবে। ‘কীভাবে লিখব’, মানে আঙ্গিকটা কী হবে, এটা ২০১৮তে জ্বালাবে খুব। আশাতীত মাত্রায় সময়ও নিয়ে নেবে। আমি কয়েকটা বিকল্প পন্থা নিয়ে ভাবব। কাগজ নষ্ট করব। আর চরম হতাশায় ভুগব।

দুই-আড়াই দশক ধরে লিখতে লিখতে বুঝেছি, ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ ঘরানার লেখক নই আমি। বিশেষত উপন্যাসে। ঝান্ডা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ধাঁচের না হলেও কিছু একটা বলতে চাই, যা এই সময়ের একজন মানুষ হিসেবে আমাকে যন্ত্রণা দেয়, ভাবায় তার বিপরীতে কিছু। আমাদের এখানে ইতিহাসচর্চায় কোথাও একটা গাফিলি রয়েছে। আমরা দুই শ বছরের ইংরেজ শাসন নিয়ে কথা বলি না। সিপাহি বিদ্রোহের দিনটা নীরবে চলে যায়। ইংরেজ শাসকের তৈরি ১৯৪৩-এর মন্বন্তরে এই অঞ্চলের মানুষ পোকামাকড়ের মতো মরেছে। গ্রামকে গ্রাম বিরান হয়ে গেছে। আমরা সেই সব মনেও করতে চাই না। সবচেয়ে দুঃখজনক যে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে আমরা আমাদের ফুটমার্ক রাখতে চাই না। ক্রমাগত তা মুছে দিচ্ছি। আমার মনে হয় ভয়ানক আত্মঘাতী এটা। এই আত্মঘাতী ব্যাপারটা মূলত গত শতকের চল্লিশের দশক নিয়ে অসুখী দিন নামের উপন্যাসটি লিখতে আমাকে তাড়িত করে।

তার আগের উপন্যাস ময়ূর সিংহাসন এক দিক থেকে মোগল হারেমেরই কাহিনি, যে হারেম নিয়ে বাংলা সাহিত্যের রথী-মহারথীর নেতিবাচক বয়ান রয়েছে। তা ছাড়া বর্তমানের অনেক বিরোধী প্রচারণা, নির্দিষ্ট একটা ধর্ম-সংস্কৃতি, গোষ্ঠীকে আঘাত করা, অপমান করার জবাব চেতন-অবচেতনে হয়তো তৈরি হচ্ছিল; যার প্রতিফলন ঘটেছে ময়ূর সিংহাসন-এর নানা বাঁকে, কাহিনিটা তিন শ-সাড়ে তিন শ বছরের আগেকার হলেও। তাই বলে উপন্যাসটি আত্মরক্ষামূলক প্রণোদনা থেকে রচিত, তা বলা যাবে না। মোগল সংস্কৃতির অতুলনীয় বৈভব, সৌন্দর্য, সৌরভ, লালিত্য সেই বাধা উতরাতে দারুণ সহায়ক হয়েছে। আমি মনে করি, কোনো লেখা গোলাপ ফুল, প্রজাপতি নিয়ে হলেও তাতে রাজনীতি থাকতে পারে। আর আমি প্রায় নিশ্চিত,Ñএর ব্যত্যয় ঘটবে না ২০১৮ সালে আমার মনের কোণে অঙ্কুরিত হতে থাকা উপন্যাসেও।