অসুখের পটভূমি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নিনা ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে জানালার কাছে এল। এই রুম সোজা নিচে বাইরে দোতলাসমান উঁচু চওড়া সিঁড়িতে দেখল, সেখানে তার ছোট বোন নাজনিন এসেছে কি না। তারপর তাকাল সামনের হাসপাতাল চত্বরে।

এখান থেকে পুরো হাসপাতাল চত্বর দেখা যায়। সামনের উঁচু দোতলা বিশাল বিল্ডিংটার পেছনের দিকে এক পাশে আবাসিক এলাকা, অন্যদিকে মেডিকেল কলেজ। সামনে ও পাশে দুদিকেই সোজা রাস্তা, মাঝখানে অনেক ধরনের গাছ, সীমানায় যমুনা নদী। নিনা শুনেছে, নদীর চরে বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে এই হাসপাতাল। জানালায় দাঁড়ালে চোখে ধরা পড়ে যমুনার পটভূমিতে গোছানো অবকাঠামো। নিচে হাসপাতালের সামনে থেকে এসব বোঝা যায় না। গত দুদিনে কয়েকবার এখানে দাঁড়ালেও এভাবে খেয়াল করেনি সে।

ও সময়ে নিনার আট বছরের ছেলে রুবাইয়াৎকে নিয়ে নিচে নেমে গেছে নাজনিন। নিনা ওদের নিচের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখেছে। ওরা সামনের বিল্ডিংয়ের ওপিডি গেটের ছাউনিতে ঢুকে গেলে নিনা রুমের ভেতরে চলে এসেছে। দোয়া পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিয়েছে। তারপর বিছানায় বসেছে, বাবাকে ভেবেছে কি ওড়নায় চাবি বেঁধে রান্না করতে মাঝখানে ফাঁকা চৌকো এই গেস্ট হাউসের বিপরীত কোনায় রান্নার রুমের দিকে গেছে।

এখন সে তাড়া নেই। দুপুরের রান্না ও খাওয়া শেষ। একটু আগে হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ারে নাজনিন রুবাইয়াৎকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। নিনা তখন বারান্দায় গেছে। রুবাইয়াৎ মুখ মুছে গামছাটা বিছানায় রেখে গিয়েছিল। সেটা হাতে নিয়ে বারান্দায় শুকাতে দিতে দিতে পাশের রুমের দরজায় তাকিয়েছে।

ওই রুমের ভদ্রলোকের মুখে ক্যানসার। আজই এসেছে। সঙ্গে তার বউ আর জোয়ান ছেলে। সকালে বারান্দায় দাঁড়ালে দেখেছে, যখন ছেলেটা বাপকে নিয়ে নিচে যাচ্ছে, বউটা তখন দরজা থেকে একটু সামনে এসেছে, বিড়বিড় করেছে। কী বলেছে নিনা বোঝেনি। বউটার মুখ মলিন। সিঁথি লেপটানো। মাথা ও মুখে পানি দেওয়ার পরে আর সিঁদুর ছোঁয়নি সেখানে।

লোকটা একবার কষ্ট করে হেসেছে। লম্বা চিকন গড়ন। মুখটাও লম্বাটে। বাঁ দিকে মাঝখানে একটু গর্তমতো। ভেতরের দিকে ঢুকে আছে। মুখের ডান পাশের চামড়া মসৃণ, কিন্তু বাঁয়ে তাকালেই চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়। বাইরে ক্ষত নেই, তবু। ছেলেটা তার মায়ের দিকে এবার তাকিয়েছে। চুল বেশ বড় আর থুতনিতে ছোট করে রাখা দাড়ি।

নিনার দিকে একবার তাকিয়েছিল লোকটা। চোখ বলছে, জানতে চাইছে আপনাদের রোগীর অবস্থা কী? কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। পা টেনে হেঁটে গেছে। ছেলেটা বাপের পেছনে পেছনে।

এখন নিজের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মহিলা নিনার কাছে জানতে চেয়েছে, ‘ও আপা, আপনার আব্বার অবস্থা কী?’

নিনা বারান্দার বাইরের দিকে দাঁড়িয়েছিল। গামছাটা তখন সবে শুকোতে দিয়েছে। পরিচয় না-হওয়া পাশের রুমের মহিলার কথায় নিনা তার মুখের দিকে তাকায়। নিশ্চয়ই তাদের কথা নাজনিন বলেছে। তাই আর জানতে চাইল না, আপনাকে কে আমার আব্বার কথা বলেছে। মহিলার কথায় চট্টগ্রামের টান স্পষ্ট।

নিনা বলেছে, ‘আগের মতন। ভালোর কোনো লক্ষণ নেই। একটু আগে আমার বুন গেছে।’

‘আপনি গেলেন না?’

‘না। আমি কাইল একটু গেছিলাম। আইসিইউতে তো একজনের বেশি ঢুকতে দেয় না। বাইরে বসাইয়ে রাখে। একজন যায় আর একজন আসে। তা–ও ডাক্তার থাকলে তখন কেউরেই ঢুকতে দেয় না।’ এসব বলেছে। শুধু বলেনি, হাঁপরের মতো উঠছে-নামছে তার বাবার বুক, ও দাঁড়িয়ে দেখা যায় না। তাই সে যায়নি।

যদিও সে ভেবেছে, যাক, এই মহিলা কী হয়েছে তার আব্বার, কত দিন ধরে এই রোগ—এসব জানতে চায়নি। এখানে নতুন কারও সঙ্গে আলাপ হলে ওই এক কথাই বারবার বলতে হয়। অথচ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিনা তার সামনের মহিলার কাছে সে কথাই জানতে চেয়েছে, ‘কী হয়েছে ওনার?’

মহিলা চোখ বড় করে, ‘ক্যানসার!’ বলে ওড়না টেনে মুখ মুছেছে, ‘দাঁতের মাড়িতে—’

নিনা একটু যেন বিস্মিত। সে ব্লাড ক্যানসারের কথা জানে, ব্রেস্ট ক্যানসারের কথা জানে ও শোনে, এমনকি ব্রেইনে ক্যানসার হয় তা–ও তার জানা আছে, কিন্তু দাঁতে বা মাড়িতে ক্যানসার হয় তা তার জানা ছিল না। শুনে সে যেন একটু আঁতকে উঠছে, ‘মুখের মধ্যেও ক্যানসার হয়?’

‘ওই তো রে ভাই, আমিও তো কোনোদিন শুনিনি। ওনার তো হলো!’

‘পান-তামাক খাইত?’

‘না। বিয়ের পর কোনো দিন সিগারেটও খাইতে দেখিনি। শুনিছি বিয়ের আগে সেই ছাত্র বয়েসে নাকি টানত। বিয়েও তো এই তিরিশ বছর।’

‘ওই বড় ছেলে?’

‘হুঁ।’

‘এখন কোথায় গেল?’

‘ক্যানসার সেন্টারে—’

নিনা তখন রুমের দরজার কাছে দাঁড়ানো। ওই মহিলাও তাদের রুমের দরজার কাছে। দরজা ঠেলে ঢুকবে নিনা। রোগের কথা শুনতে তার ভালো লাগে না। যদিও ভাগ্য এমন সেই তাকেই আসতে হয়েছে। জানেন না ভাগ্যে কী আছে। খুব নিচু গলায়, ‘দোয়া কইরেন দিদি আমার আব্বার জন্য’ বলে নিনা দরজায় হাত রাখে।

মহিলা আবার ওড়নায় মুখ মোছে। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চোখ কাতর। সেখানে জলও জমেছে। বোঝা যায়, স্বামীর চিকিৎসায় প্রায় বিধ্বস্ত। নিনা দোয়া করার কথা বললে যেন ভেতরের কথা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, ‘হুঁ। আর কী আছে কন। দোয়া করা ছাড়া। প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরও ভগমানের কাছে হাত তুলে কই শত্তুরের যেন এই রোগ না হয়—’

দুই.

শত্রুরও হাসপাতাল মাড়াতে হোক কি না হোক, তারও যেন নিনা আর নাজনিনের দশা না হয়।

নিচের চওড়া সিঁড়ি থেকে আবার দিগন্তে চোখ দিয়ে নিনা ভাবল, ঠিকই বলেছে পাশের রুমের দিদি। জিজ্ঞেস করেনি, তবু কথায় বুঝেছে চট্টগ্রামের লোক এরা। অত দূর থেকে এখানে এসেছে। কত খরচ। মুখ দেখলে বোঝা যায় কষ্টে আছে। ছেলেটা মনে হয় এখনো চাকরিবাকরি পায়নি। না পাক, তার ভাইটার মতো তো না। বাপের সঙ্গে এসেছে।

নিনা এরপর আর ভাবনা এগিয়ে নিতে পারে না। তার চোখ ভিজে আসছে। বিকেল হতে হতে একপশলা বৃষ্টি হওয়ায় গরম বেশ গা-সওয়া। চারদিক চকচক করছে। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ। হাসপাতালের সামনের দিকে বিশাল শিরীষগুলোয় পাতাগুলো খুব সবুজ। সেখানে এখনো হালকা রোদ। কিন্তু নদীর দিকে আকাশ ঝুপ করে নেমে গেছে। দিগন্তে তাকালেও মনে হয় যতদূর চোখ যায় সে স্পষ্ট দেখতে পারছে না। নাকি চোখ ভেজা তাই। নাকি ছোট ভাই নেহালের কথা ভাবতেই তার এই অবস্থা!

নিনা আবারও চোখ মুছল। তাকাল ওপিডির দিকে। সেখান থেকে নিচের সিঁড়িতে। না, এত তাড়াতাড়ি নাজনিনের আসার কথা না। ওপিডি থেকে ঢুকে আইসিইউ পর্যন্ত কতটা পথ। হাঁটো আর হাঁটো। তারপর বাঁয়ে যাও। বসে থাকো। আইসিইউর গেটে বলো। দারোয়ান ফোন করার পরে ভেতর থেকে ডাক্তাররা কী সব বলবে। তারপর সময় হলে দারোয়ান ডাকবে তার বাবার নাম ধরে। যেতে দেবে। নাজনিন যাবে, রুবাইয়াৎ বসে থাকবে। আইসিইউ থেকে বেরিয়ে ওরা আসবে ওপিডির কাইন্টারে। বিল নিয়ে কথা বলবে।

নাজনিন তাকে বলেছে, আইসিইউতে অনেক বিল ওঠে। নতুন ওষুধ লাগলে আরও বিল বাড়ে। স্পেশালিস্ট ডাক্তার এলে বাড়ে। আইসিইউ থেকে যখন-তখন ডেকে পাঠায়। নিনা ভাবল। এসব তাদের কাজ? নেহাল পারত না আসতে? আসেনি। কেন আসেনি নিনা জানে। যদি নেহালের ড্রাগ নেওয়া কমাতে তারা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। তা ছাড়া ও এসে করত কী? কোনো কথা ঠিকঠাক শোনো? শুনে-বুঝে কোনো কাজ করতে পারে?

গত তরশু ঘুমের ভেতরে নিনার বাবা স্ট্রোক করে। নেহাল তখন ঘুমায় আর ঘুমায়। নিনার আম্মা তাকে তুলে বেলকুচি থেকে ডাক্তারকে আনতে বললে, এক বন্ধুকে নিয়ে মোটরসাইকেলে বেরিয়ে যায়। তাকে বা নাজনিনকে নেহাল একটা ফোনও করেনি। নাজনিন সেদিন ছিল টাঙ্গাইলে নিনার বাসায়। ওর বর গেছে ইন্ডিয়ায় ব্যবসার কাজে। আম্মা নাজনিনকে ফোনে জানালে, সে বেলকুচি থেকে ডাক্তার নিয়ে আসে। নেহাল বাড়ি ফেরে সন্ধ্যার পরে। কথা জড়ানো। বলে, সে ডাক্তারকে বলে গেছিল তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য।

এমন ভাইয়ের ওপর ভরসা করা যায়? হয়তো এই একটু আগে পাশের রুমের লোকটার সঙ্গে প্রায় নেহালের সমবয়সী তার ছেলেকে দেখে নিনা এসব ভাবছে। যদি সুস্থ থাকত নেহাল। যদি সুস্থ না থাকে তাহলে তাদের আম্মার হবে কী? আম্মা তো আরও অসুস্থ। বছরখানেক প্রায় বিছানপড়তা। চশমা ছাড়া চোখে প্রায় দেখেই না। ওষুধের ওপর থাকে। এখন নেহালের বদলে নিনার তার আম্মার মুখ মনে পড়ছে।

সেই সন্ধ্যায় নিনা রুবাইয়াৎকে নিয়ে চলে আসে। ইতিমধ্যে স্বজনেরা জেনে যাওয়ায় এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে নিনার আব্বাকে। জেলার সদর হাসপাতাল অথবা মনসুর আলী মেডিকেল কলেজেও নেওয়া যেত। নিনার স্বামী শহিদের এক পরিচিত ডাক্তার এখানে আছে, সে জন্য এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাড়িরও কাছে। যে কেউ আসতে পারবে। কিন্তু এখন এলেই বা কী? আইসিইউতে তো ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া ঢুকতে দেয় না। আর সবারই হাতে কাজ। এই যেমন শহিদের আজ ঢাকায় মিটিং। সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে টাঙ্গাইল। সকালে অফিসে রিপোর্ট করে তারপর যদি পারে কাল দুপুরের পরে আসবে। আসতে পারবে বলে মনে হয় না, নিনা জানে। এখন আত্মীয়স্বজন বা টাকাপয়সার ব্যাপার নয়, আব্বা ফিরলে হয়। আব্বা না ফিরলে—এই পর্যন্ত নিনা ভাবল। সে শুনেছে আইসিইউ থেকে কেউ ফেরে না। যদিও বা ফেরে, আব্বার যা হয়েছে তাতে হাতে-পায়ে প্যারালাইসিস হয়ে যাবে। তেমনভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে না বাঁচা ভালো। কে টানবে? নাজনিনের এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি বলে যখন-তখন আসতে পারল। চাকরির চেষ্টা করছে। চাকরি হলে এভাবে আসার সুযোগ পাবে?

নিনা জানে না সে কেন এসব ভাবছে। ভাবছে তো তিন দিন ধরেই। যখনই সুযোগ পায় শহিদকে ফোন করে। জানতে চায়, তার পরিচিত ডাক্তার তাকে কী বলেছে। শহিদ কিছু বলে না। বলে বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু নিনার কেন যেন মনে হয় বাহাত্তার ঘণ্টা তো বলে বাহাত্তার দিন গেলেও আব্বার কোনো পরিবর্তন হবে না। হলেও সুস্থ মানুষটা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না তাদের সামনে। অমন সবল শক্ত আর লম্বা মানুষটা একটা লাঠিতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটবে তাদের সামনে? কে টানবে? ওদিকে সারা দিন টেনশন করবে নেহালকে নিয়ে। তাতে অসুস্থ মানুষটা আরও অসুস্থ হবে।

এ সময় নিনার ফোন আসে। তাতে যেন নিনা এখানে ফিরল। জানালা থেকে সে বিছানার দিকে তাকাল। ফোনটা বিছানার ওপরে। নাজনিনের ফোন? নাকি শহিদের? শহিদের সঙ্গে তো একটু আগে কথা হলো। নিনা ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাল। ছোট ফুপু ফোন করেছে। যাক আম্মার কথা জানা যাবে।

নিনা ‘হ্যালো—’ বলতেই ওপাশ থেকে নিনার ছোট ফুপু এখন তার বড়দার অবস্থা কেমন জানতে চাইল। নিনা বলল একই কথা সবাইকে যা বলেছে। সকালে ফুপুকেও তো বলেছে। সে জিজ্ঞেস করল তার আম্মার কথা। ফুপুকে বলল আম্মা যেন টেনশন না করে। ফুপু বলল, তার আম্মাই কথা বলার জন্য ফোন করতে বলেছে।

নিনার আম্মার জড়ানো গলা। সে নিনার কাছে তার স্বামীর অবস্থা জানতে না চেয়ে, ওই জড়ানো গলা আরও নিচু করে বলল, ‘নাজনিন কই?’

নিনা বলল, ‘আইসিইউতে—’

‘নাজনিন তোরে টাকাপয়সার কথা কিছু কইচে?’

নিন বলল, ‘না তো—এই তো গেল। ক্যান আম্মা?’

 ‘না। এমনি—’

‘এমনি না। কী হইচে?’

নিনা বুঝল, তার প্রায় বিছনাপড়তা মা কেমন যেন বিব্রত। ননদ সামনে। যে কথাটা বলতে চায়, বলতে পারছে না। নিনা জানে, হয়তো ছোট ফুপুর সামনে এ কথা বলতে চাইছে না। সে শুনলে আত্মীয়রা জানতে বাকি থাকবে না।

নিনা তাই বলল, ‘এখন কবা না? পরে কবা।’

‘পরে আর কী কব? মোবাইল পাব কোথায়?’

নিনা তার মায়ের অসহায় মুখ দেখল। নেহাল বাড়িতে নেই। তার আব্বার মোবাইলটায় হয়তো চার্জ নেই। থাকলেও আম্মা সেটা ধরতে পারে না। এখন ফুপুকে পেয়ে ফোন করেছে।

‘হুঁ। তাইলি এখন কও। নাজনিন কী বলচে?’

‘নাজনিন কিছু বলে নাই।’

‘তয়?’ নিনার মনে হয় আম্মা গুছিয়ে বলতে পারছে না। সে বলল, ‘আচ্ছা, নাজনিন আসুক, ও আইসিইউরতে শুনে ফোন করব—’

‘না, শোন। নেহাল আমারে দিয়ে একটা চেক সই করাইয়া নিয়ে গেছে একটু আগে—’

‘কী কও? কেন?’

‘তোর আব্বার জন্য যদি টাকাপয়সা লাগে?’

‘কত টাকা?’

‘পঞ্চাশ হাজার—’

নিনা চুপ করে থাকল। কী বলবে সে জানে না। সেও খুব অসহায় গলায় বলল, ‘আচ্ছা রাখো। নাজনিন আসুক। আমি শুনে দেখি।’ তারপরই, ‘আচ্ছা, ও আম্মা, ছোট ফুপু আছে কতক্ষণ? আমি তোমারে ফোন করব—’

তিন.

নিনা নাজনিনকে ফোন করল। আইসিইউতে ফোন করতে হয় না সে জানে, তবু করল। তা ছাড়া আধ ঘণ্টাও হয়নি, এই গেল। বেরিয়ে এলে এখান থেকে দেখা যেত। তারপরও যদি নাজনিন ফোন ধরে তো এখনই জানা যাবে। ফুপু তাদের বাড়িতে থাকতে থাকতে আম্মাকে ফোন করবে। নাজনিন ফোন কেটে দিল। নিনা নেহালকে ফোন করল। বন্ধ। জানত বন্ধই পাবে।

একটু আগের দিগন্তে তাকানো, হাসপাতাল চত্বর দেখা, নিচের অগুনতি মানুষজন, বিদেশি ছাত্রছাত্রীর ভেতরে দেশি মানুষ—সব তার কাছে মুহূর্তে কেমন যেন অপরিচিত হয়ে গেল। নিনা যেন জানে না সে এখানে কেন? সে বুঝতে পারছে না কী করা দরকার। হতে পারে, নাজনিন নেহালকে বলেছে। আজ কখন বলল নাজনিন? চেক তো নেহাল নিয়েছে অন্তত দুই ঘণ্টা আগে। তখন যদি আম্মা তাদের ফোন করতে পারত।

একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকেছে। ওপিডি গেট পেরিয়ে ইমার্জেন্সির দিকে। সাইরেন থামাল। একজনকে স্ট্রেচারে করে নামাচ্ছে। লোকটার মুখে হাত চাপা দেওয়া। নিচের সিঁড়িতে মানুষ বেড়েছে। ভিজিটিং আওয়ারের পরে এখানে অনেকে এসে বসে। কেউ কেউ এমনিতেই বসে থাকে রোদ পড়ে গেলে। নার্সরা বাঁয়ের রাস্তা দিয়ে হোস্টেলের দিকে যাচ্ছে।

সিঁড়িতে পাশের রুমের লোকটা বসে আছে। ছেলেটা তার সামনে দাঁড়ানো। ওপরে চোখ। তার মানে পাশের রুমের মহিলা এখন জানালায়। নেহাল যা করে...আব্বার যদি কিছু-একটা হয়...এভাবে আব্বারে বাড়ি নিলে নেহাল যে কী করবে...বেচেকিনে রাখবে না কিছু...যদি নাজনিন টাকার কথা না বলে থাকে তাহলে ওই টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনবে...আগেরটা বেচে দেবে...মাসখানেক আগে বলছিল...নিনা ভাবে। তাই হবে। এই সুযোগে...আম্মাকে বুঝিয়ে...তাই বলে এই সময়ে এভাবে? নিনা পাশের রুমের ছেলেটাকে দেখে আর নেহালের কথা ভেবে গ্রিলে মাথা চেপে ধেরে। নাজনিন আসছে না কেন?

তখন, ওপিডির গেট থেকে ওই জানালার দিকে তাকাতে তাকাতে নাজনিন বেরোয়। মুখ শুকনো, বাঁ হাতে রুবাইয়াতের ডান হাত ধরা।

নাজনিন ডান হাত তুলে নিনাকে ডাকে। নিচে নামতে বলছে। নাজনিনের ইশারায় নিনার বুকের ভেতরে নাড়া খায়। মনে হয় সেখানে পানি নেই, কম্পন নেই; গলাও শুকিয়ে গেছে।

চার.

চওড়া সিঁড়িতে ততক্ষণে বসে পড়েছে নাজনিন। রুবাইয়াৎ পাশের মার্কেটের দিকে যাচ্ছে। একবার ফিরে নিনাকে দেখল। নিনা নাজনিনের কাছে জানতে চাইল, ‘কী? আব্বার অবস্থা কী?’

নাজনিন চারপাশে তাকাল। তারপর শুকনো মুখ আরও শুকনো করে, ভেতর থেকে ডুকরে ওঠা কান্না সামলে বলল, ‘বাড়ি নিয়ে যেতে বলছে।’

‘আজই?’

‘না। আপাতত কয়দিন এখানে থাকবে। তারপর একটু সুস্থ হলে। এমনিতে আব্বা আর কোনো দিন সুস্থ হবে না।’

নিনা ওড়নায় মুখ চাপা দিল। তাকাল দিগন্তে। এখন নদী পর্যন্ত আর দৃষ্টি পৌঁছায় না। সে দীর্ঘশ্বাস চাপা দিল, তাই যেন বেরোল হাঁপ হয়ে। মনে হলো, মাত্র সাত দিন? আব্বা তার চেয়ে হাসপাতালেই থাকুক। বাড়ি গেলে আরও আগে মরবে।