সেকালের বই বিপণন ও বিক্রেতারা

শিল্পীর চোখে সেকালের বই বিক্রি। অলংকরণ: আরাফাত
শিল্পীর চোখে সেকালের বই বিক্রি। অলংকরণ: আরাফাত

মধ্যযুগের বাংলাদেশে, যখন মুদ্রণযন্ত্র আকাশকুসুম কল্পনা এবং হস্তলিখিত পুথির চল কেবল শুরু হয়েছে, সে সময় কি বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্যও হাতে লিখে পুথি তৈরি করতেন লিপিকরেরা? নাকি শুধুই আসর জমাতে দক্ষ পুথিপাঠকের সর্বক্ষণের সঙ্গী হওয়ার লক্ষ্যে নিছক লিপিকরের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার জন্য সেসব পুথি নির্মিত হতো? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দুরূহই বৈকি। তবে ছাপাখানা আসার আগে লিপিকরেরা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিত্তশালী ক্রেতাদের থেকে বায়না নিয়ে পুথি নির্মাণ করতেন, এমন নিদর্শন দুর্লভ নয়। এই বিত্তশালী ক্রেতাদের মধ্যে যেমন থাকতেন সেকালের রাজা বা নবাবদের অনেকেই, তেমনি ছিলেন ভূস্বামী ও জমিদারেরাও।

সুলতানি আমলে, বিশেষত হোসেন শাহর রাজত্বকালে তাঁর আন্তরিক উদ্যোগে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রসার ঘটায় সমকালীন কাব্যসাহিত্যের পুথির প্রতিলিপি তৈরি ও নকলনবিশির চলও বেড়ে গিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যের কথা বলা যায়। সে সময় এই কাব্যটি জনপ্রিয় হওয়ার কারণে এর মূল পাণ্ডুলিপি থেকে নকলকৃত পুথি নির্মাণের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এ জন্য কিন্তু বিপত্তি একটা ঘটেছিল। তা এই, একাধিক লিপিকরের হাতে মনসামঙ্গল-এর পুথি পুনর্নির্মিত হওয়ার ফলে একই সময়ে পাওয়া কাব্যটির একাধিক পাণ্ডুলিপির পাঠে প্রচণ্ড তফাত পরিলক্ষিত হয় (হোসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮, মমতাজুর রহমান তরফদার, পৃ. ২২১-২২২)। যা হোক, এই প্রতিলিপি-পুথিগুলো অবশ্য সেকালের সাধারণ বাঙালিরা কিনতেন এমন কোনো নিরেট তথ্য সে যুগের ইতিহাসে মেলে না। কেননা, তখন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। আর পড়তে-লিখতে সক্ষম ছিলেন যাঁরা, তাঁরাও যে একটি পুথি কেনার সামর্থ্য রাখতেন তা-ও নয়। অবস্থাপন্ন আমুদে গৃহস্থরা নিজেদের বসতবাটিতে পুথিপাঠের আসর জমানোর জন্য জনপ্রিয় এক বা একাধিক পুথি ক্রয় করতেন, এমন ধারণা কেউ কেউ করেন। আবার কেউ নেহাত শখের বশে পুথি সংগ্রহের নেশা ধরেছিলেন। আর কোনো কোনো বিত্তশালী ব্যক্তির উদ্দেশ্য ছিল শুধু ধর্মসংক্রান্ত পুথি কিনে পণ্ডিত-ব্রাহ্মণদের দান করা, যাতে কিছু পুণ্য সঞ্চয় হয়। সে সময় পুথির মূল্য মুদ্রায় পরিশোধের পাশাপাশি ধান বা অন্য খাদ্যশস্য দেওয়ার চলও নাকি ছিল। অন্যদিকে রাজা-বাদশাহরা পুথি কিনতেন রাজদরবারে সংরক্ষণের জন্য এবং লিপিকরদের পৃষ্ঠপোষকতার নিমিত্তে।

সে যুগের পেশাদার লিপিকরেরা কালি-কাগজ জোগাড় করার পর পুথি নির্মাণ করে তা হাট-বাজারে-মেলায় ঘুরে ঘুরে বা সেখানে মাটিতে মাদুর পেতে সাজিয়ে বিক্রি করতেন—এমনটা হওয়া অসম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ। তবে এসব ‘পাবলিক প্লেসে’ পুথি বেচে যে তাঁদের বিশেষ আয়-রোজগার হতো এমন নয়, শেষমেশ লিপিকরদের ‘সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিদের অনুগ্রহজীবী’ হওয়াই ছিল নিয়তি। তবে অন্তত আঠারো শতক অব্দি নকলকৃত পুথির দাম নেহাত কম ছিল না। ১৭১৭ সালে প্রাপ্ত একটি পুথির পরিশিষ্টে লিপিকর জানিয়েছিলেন, তিনি উক্ত পুথির দাম হিসেবে নগদ দক্ষিণা তো পেয়েইছেন, সঙ্গে মিলেছে বাড়তি ভাতা এবং সারা জীবনের জন্য একটি বৃত্তিও। ১৭২৮ সালে লিপিকর দর্পনারায়ণ দাশ এক কপি রামায়ণ বিক্রি করে পেয়েছিলেন নগদ সাত টাকা ও নতুন জামাকাপড়। ১৭৫২ সালে কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল কাব্যের পুথি নকল করে আত্মারাম ঘোষের ভাগ্যে জুটেছিল ‘১ জোড়া কাপড় আর ২ তঙ্কা’ (জনসভার সাহিত্য, বিনয় ঘোঘ, পৃ. ৪৮-৪৯)।

এরপর ১৭৭৮ সালে বাংলায় এল মুদ্রণযন্ত্রের যুগ। ‘চাহিবামাত্র’ ইচ্ছামতো বই ছাপিয়ে নেওয়ার সুযোগ বাংলা বইয়ের বাজারকে আরও বিস্তৃত করল। পরিবর্তনশীল আবহে নকলনবিশ লিপিকরেরা গ্রন্থনির্মাণের যজ্ঞ থেকে সরে গেলেন, মুদ্রণযন্ত্রের মালিকেরাই হয়ে উঠলেন প্রকাশক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই আবার বিপণনকারী। বইয়ের দোকান ছাড়াও প্রকাশকদের বাড়িও পাইকারি ও খুচরা বই বিক্রয়ের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ সময় এলেন সাদামাটা বইবিক্রেতা ও ফেরিওয়ালারাও, যাঁরা ছাপেন না, কিন্তু বেচেন। সেকালের কলকাতায় প্রকাশক ও বিক্রেতার যুগলবন্দীর সার্থক উদাহরণ ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। মিশনারিদের গড়া শ্রীরামপুর প্রেসের সাবেক এই কর্মী ১৮২০ সালের দিকে নিজস্ব ছাপাখানা ও বই বিক্রয়কেন্দ্র খুলেই ক্ষান্ত হননি, কলকাতার বাইরে নিজের প্রকাশনার বই বিপণনের জন্য একাধিক ‘এজেন্ট’ও নিয়োগ করেছিলেন। আবার ওই সময় বাংলার নানা অঞ্চলে বইয়ের ফেরিওয়ালাদেরও দেখা যেত। তাঁদের সম্ভার ছিল কার্যত পাঁচমিশালি। বটতলার কি মজার সোমবার বা সখের জলপান গোছের বই থেকে শুরু করে ভারতচন্দ্রের কাব্য—সবই তাঁদের ঝুলিতে থাকত।

তবে বটতলায় বিদেশি বা ইংরেজি বই সেভাবে মিলত না, ইংরেজি বইয়ের খোঁজে তখন যেতে হতো চীনাবাজারে। এক ইংরেজ সাহেব তাঁর ডায়েরিতে চীনাবাজারের বইয়ের দোকানে শেক্সপিয়ার, রবার্ট বার্নস ও ওয়াল্টার স্কটের বই দেখে বিস্মিত হওয়ার কথা লিখেওছেন (কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, পৃ. ৪৩)।

সেকালে কলকাতায় বইবিক্রেতা ও প্রকাশকদের মূল আখড়া যেমন ছিল বটতলা, তেমনি পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর ঢাকার জমজমাট বইপাড়া ছিল চকবাজার। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মূলত মুসলমানি পুথির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় একটি স্বতন্ত্র ‘কেতাবপট্টি’ গড়ে ওঠে। চকবাজারের পশ্চিম দিকে স্থাপিত কয়েকটি বইয়ের দোকান ও ছাপাখানাকে ঘিরে দানা বাঁধতে থাকে এই পুথি-সাম্রাজ্য। শুধু চকবাজার নয়, আশপাশের অন্য কয়েকটি মহল্লায়ও ছিল গ্রন্থবিপণি ও ছাপাখানা (চকবাজারের কেতাবপট্টি, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, পৃ. ১৪-১৫)। ১৮৬০-এর দশকে ঢাকায় পঞ্চাশের অধিক নোট বই তথা ‘বোধিনী’ লিখে বাজার মাত করে দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ পাল নামের এক ব্যক্তি, তাঁর বইগুলো সেকালে প্রায় দুই লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ধারণা। তিনি নিজের বই নিজেই ছাপাতেন, বই বিক্রির জন্য মোগলটুলিতে দোকানও খুলেছিলেন। ঢাকায় অবশ্য তখন এমন আরও কয়েকজন লেখক ছিলেন, যাঁরা শুধু নিজেদের লেখা নোট বই বিক্রি ও ছাপানোর জন্যই বইয়ের ব্যবসায় এসেছিলেন (‘ঢাকার হারিয়ে যাওয়া বইয়ের খোঁজে’, রচনাবলি ২য় খণ্ড, মুনতাসীর মামুন, পৃ. ২৭৩-২৭৪)। এ ছাড়া ঢাকা-কলকাতায় অনেকেই তখন পুরোনো বইয়ের ব্যবসা করতেন। কথিত আছে, পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদ নবাববাড়ির গ্রন্থাগারের সব বহুমূল্য বই নৌকায় করে নিয়ে কলকাতায় পুরোনো বইয়ের আড়তদারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক মুনশি।

অবাক হলেও সত্যি, পেশাদার প্রকাশক ও বিক্রেতাদের পাশাপাশি অতীতে কয়েকজন কিংবদন্তিতুল্য বাঙালি লেখকও বই বিক্রির ব্যবসায় নেমেছিলেন। নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে প্রধানতম হলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৪৭ সালে কর্তৃপক্ষের ওপর রাগ করে সংস্কৃত কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর ঈশ্বরচন্দ্র নিজেকে রীতিমতো ‘লেখক-ব্যবসায়ী’রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামের একটি ছাপাখানা কিনে নিয়ে একদম পেশাদারি মনোভাবে তিনি বই ছাপানো শুরু করেন। সংস্কৃত-বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে মোট ৫২টি বই তিনি প্রকাশ করেছিলেন বলে তথ্য মেলে। শুধু বই ছাপানো ও প্রকাশনার কাজটুকুই নয়, মুদ্রিত বই সংরক্ষণের জন্য বিরাট আকারের একটি আড়তও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তবে একসময় তাঁর প্রকাশনার পাঠ্যবইয়ের দাম ‘বেশি’ এমন অভিযোগ তুলে সরকারি মহল বইগুলো কিনতে চায়নি, পরে অবশ্য দুপক্ষের রফায় এই সমস্যার সুরাহা হয় (হারাধনের দশটি ছেলে, মাহবুব আলম, পৃ. ৪৯)। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের প্রথম বই বাদে বাকি সব গ্রন্থই ছেপেছিলেন নিজের পয়সায়, স্বপ্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গদর্শন প্রেস’ থেকে। সরকারি চাকরির পাশাপাশি নিজের বই বিক্রি করেও তিনি কম পয়সা আয় করতেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্য প্রকাশকদের দুর্ব্যবহারে বিচলিত হয়ে নিজের বই নিজেই ছাপানো শুরু করেছিলেন। নিজগুণেই ‘বিশ্বভারতী’কে তিনি দ্রুতই রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা বানিয়ে ফেলেছিলেন। মীর মশাররফ হোসেনও পারিবারিক ক্ষয়িষ্ণু জমিদারির ওপর ভরসা না রাখতে পেরে নেমেছিলেন পুস্তক ব্যবসায়। টাঙ্গাইলে তিনি একটি ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু অভাব-অনটন কাটানোর ক্ষেত্রে এই ব্যবসা তাঁকে খুব সহায়তা করতে পারেনি। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ১৪ বৈশাখ নিজের ডায়েরিতে মীর বইপত্রের বিক্রি নিয়ে ভয়ানক হতাশার সঙ্গে লিখেছিলেন: ‘...পুস্তক বিক্রীর আয়ও এইক্ষণ অতি কম হইয়াছে। সপ্তাহ-দুই সপ্তাহ পর একখানি পুস্তক বিক্রয় হয়। আহারাদীর একপ্রকার অনাটন’ (মীর মশাররফ হোসেন: অপ্রকাশিত ডায়েরি, সম্পাদনা: আবুল আহসান চৌধুরী, পৃ. ৮৯)।

আজ থেকে এক শ বছরেরও বেশি সময় আগে বইয়ের বিপণন ও বিক্রেতাদের হাল দেখলে এখন খানিকটা অবাকই লাগে। সেকালে বইমেলা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না, এখন ঢাকা কি কলকাতায় বইমেলার ব্যবসা ছাড়া চলার কথা প্রকাশকেরা ভাবতেও পারেন না। সেকালের বই-ফেরিওয়ালা এখন পরিণত হয়েছেন অন্তর্জালবাহিত বিপণন মাধ্যমে। কোনো একদিন শহরের মোড়ে মোড়ে বড় আকারের গ্রন্থবিপণি থাকবে, এমন ভাবনা সম্ভবত সেকালে কেউ কল্পনাতেও আনেনি। বাংলা বইয়ের প্রকাশনা ও বই বিপণন এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগের পর্যায় ছেড়ে প্রবেশ করেছে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাঠামোয়। তবে সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপার শেষ অব্দি এই, সেকালের তুলনায় একালে পাঠকের সংযোগ অনেক বেশি বেড়েছে গ্রন্থ বিপণনব্যবস্থার সঙ্গে।