পুনশ্চ: রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা

২০১৮-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজনে আমরা—শিবব্রত বর্মনের সঞ্চালনায় আমি ও অধ্যাপক মহাম্মদদানীউল হক—বাংলাদেশের বর্তমান ভাষা-পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেছিলাম। সম্পাদক প্রসঙ্গের গুরুত্ব বিবেচনা করে শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘রাষ্ট্রভাষা না মাতৃভাষা’। শিরোনামে শব্দ দুটি বিপরীতার্থক শব্দজোড়ের মতো করে উপস্থাপিত হওয়ায় তা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁদের কেউ কেউ এ ধরনের বৈপরীত্য তৈরির ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর ‘শিল্পসাহিত্য’ পাতায় লিখিত আপত্তি জানিয়েছেন তারিক মনজুর। এসবের সূত্র ধরে এখানে বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করে বলার সুযোগ নিচ্ছি।

‘মাতৃভাষা’ কথাটি খুব আবেগের সঙ্গে ব্যবহৃত হলেও শব্দটিতে স্পষ্টতার কমতি আছে। আমরা যখন বলি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, তখন আসলে ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব স্পষ্ট করে কিছু বলা হয় না; কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা আসলে অঞ্চলবিশেষের উপভাষা। প্রমিত বাংলার প্রচণ্ড প্রতাপের মধ্যে, বিশেষত পাঠ্যপুস্তক আর প্রচারমাধ্যমের প্রভাবে ব্যাপারটা ঠিকমতো উপলব্ধি করা সহজ হয় না। পরিবার বা সমাজসূত্রে কারও ‘মাতৃভাষা’ যদি প্রমিত বাংলা হয়ও, নিশ্চিতভাবে বলা যাবে, বাংলা ভাষার অন্য উপভাষাগুলো তাঁর ‘মাতৃভাষা’ হবে না। সেগুলো তাঁকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে রপ্ত করতে হবে, যেমন বাংলাদেশের অঞ্চলবিশেষের ভাষাভাষীরা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখে প্রমিত বাংলা। একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা বলা যাক। ইংরেজি ভাষার বাংলাদেশি লেখক জিয়া হায়দার রহমান অল্প বয়সে লন্ডন চলে গিয়ে ইংরেজি শিখেছেন আর পারিবারিক বলয়ে ‘মাতৃভাষা’ হিসেবে শিখেছেন ‘সিলেটি’ ভাষা। ফলে, তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি ‘বাংলা’ জানেন না। মানে, প্রমিত বাংলা জানেন না।

এই বাস্তবতার মধ্যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ যে শেষ পর্যন্ত ‘বাংলা’ অর্থে ‘প্রমিত বাংলা’ শেখেন, তা আসলে ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবেই শেখেন। পাঠ্যপুস্তক ও প্রচারমাধ্যম রাষ্ট্রভাষা হিসেবেই প্রমিত বাংলা প্রচার করে থাকে। তার মানে, দৈনন্দিন ব্যবহারের বাইরে আনুষ্ঠানিক ব্যবহারে ভাষা সাধারণভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেই প্রবেশ করে। এই আনুষ্ঠানিক ব্যবহারটাই আসলে যেকোনো ভাষা-বিতর্কের উৎস। চট্টগ্রামি বা সিলেটি ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হলো কি না—এ প্রশ্ন এ কারণেই কখনো ওঠেনি। ওসব ভাষা ওই ওই অঞ্চলের মানুষ ‘মাতৃভাষা’ হিসেবে ব্যবহার করে কি না, সে প্রসঙ্গেও আলাপ ওঠে না। বাংলাদেশের মানুষ নদীয়ার ভাষায় কথা বলবে, নাকি ‘মৈমনসিং’-এর বাংলায়—এ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোনো উদ্বেগ ছিল না। যেমন চাকমা বা গারোরা তাদের ‘মাতৃভাষা’য় কথা ঠিকমতো বলছে কি না, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্বিকার। বায়ান্নয় আলাপটা ছিল বাংলা শিখে রাষ্ট্রের কাজ করা যাবে কি না; আর এখনকার চাকমা বা গারো ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংলাপের বিষয় ওই ওই ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করা যাবে কি না। যখনই ভাষা চাকরি বা শিক্ষার মতো আনুষ্ঠানিক জগতে প্রবেশ করে, তখনই আলাপটা ‘মাতৃভাষা’র স্তর ছাড়িয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা’য় প্রবেশ করে।

পাকিস্তান পর্বে আমাদের সংগ্রাম ছিল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। ভাষাপ্রেম বা মাতৃভাষা শিল্পসাহিত্য আর সাধারণ মানুষের প্রকাশমূলক অভিব্যক্তি মাত্র। এখনো আমাদের সমস্যাটি ভাষাপ্রেম, সাহিত্য, আবেগ বা কথা-চালাচালির নয়—রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে যথাসম্ভব অধিক মানুষের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের। সে কাজে আমরা অগ্রসর হতে পারিনি; বরং এসবের গোড়ার যে কাজ—শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার—কথিত ‘ইংলিশ ভার্সন’ চালুর মধ্য দিয়ে তাতেও মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছি। এমতাবস্থায় ‘রাষ্ট্রভাষা’র বদলে যদি ‘মাতৃভাষা’র বন্দনায় আমাদের ভাষাপ্রেম চরিতার্থ হতে থাকে, তাহলে বিপরীতার্থক শব্দজোড় তৈরি ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

রাষ্ট্রভাষার চাপে অন্য ভাষাগুলো যে আধিপত্যবাদী নিপীড়নের শিকার হয়—এই বাংলাদেশেও—সে প্রসঙ্গটি তুলে তারিক মনজুর ঠিক কাজই করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অন্য ভাষাভাষীরা শিক্ষা ও অপরাপর আনুষ্ঠানিক কাজে নিজ নিজ ভাষা কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য। শুধু মনে করিয়ে দিই, এই আলাপটাও ‘রাষ্ট্রভাষা’রই আলাপ, ‘মাতৃভাষা’র নয়।

মোহাম্মদ আজম

সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।