কমলার অজানা কান্না

শিল্পী: হাশেম খান
শিল্পী: হাশেম খান

‘১৯৭১ শব্দটাই কেমন যেন ভয় আর আতঙ্কে মোড়া। একাত্তর শব্দটা মনে হলে মনের ভেতরে কী যেন একটা অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে। আর বুকের ভেতরটা ওঠানামা করতে থাকে জোরে জোরে। কি জানি কী হবে। এখনো মাঝেমধ্যে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার করে উঠি, সারা শরীর অবশ হয়ে থাকে, হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারি না। স্বাভাবিক হতে সময় লাগে অনেকক্ষণ। স্বাভাবিক হওয়ার পর বুঝি, আমি স্বপ্ন দেখেছি। তখন গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলেও মনে হয়, পিপাসা মিটছে না, আমার পিপাসা মিটছে না।’

একনিশ্বাসে কথাগুলো বলেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের কমলা বেগম। একাত্তরের বীরাঙ্গনা নারী তিনি। আমরা আজ শুনতে এসেছি তাঁর জীবনের সেই অজানা কাহিনি। কথা বলতে গিয়ে এত বছর পরও কেঁপে কেঁপে উঠছেন কমলা।

একাত্তরে কমলার বয়স ছিল ২০ কি ২৫ বছর। তাঁর বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর, সে সময় বিয়ে হয়ে যায় কমলার। ছোট থেকেই তিনি যেমন সুন্দরী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আদরের। তাই তাঁর বিয়ে হয় অনেক ধুমধাম করে। বিয়ের কয়েক বছর পর যান শ্বশুরবাড়িতে। বিয়ের ১০-১২ বছর পর হলেন অন্তঃসত্ত্বা। চোখে কত স্বপ্ন, এবার মা হবেন।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় কমলা ছিলেন ছয়-সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। যুদ্ধ শুরুæহওয়ার এক-দেড় মাস পরই তিনি ধরা পড়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে।

একাত্তরের এক সন্ধ্যায় রান্না করছিলেন কমলা। এ সময় তাঁর কানে এল, মিলিটারি এসেছে গ্রামে, মিলিটারি এসেছে—এমন আতঙ্কিত রব। তখন সবার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালালেন তিনিও। তবে কিছু দূর যাওয়ার পর কমলার দেখা হলো তাঁর দেবর এবং আরও দুই-তিনজনের সঙ্গে। দেবর সে মুহূর্তে তাঁকে এই বলে বাড়িতে নিয়ে এলেন যে তোমার এই শরীর নিয়ে সব সময় এত দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। আমি যতক্ষণ বাড়িতে থাকব, ততক্ষণ তুমি একদম নিরাপদে থাকবে। দেবরের কথা শুনে তাঁর সঙ্গে বাড়ি ফিরলেন কমলা। তাঁদের গ্রামের বাড়িটি তখন ফাঁকা, সবাই পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে নিরাপদ স্থানে। ফলে কেউ আর নেই বাড়িতে। কিন্তু কমলার বিধি বাম, ওই খালি বাড়িতে প্রথম দেবরই ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর ওপর। কমলা বাঁচতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না।

সেদিন হাজার কান্নাকাটি ও চিৎকার করেও দেবরের হাত থেকে নিস্তার পাননি কমলা। উপরন্তু তাঁকে ভয় দেখানো হয় বাড়িতে কেউ যেন এই ঘটনা না জানে, এ কথা বলে। তবে কমলা ঘটনাটি প্রকাশ করে দিয়েছিলেন স্বামী আর শাশুড়ির কাছে। তারপরই খেপে গেলেন তাঁর দেবর। এর কয়েক দিন পর একদল মিলিটারি নিয়ে এলেন বাড়িতে। কমলাকে বললেন সবার জন্য খাবার তৈরি করতে। ভয়ে ভয়ে তাঁদের রান্না করে খাওয়ালেন কমলা। তাঁর শাশুড়ি ছেলেকে বললেন, ‘বাড়িতে কেন আমাদের দুশমনগুলোকে নিয়ে এলে, ঘরে জোয়ান বউ আছে। মিলিটারিদের তো নজর ভালো না।’ তখন দেবর বললেন, ‘আমাদের বাড়িতে কোনো দুশমনি করবে না এরা।’ এভাবে নানা কথায় মাকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বললেন, ‘তুমি ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ওরা খেয়ে চলে যাবে।’ সন্তানের কথা বিশ্বাস করে ঘুমিয়ে পড়েন মা। রাত যখন অনেক গভীর, তখন চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। মা ছুটে যান তাঁর ছোট ছেলের ঘরের দিকে। না, মায়ের অনেক কান্নাকাটিতেও কোনো ফল হয়নি। সে রাতে অনেকজন মিলে নির্যাতন করে কমলাকে। শুধু তা-ই নয়, শেষ রাতের দিকে তারা তুলে নিয়ে যায় তাঁকে। কমলার স্বামী এ সময় কাজের জন্য ছিলেন অন্য জায়গায়।

পাকিস্তানি সৈন্যরা কমলাকে ধরে প্রথমে কাছের একটা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওই ক্যাম্পে কিছুদিন রাখার পর নিয়ে যায় আরেক ক্যাম্পে। এভাবে মোট তিন ক্যাম্পে কমলা ছিলেন প্রায় পাঁচ মাস। প্রথম দিন রাতভর তাঁকে নির্যাতন করা হয় দফায় দফায়। একাত্তরের এত বছর পর নির্যাতনের সেই দুঃসহ ভাষ্য শোনালেন ঠাকুরগাঁওয়ের বীর নারী কমলা:

‘একটু পরপর আমি বেহুঁশ হই। আবার হুঁশ ফিরে আসে। বেহুঁশ হই আবার হুঁশ আসে। দ্বিতীয় দিন আমার অবস্থা বেশি খারাপ হয়। তৃতীয় দিন আমার অবস্থা আরও বেশি খারাপ। এদিকে প্রথম দিন থেকেই পেটে ব্যথা করছে। তৃতীয় দিন যখন মিলিটারিরা আমাকে নির্যাতন করছে, এ অবস্থায় আমার বাচ্চাটা জন্ম নেয়। বাচ্চাটা মনে হয় একদিন আগেই মরে গিয়েছিল। পেটে ভেতরে ওর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এক দিন আগেই। একদিকে প্রসবের জ্বালা-যন্ত্রণা, অন্যদিকে মিলিটারিদের নির্যাতন। আহা রে! আমি কত যে তাদের হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করেছি, বলেছি, হয় আমাকে মেরে ফেল, না হয় ছেড়ে দাও। আর সহ্য করতে পারছি না। আমি যত বেশি তাদের অনুরোধ করছি, তারা তত বেশি কষ্ট দিয়ে নির্যাতন করছে আমাকে। আর যত বেশি কষ্ট পেয়েছি, চিৎকার করেছি, তত বেশি উল্লাস করছে তারা। তো, তৃতীয় দিন শেষ রাতের দিকে আমার বাচ্চাটা হলো। বাচ্চাটা যখন মাটিতে পড়েছে, তখনো আমার ফুলটা পড়েনি। এ অবস্থায়ও মাফ নেই, আবারও চলল নির্যাতন। একসময় বেহুঁশ হয়ে পড়লাম।

যখন হুঁশ এল, দেখি, চারদিকে আলো। বুঝতে পারলাম, সকাল হয়ে গিয়েছে। আমি পড়ে আছি। সারা শরীর রক্তে ভিজে চপচপে হয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করলাম উঠে বসার জন্য, কিন্তু পারিনি। ওভাবেই পড়ে ছিলাম নিঃসাড় হয়ে।

কিছুক্ষণ পর দুই-তিনজন মিলিটারি এসে চুল ধরে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গেল অন্য আরেক ঘরে। যে ঘরে প্রতিদিন রাখত, এটা সেই ঘর নয়। আমার শরীর থেকে তখন অনর্গল রক্ত বেরোচ্ছে। গরু জবাই করলে যেমন গলগল করে রক্ত বের হয়, তেমন। এর কিছুক্ষণ পর ওই ঘরে এল একজন মহিলা। সে ছিল আমার মতোই বন্দী। আমার অবস্থা দেখে সে নিজেই যেন ভয় পেয়ে গেল। টানতে টানতে আমাকে যখন নিয়ে আসা হলো আরেকটি ঘরে, সঙ্গে আমার বাচ্চাটাও ছিল। ওই মহিলা আমাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি পাঞ্জাবি পরিয়ে দিল।

না, পরিষ্কার করা ছাড়া আমাকে আর কোনো সাহায্যই সে করতে পারেনি। শুধু আস্তে আস্তে সান্ত্বনা দিয়েছিল। কারণ, বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মিলিটারি। আর ভেতরে মহিলাটি পরিষ্কার করছিল। তবে রক্ত পড়া সে বন্ধ করতে পারেনি।

এমনভাবে ঘোরের মধ্যে পড়ে ছিলাম দুই-তিন দিন। এ ঘরে কেউ আসে না। এই সময় খাবার তো দূরের কথা, এক গ্লাস পানিও দেওয়া হয়নি আমাকে। তিন দিন পর দেখলাম, বারান্দা দিয়ে একজন মিলিটারি যাচ্ছে। আমার কষ্টের শব্দ শুনে ঘরে এল সে। আমাকে ওষুধপত্র দিল। ওই ওষুধ খেয়ে আমি সুস্থ হলাম বটে কিন্তু নিস্তার পেলাম না।

এর দুই-তিন দিন পর হঠাৎ একদিন বিকেলে আমার দেবর এসে হাজির। আমাকে উদ্দেশ করে টিটকারির সুরে কথা বলল। বলল, “আমার কথা না শুনলে কী হয়, দেখেছ? আমার কথা যে শোনেনি, তারই এমন অবস্থা হয়েছে। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে যাদের জানা নেই, তাদের অবস্থা এমনই হবে।” এসব কথা বলছে আর আমি চুপ করে আছি। কেন আমি চুপ, সেটাও আমার “অপরাধ”। চুপ থাকার কারণে আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করল সে। মারতে মারতে যখন কাহিল হয়ে পড়ল, চলে গেল অন্য ঘরে।

সন্ধ্যার পর আবার আমাকে নেওয়া হলো আরেকটি ঘরে। সেখানে দেখি বসে আছে আমার দেবরও। তারপর থেকে প্রায় রাতেই আসত সে। মিলিটারিদের সঙ্গে মদ খেয়ে এবং তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্যাতন করত আমাকে। একাত্তরে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধুই আঘাতের ক্ষত ছিল। হাত-পায়ে ছিল ধারালো ছুরির আঘাত। পেটে, বুকে, ঊরুতে ছিল কামড়ের দাগ। সেই সব আঘাতের ক্ষত কখনো শুকানোর সুযোগ পেত না। শুকানোর আগেই আবার করা হতো আঘাত, নির্যাতন। একসময় সারা শরীরে পচন ধরল, পুঁজ বের হলো। সারা শরীর ফুলে একাকার। শরীরে কাপড় লাগলেই ব্যথায় অস্থির হয়ে যেতাম। তারপরও এক রাত রেহাই পাইনি। এরপর আস্তে আস্তে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি। ভাবতে শুরু করি, এবার আমার মৃত্যু নিশ্চিত। তখন থেকে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। একসময় নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। যাঁরা বন্দী থাকেন, তাঁদের তো সব পথই বন্ধ। শরীরভরা কষ্ট। তার ওপর আবার ঠিকমতো খাবার দেয় না। ক্যাম্পে তাদের মর্জির ওপরই সবকিছু হতো। এই কয়েক মাসে এক দিন মাত্র গোসল করতে পেরেছিলাম।’

একাত্তরের বীর নারী কমলা তাঁর বন্দিজীবনের, নির্যাতিত জীবনের স্মৃতি বলে চলেন, বলতে বলতে কাঁদেন। আর আমরা ভাবি, স্বাধীন বাংলাদেশ কি কমলাদের কান্না শুনতে পায়? তাঁদের যোগ্য মর্যাদা কি তাঁরা পেয়েছেন?