নোবেল! নো-বেল!

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম
>একটি কেলেঙ্কারির জের ধরে সাহিত্যে নোবেল এ বছর কেউই পাচ্ছেন না। এতে চারদিকে বিস্তর শোরগোল। অনেকে বলছেন, নোবেলের ‘সতীত্ব’ এবার গেল!

‘পতির পূণ্যে সতীর পুণ্য’—লাইনটা কি কাতারিনা ফ্রসতেনসনের পড়া ছিল? লাইনটা যাঁর লেখা তিনি একজন কবি। হেঁজিপেঁজি গোছের কবি না। সাহিত্যে নোবেলজয়ী কবি। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অন্তর্জাল ঘেঁটে দেখলাম, কাতারিনাও কোনো আঁতিপাঁতি কবি নন। সুইডিশ ভাষার এই সময়ের সবচেয়ে চ্যাতা কবিদের একজন তিনি। তিনি নিজে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার না পেলেও জিনিসটা এত দিন অন্যদের দিয়ে এসেছেন। মানে, নোবেল সাহিত্য অ্যাকাডেমির যে ১৮ জন সদস্য এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পুরস্কারটি কাকে দেওয়া হবে বলে ফয়সালা দিতেন, কাতারিনা ছিলেন তাঁদের একজন।

‘পতির পুণ্য’বিষয়ক কালজয়ী লাইনটা হয়তো পড়া ছিল না কাতারিনার। পড়লেও তার মর্মার্থ ধরতে যাওয়ার সময় তার ছিল কি না কে জানে! কিন্তু হাড় বজ্জাত পতির পাপে সতীর যে কী গতি হয় তা তিনি ‘বোন টু বোন’, আই মিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। টের পেয়েছে নোবেল ফাউন্ডেশন। দুনিয়াজুড়ে ঢিঁ-ঢিঁ পড়ে গেছে। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গে ছ্যাঁ-ছ্যাঁ চলছে। নোবেল কমিটির পক্ষে ‘নালতের মিত্তির বলিয়া গ্রামে আর মুখ বাহির করিবার জো’টি রহিল না।’ কারণ কাতারিনার ‘পতি দেবতা’ জ্যঁ-ক্লদ আর্নো আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইট খোদ নোবেল একাডেমির চৌহদ্দিতে ফাটিয়ে দিয়েছেন। পূর্ণিমার চাঁদের মতো রাউন্ড ফিগারের পুত পবিত্র নোবেলের সোনার মেডেলে তিনি লেপ্টে দিয়েছেন নারীঘটিত কেলেঙ্কারির কালি! শান্তির মেডেলে পড়েছে অশান্তির জং! তাঁর কারণেই নোবেল কমিটিকে বলতে হয়েছে, ‘যাহ! এই বছর পুরস্কারই দেব না।’

এ বছর মেডেলটা কে পাচ্ছেন? ফিলিপ রথ নাকি আদুনিস? আমোস ওজ নাকি মিলান কুন্ডেরা?—প্যাঁচ লাগিয়ে এসব গুঞ্জন থামিয়ে দিয়েছেন ছবির মানুষ ক্লদ আর্নো।
যাঁরা ইতিমধ্যেই নিবিড়ভাবে খবরটা পড়েছেন তাঁরা তো জানেনই। আর যাঁরা জানেন না, তাঁদের কাছে ঘটনাটা একটু খোলাসা না করলে জিনিসটা ঠিক ‘কিলিয়ার’ হবে না। গোড়া থেকে বলি:
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে তা ঠিক করার জন্য অ্যাকাডেমির একটি জুরিবোর্ড আছে। সেই বোর্ডে সদস্য থাকেন ১৮ জন। পুরস্কারের ফয়সালা দেওয়ার জন্য কমপক্ষে ১২ জনকে ভোট দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া সাহিত্যিককে মেডেল পরিয়ে দেওয়া হয়। কমিটির সদস্যরা আজীবন পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। টেকনিক্যালি কেউ চাইলেও পদত্যাগ করতে পারেন না। তবে বোর্ডের কাজকারবার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেন। এটিকে একধরনের পদত্যাগই বলা যেতে পারে। কেউ মারা গেলে তাঁর জায়গায় নতুন কাউকে নিয়োগ করা হয়। গোড়ার দিকে জুরিদের সবাই পুরুষ ছিলেন। পরে ভারসাম্য আনার জন্য একেকজন পুরুষ জুরি মরেছেন; আর তার জায়গায় একেকজন নারীকে বসানো হয়েছে। সাত পুরুষ সদস্য মরার সুবাদে এই নিয়ে ১৮ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত নারী সদস্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাতজন। সবচেয়ে বড় কথা, ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো এই কমিটির সভাপতি হয়েছেন একজন নারী। তাঁর নাম সারা দানিউস। এই ফাঁকে বলে রাখি, এই সাত নারী সদস্যের মধ্যে চ্যাসটিন একমান নামের একজন সেই ১৯৮৯ সাল থেকে নিষ্ক্রিয়। সালমান রুশদির বিরুদ্ধে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ফতোয়া জারির পর সুইডিশ অ্যাকাডেমি এর নিন্দা না করায় প্রতিবাদ হিসেবে চ্যাসটিন সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তার মানে, চ্যাসটিনের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার পর কমিটিতে খাতা-কলমে ১৮ জন থাকলেও এত দিন সক্রিয় ছিলেন ১৭ জন। এই ১৭ জনের একজন কাতারিনা ফ্রস্তেনসন।

সুইডিশ নারী কাতারিনার ফরাসি স্বামী জ্যঁ-ক্লদ আর্নো একজন বিরাট এলেমদার লোক। পেশায় নামজাদা চিত্রগ্রাহক। স্বভাবে খানিকটা ইয়ে...খানিকটা ‘মৌ-লোভী’ ধরনের আরকি! তো স্বামী-স্ত্রী মিলে তাঁরা স্টকহোমে একটা কালচারাল ক্লাব চালাতেন। কাতারিনা যেহেতু নোবেল কমিটির সদস্য, সেই সুবাদে নোবেল ফাউন্ডেশন এই ক্লাবের খরচাপাতি জোগাত। এখানে নানা দরকারে অনেক নারী আসতেন। তাঁদের সঙ্গে ‘কাব্য সখ্য’ গড়ে তুলতেন ক্লদ আর্নো। ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ নামে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেই আন্দোলনে সক্রিয় ১৮ জন নারী আন্তর্জাতিক সালিসে নালিশ করে বলেছেন, কালচারাল ক্লাবে তাঁদের শ্লীলতাহানি করেছেন ক্লদ আর্নো। আর্নোর এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিরাট। ২০০৬ সালে সুইডিশ রাজকুমারী ভিক্টোরিয়ার ছবি তোলার সময় ভুল করে তাঁর গায়ে হাত বোলানো শুরু করেছিলেন তিনি। রাজকুমারীর দেহরক্ষীরা ছুটে এসে এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি ‘সরি-টরি’ বলে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন।
যা হোক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী—দুজনকেই এক দড়িতে বাঁধতে পেরেছেন আর্নো। সাহিত্যের মতো একটি ‘অনর্থকরী’ বিষয়কে কাজে লাগিয়ে তিনি যেভাবে লাখ লাখ ডলার কামাই করেছেন, তা মার্কেটিং বিভাগের গবেষণার বিষয় হতে পারে।

কাতারিনা ফ্রস্তেনসন ও তাঁর স্বামী জ্যঁ-ক্লদ আর্নো: শোনা যাচ্ছে তাঁরাই কেলেঙ্কারির মূল হোতা। ছবি: সংগৃহীত
কাতারিনা ফ্রস্তেনসন ও তাঁর স্বামী জ্যঁ-ক্লদ আর্নো: শোনা যাচ্ছে তাঁরাই কেলেঙ্কারির মূল হোতা। ছবি: সংগৃহীত

কেমন করে? বলছি শুনুন:
হাজার হাজার আবেদন থেকে নোবেল কমিটি প্রতিবছরের এপ্রিল নাগাদ ২০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে। মে মাসের মধ্যে সেই তালিকায় মনোনীত লেখকের সংখ্যা পাঁচজনে নামিয়ে আনা হয়। এই পাঁচজনের লেখা বিস্তারিতভাবে পরীক্ষার পর অক্টোবরে চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া চলার সময় জুয়াড়িরা কে এবার সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকবেন, কে চূড়ান্ত বিজয়ী হবেন, তা নিয়ে বাজি ধরতে থাকেন। এক-দুই ডলারের বাজি না। লাখ লাখ ডলারের বাজি। এই বাজিকরদের কাছে বিজয়ীদের নাম টুক করে পৌঁছে দিতেন ক্লদ আর্নো। বিনিময়ে তাঁরা আলগোছে তাঁর হাতে কমিশন ধরিয়ে দিতেন।

শোনা যাচ্ছে, এভাবে এ পর্যন্ত আর্নো সাতজন বিজয়ীর নাম আগে থেকেই জুয়াড়িদের কাছে তুলে দিয়ে ‘টু পাইস’ কামিয়েছেন। 

নোবেল ফাউন্ডেশনের পয়সায় যে কালচারাল ক্লাব চলে, সেখানেই আর্নো নারীদের সঙ্গে আজেবাজে ব্যবহার করেছেন শুনে খুব মন খারাপ করে ফাউন্ডেশন। তারা সেখানে পয়সা ঢালা বন্ধ করে দেয়। অভিযোগ ওঠে, কাতারিনা নোবেলজয়ীদের নাম আর্নোর কাছে পাচার করেছেন, আর আর্নো সেই নাম বেচে দেদার পয়সা কামিয়েছেন। এসব শুনে কাতারিনাকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেন কমিটির সভাপতি সারা দানিউস। দানিউসের এই ঘোষণায় ঘটনা আরও প্যাঁচ খায়। কমিটির সদস্যরা দুই ভাগ হয়ে যান। এক ভাগে কথা হলো, কিছু প্রমাণ হওয়ার আগেই কাতারিনাকে বাদ দিতে হবে কেন? দানিউস বললেন, ‘বাদ দিয়েছি বেশ করেছি।’ এবার তাঁরা বললেন, ‘বেশ! তাহলে মাতব্বরি নিয়ে আপনিই থাকুন, আমরা গেলাম!’ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনজন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। এরপর বিস্তর ঝগড়াঝাঁটির পর প্রথমে কাতারিনা তারপর দানিউস সরে দাঁড়ান। তারপর আরও তিনজন। সব মিলিয়ে পদত্যাগ করলেন আটজন। আর ১৯৮৯ সালে সরে দাঁড়িয়েছিলেন চ্যাসটিন একমান।

তাহলে হারাধনের কয়টি ছেলে রইল? সঠিক উত্তর: ১৮—৯ =৯টি ছেলে রইল। এই জনবল দিয়ে পুরস্কার ঘোষণার কোরাম পূরণ হয় না। ফলে অ্যাকাডেমি ঘোষণা করেছে এ বছর এসব ঝামেলার মধ্যে তাঁরা আর থাকবে না। কমিটিকে পাক সাফ করে, মানে আইন সংশোধন করে পদত্যাগী জুরিদের বাদ দিয়ে নতুন জুরি নেওয়া হবে। তাঁরা আগামী বছর একসঙ্গে দুই বছরের পুরস্কারজয়ীর নাম ঘোষণা করবে।
এতক্ষণে আমরা বুঝলাম, সমাজের যে মহল্লায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ বাস করে, তারই কোনো লেন বাইলেনে শেক্‌সপিয়ারের ‘ইয়াগো’ ঘাপটি মেরে আছে। আলোর নিচে আলেয়া। দশাননের ভাই বিভীষণ। টোটাল গল্পের ‘মোরাল অব দ্য স্টোরি’ দাঁড়াল: নোবেল পেতে শক্তিমান লেখক হওয়া লাগতে পারে, কিন্তু তা ভন্ডুল করতে আর্নোর মতো ঘাপটি মারা ‘শিল্পী’ হলেই চলে।