দৃশ্যভাষায় স্বতন্ত্র প্রকাশ

‘দোয়েল–শাপলার ড্রয়িং–১’, শিল্পী: ঢালী আল মামুন
‘দোয়েল–শাপলার ড্রয়িং–১’, শিল্পী: ঢালী আল মামুন

মূর্ত আর বিমূর্তের মাঝখানে শিল্পী যে লড়াই করেন, তাতে সবশেষে উপলব্ধিরই জয় হয়। ঢালী আল মামুন মূর্ত আর বিমূর্তের মাঝামাঝি দৃশ্যভাষা সৃষ্টি করেন। তাঁর এবারের প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ড্রয়িং অ্যান্ড থিংকিং, থিংকিং অ্যান্ড ড্রয়িং-১’ অর্থাৎ রেখাচিত্র ও চিন্তা, চিন্তা এবং রেখাচিত্র-১। প্রদর্শনীর ২৭টি কাজে ড্রয়িংকে ভাবা হয়েছে প্রধান করে। এখানে শুধু অনুশীলনের জন্য রেখার ব্যবহার না করে স্বতন্ত্র বা নিজস্ব এক চিত্রভাষা তৈরি করেছেন ঢালী। কাজগুলো নিয়ে শিল্পীর ভাষ্য, ‘ড্রয়িংকে নিরেট অনুশীলনের জন্য বা দৃশ্যভাষার সহযোগী হিসেবে বিবেচনায় নিইনি, বরং ভেবেছি স্বতন্ত্র স্বয়ম্ভু প্রকাশমাধ্যম। যা ভাবনা, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার একধরনের মানচিত্রীকরণ।’

শিল্পকর্মে সাধারণত অনুভূতি ব্যক্ত করেন না ঢালী। কিন্তু বিষয়ে তুলে আনেন চলতি সমাজ, সাংস্কৃতিক সূত্র, ঐতিহাসিক পটভূমি, বাংলা, বাঙালির উৎসমূলে কী রীতি বা প্রথার প্রচলন ছিল—এসব।

এবারের প্রদর্শনী তিনটি নতুন ধরন দর্শকদের অভিজ্ঞতায় যুক্ত হয়ে থাকবে। প্রথমত, প্রদর্শিত কাজগুলোর শিরোনাম ঢালী আল মামুনের ইতিপূর্বে প্রদর্শিত কোনো কোনো কাজে হয়তো নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, তবে সেখানে বিষয়কে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়নি, শুধু সূত্রটুকু বলে দেওয়া হয়েছিল। ‘শিল্পী কখনো সুনির্দিষ্ট অর্থ বা বক্তব্য দর্শকের ওপর আরোপ করতে চান না।’ কথাটি বেশ স্পষ্ট করেই বলেন ঢালী।

একজন দর্শক শিল্পকর্মের সঙ্গে নিজের মতো করে যোগাযোগ তৈরি করেন। কবিতায় শব্দ দিয়ে যেমন শিল্প তৈরি করা হয়, দৃশ্যশিল্পীরাও তেমনি কতগুলো কাজ দিয়ে তৈরি করেন একটি সুনির্দিষ্ট ভাষা। আর দর্শক সেখানে শিল্পকর্মকে নিজের মতো উপলব্ধির মাধ্যমে একটি সূত্র বা বিষয় নির্ণয় করে গ্রহণ করেন।

প্রদর্শনীর দ্বিতীয় ধরনটি হলো, মাধ্যম হিসেবে চায়ের পাতার সরাসরি ব্যবহার বা পাতা থেকে আহরিত রং ব্যবহার করে রেখাপ্রধান কাজ করা। চায়ের পাতার সঙ্গে যোগ হয়েছে লবঙ্গ ও নীল।

এই তিনটি মাধ্যম কেবল শিল্প সৃষ্টির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা নয়; বরং মাধ্যমগুলোর ঐতিহাসিক ভিত্তিও আছে। শিল্পীর মতটি এখানে এমন: ‘চা, নীল, লবঙ্গ কেবল বিষয়-ভাবনার দৃশ্যরূপ বা অবয়ব বিবৃত করার মাধ্যম ছিল না, তারা একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক সূত্র, ইতিহাসের বয়ান এবং অর্থকারক হিসেবেও বিবেচিত।’

শিল্পভাষায় ইতিহাসের সূত্র খোঁজেন ঢালী। শিল্পকর্মের বিষয়ে দর্শকদের নিশ্চিত তথ্য দিয়ে যান তিনি। ২০১৪ সালে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের আয়োজনে একক প্রদর্শনীতে আমরা তাঁর সেই ইতিহাস, অতীত, বর্তমান ও আত্মোপলব্ধির প্রকাশ দেখতে পেয়েছিলাম।

এবার বলা যাক প্রদর্শনীর তৃতীয় ধরন প্রসঙ্গে: শিল্পকর্মে রোমান্টিকতাপূর্ণ শিল্প সৃষ্টি করেন না ঢালী, তিনি কাজ করেন সময়ের উত্তাল বিষয়গুলো নিয়ে, যেখানে উঠে আসে একটি নির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিকতা। ঠিক যেমনটি হয়ে থাকে কবিতায়, গল্পে। এটি যে শিল্পীর দায় থেকে হচ্ছে, সুনির্দিষ্টভাবে তা-ও বলা যাবে না। তবে একটি ছবিতে যখন একটি পাখির মুখের সামনে শাপলা ফুলের আকৃতি তীক্ষ্ণ হয়ে পাখির মুখোমুখি হয়ে থাকে, তখন বোঝা যায় এর প্রাসঙ্গিকতা আছে। সময়ের এই টানাপোড়েন, মানুষে, প্রাণীতে, প্রতিবেশে সংকট মোচনের তাগিদ থেকেই সম্ভবত নতুনভাবে মোড় নিয়েছে ঢালীর শিল্পভাষা।

দর্শকদের কাছে ঢালীর কাজের চিন্তার সূত্র অনুসন্ধান, মাধ্যমের নতুনত্ব, রেখা ও ছবির জমিন নির্মাণের রীতি একেবারে নতুন মনে হতে পারে। এখানেই ঢালী আল মামুনের শিল্পভাষা যোগাযোগ তৈরি করতে পেরেছে মনে হয়।

রাজধানীর কলাকেন্দ্রে চলমান এই প্রদর্শনী শেষ হবে ৩১ মার্চ।