রবীন্দ্রনাথের অন্য ভুবন

শিল্পীর চোখে পাটের ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ। দোকান আর গুদামঘর তৈরি করে কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন পাটের ব্যবসা। অলংকরণ: তুলি
শিল্পীর চোখে পাটের ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ। দোকান আর গুদামঘর তৈরি করে কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন পাটের ব্যবসা। অলংকরণ: তুলি

লেখক-চিত্রকর—এসব সৃজনশীল পরিচয়ের বাইরেও বিচিত্র কয়েকটি পরিচয় ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ছিল ভিন্ন এক ভুবন

সব রাঁধুনি চুলটা ঠিকঠাকমতো বাঁধতে জানেন না। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে পাকা রাঁধুনি ছিলেন। কী, এ কথা শুনে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল? হ্যাঁ, রাঁধুনিই তো ছিলেন। দক্ষ পাচকের মতো ঠিকঠাক মসলা দিয়ে এবং সঠিক তাপমাত্রা প্রয়োগ করে কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ—নিজের সৃজনশীল রচনাকে যিনি নিয়ে গেছেন মুখরোচক কিন্তু মানোত্তীর্ণ রসনার পর্যায়ে, তাঁকে রাঁধুনি না বলে উপায় আছে! শিল্প-সাহিত্যের সেই দক্ষ পাচক রবিঠাকুর কিন্তু নিজের চুলটি ঠিকঠাকমতো বাঁধতে পারেননি সব সময়। মানে নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্যে তাঁর ছিল দীর্ঘ অকৃতকার্যতার ইতিহাস।

শিল্প-সাহিত্যের সব বিভাগে তাঁর সদর্প বিচরণ ছিল—এ তো জানা কথা। আমাদের এই লেখাটা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-কৃতি নিয়ে নয়, তাঁর ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি পরিচয়কে এক সুতায় গেঁথে অন্যভাবে তাঁকে দেখতে পাওয়ার খায়েশই এর প্রধান উদ্দেশ্য। সেই বিবেচনায় চাষি রবীন্দ্রনাথ বা আখ-পাটের কারবারি কিংবা জমিদার রবিঠাকুর—কতভাবেই না দেওয়া যায় বিশ্বকবির বিচিত্র পরিচয়। নানা বইপত্রে রবীন্দ্রনাথের এই বিচিত্র জীবনের খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অন দ্য এজেস অব টাইমকেই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বলে ঠাওর হয়। কেননা, এই গ্রন্থে ছেলে তাঁর বাবার বৈচিত্র্যময় কর্মকাণ্ড যতটা সবিস্তারে তুলে ধরেছেন, অন্য বই-পুস্তকে ততটা নেই। তাই কবির ভিন্ন পরিচয় জানতে ওই বইয়ের দিকেই হাত বাড়াতে হলো।

পৈতৃক জমিদারির ভার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। কিছুদিনের মধ্যেই বেশ জাঁকিয়ে বসলেন তিনি। আর দশটা জমিদারের মতো তাঁকেও করতে হতো বিচার-সালিস। সেই সব সালিস-বিচারের বিস্তারিত রথীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন বাবাকে নিয়ে লেখা তাঁর এই বইয়ে। বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্রামের অশিক্ষিত চাষি প্রজারা প্রায়ই সামান্য স্বার্থের জন্য মারামারি-হানাহানি বাধিয়ে ফেলত। ফলে কোর্ট-কাচারি, উকিল-মোক্তার—ছিল নানা হুজ্জত! রবীন্দ্রনাথ এর সমাধান করলেন একটু অন্যভাবে। গঠন করলেন গ্রাম পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতপ্রধানেরা গ্রামের ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ এমনকি ফৌজদারি মামলার বিচার-সালিস করতেন। এতে ঘটল তেলেসমাতি কাণ্ড, গ্রাম পঞ্চায়েতেই মিটে যেত বেশির ভাগ বিবাদ। একান্তই বিবাদ না মিটলে পরগনার পাঁচ পঞ্চায়েতপ্রধান মিলে আবার করতেন বিচারটি। বাদী বা বিবাদী কোনো পক্ষ যদি সেই রায়ে সন্তুষ্ট না হতেন, তাঁদের জন্য খোলা ছিল আপিলের দুয়ার। তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে আপিল করতে পারতেন তাঁরা। তবে ব্রিটিশ ভারতের সরকার সব জায়গায় এ ধরনের ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট ছিল না। রবীন্দ্রনাথের এই পঞ্চায়েতি বিচারব্যবস্থা এতটাই সফল হয়েছিল যে ইংরেজ সরকার তাতে নাক গলাতে আসেনি কখনো।

জমিদার হিসেবে বিচারিক ব্যবস্থায় যত সফলই হোন না কেন, এটাও সত্য যে চাষি হিসেবে চূড়ান্ত আনাড়িপনার পরিচয় দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবশ্য চাষ তিনি জীবনে একবারই করেছিলেন, তা-ও সেটা নিজ হাতে নয়, করিয়েছিলেন লোকজন দিয়ে।

বিখ্যাত সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, যাঁকে আমরা ডি এল রায় নামেও চিনি, তখন ছিলেন কুষ্টিয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি আবার রবীন্দ্রনাথের বন্ধুও। প্রায়ই গড়াই নদী পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে তিনি হাজির হতেন দু-এক দিনের মেহমান হয়ে। রবীন্দ্রনাথ সে সময় শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বিশাল এক বাগান করেছেন। সেই বাগান দেখেই জেগে উঠল ডি এল রায়ের কৃষিবিদ সত্তা।

ডি এল রায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার আগে ব্রিটিশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিলেতে গিয়েছিলেন কৃষিবিদ হতে। ঠিকঠাকমতো সেই পড়াশোনা শেষ করে ফিরেও এলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তখনো ভারতে কৃষি-প্রশাসন গড়ে তুলতে পারেনি। তাই ডি এল রায়কে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথের বাগান দেখে তিনি তাঁকে বাগানের এক কোনায় গোল আলু চাষের পরামর্শ দেন। এ দেশে সে সময় গোল আলুর চাষ সেভাবে শুরু হয়নি। তবু শিলাইদহের কয়েকজন চাষি আলুর চাষ করতেন। তাঁদের মধ্য থেকে রবীন্দ্রনাথ এক চাষিকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কাছ থেকে আলুর বীজ নিয়ে সেগুলো বপন করলেন ডি এল রায়ের ফর্মুলা অনুযায়ী। তখন ওই চাষি বললেন, ‘করছেন কী মশাই! এভাবে আলু লাগলে তো মাঠে মারা যাবে চাষ!’ রবীন্দ্রনাথের তখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা—একদিকে অভিজ্ঞ চাষি, অন্যদিকে ডিগ্রিধারী কৃষিবিদ—কার কথা শুনবেন?

শেষমেশ ডি এল রায়ের পরামর্শমতোই লাগানো হলো আলু। এরপর দেখা গেল, রবীন্দ্রনাথ যে পরিমাণ আলুর বীজ বপন করেছিলেন, সেটাই ফিরে আসেনি। সুতরাং চিরতরে সমাধি ঘটল আলুচাষি রবীন্দ্রনাথের।

যে হাতে তিনি সার্থক কবিতা লিখেছেন, সেই হাতে ব্যবসাও করেছেন। তবে কাব্য রচনায় সফল হলেও ব্যবসায় তাঁর সার্থকতা ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। কুষ্টিয়ায় তখন আখ আর পাটের রমরমা ব্যবসা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দুই ভাইপো বলেন্দ্রনাথ আর সুরেন্দ্রনাথকে নিয়ে মন দিলেন ব্যবসায়। কুষ্টিয়ার রেলস্টেশনের পাশে তাঁদের বেশ জমিজমা ছিল। সেখানেই যাত্রা শুরু হলো ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানির। একটা দোকান আর গুদামঘর তৈরি করে শুরু হলো ব্যবসা। পাটের আড়তদারি আর মেশিন কিনে আখ মাড়াইয়ের ব্যবসা। লাভ খুব মন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেলে ঘটি-বাটি-চাটি যেতে কতক্ষণ। কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন বড্ড অসৎ। তাই কিছুদিনের মধ্যেই লাটে উঠল ব্যবসা। দেউলিয়া হয়ে গেল ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানি। রবীন্দ্রনাথ তখন লোকসানের ভার একা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। ফলে বেশ মোটা দাগের ঋণের ভার চাপল তাঁর ওপর। এর পরের ঘটনা? কবির ব্যবসা করার শখ চিরতরে মিটেছিল।

রবীন্দ্রনাথ দাদনও দিতেন গরিব চাষিদের। কিন্তু সুদ বাদ থাক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসল টাকাই ফেরত আসেনি। আদতে প্রজাদের অক্ষমতার ব্যাপারটি তিনি ভালোভাবেই অনুধাবন করতেন। রথীন্দ্রনাথের মতে, জোর-জুলুম দূরে থাক, গরিব প্রজাদের কাছে ঋণের টাকা চাইতেই বিবেকের দংশনে ভুগতেন রবীন্দ্রনাথ। পরে তাঁর ব্যক্তিগত তহবিলের দেদার টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছিল দাদন ব্যবসায়। অন দ্য এজেস অব টাইম বইয়ে রথীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, আসলে এই ঋণদানের বিষয়টাকে রবীন্দ্রনাথ কখনোই ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে দেখেননি; বরং তাঁর কবিসত্তাই ব্যাকুল হয়ে উঠত এতে। রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে পাওয়া এই শিলাইদহের গরিব প্রজাদের কাছ থেকেই। আর এ কথা স্বীকারে রবীন্দ্রনাথও কার্পণ্য করেননি যে শিলাইদহের গ্রাম-প্রকৃতি, হতদরিদ্র মানুষ এবং তাদের জীবনই তাঁর কবিসত্তায় বড় প্রভাব ফেলেছিল। সে কথা যে সত্যি, তার প্রমাণ মেলে তাঁর শিলাইদহ পূর্ব আর শিলাইদহ বাসের পরবর্তী জীবনের কবিতার পার্থক্য, ভাবগত পার্থক্য দেখলেই। সেই ঋণের প্রতিদান রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও। নোবেল থেকে পাওয়া অর্থের প্রায় পুরোটাই তিনি খরচ করেছিলেন গরিব প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে। তাই ব্যবসায়ী হিসেবে, চাষি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যত অসফলই হোন, তবু নিজের মানবিক সত্তার জয়ধ্বনিতে তিনি সফল বারবার।