সংস্কৃতি সংগ্রামের নির্ভরযোগ্য দলিল

বাংলাদেশের সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই সন্‌জীদা খাতুন প্রচ্ছদ: সন্দীপন ভট্টাচার্য প্রকাশক: মনফকিরা, কলকাতা।  প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৮ ১৪৪ পৃষ্ঠা।
বাংলাদেশের সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই সন্‌জীদা খাতুন প্রচ্ছদ: সন্দীপন ভট্টাচার্য প্রকাশক: মনফকিরা, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৮ ১৪৪ পৃষ্ঠা।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির আন্দোলনের প্রাঞ্জল উপস্থাপনা দেখা গেল সন্‌জীদা খাতুনের লেখা বাংলাদেশের সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই বইটিতে। শীর্ণকায় এই বইটি ভাবনার দিক থেকে ঋদ্ধ। ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের চিন্তার ব্যবধান নিয়ে এগিয়েছে প্রথম প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধের নামেই বইটির নাম। ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির সঙ্গে কেন ‘বাংলাদেশের’ শব্দটি যুক্ত হলো, কেন ‘বাঙালি সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই’ হলো না বইটির নাম, কেন এ বইটি শুধু বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি নিয়ে নয়, তার পরিষ্কার ধারণা দিয়েই শুরু হয়েছে প্রবন্ধটি।
আরবি-ফারসি এবং সংস্কৃত শব্দের টানাপোড়েনে পড়ে গিয়েছিল বাংলা ভাষা। সে সময়টিকে ধরেছেন লেখক। ‘খুন’ শব্দটি নিয়ে রবীন্দ্র-নজরুল বিতর্কের প্রসঙ্গও এনেছেন। তেমনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা মক্তব-মাদ্রাসা শিক্ষা বইয়ে বাংলা শব্দের অর্থ লিখতে গিয়ে যে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য নিয়ে যে সমালোচনা হয়েছিল, তার উল্লেখ করতেও ভোলেননি। বইয়ের এই অংশটি পাঠকের জন্য খুবই আগ্রহোদ্দীপক।
দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র পত্তনের মাধ্যমে ভাষা প্রসঙ্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আশরাফ-আতরাফ নিয়ে জনগণের মধ্যে যে সূক্ষ্ম বিভাজন আনা হয় এবং উর্দুভাষী শিক্ষিত ‘আশরাফ’রাই যে বাঙালি মুসলমানের নেতৃত্বে আসে, সে কথা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ আসে। রোমান বা আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব এবং তার বিরোধিতার বর্ণনা আছে এখানে। ভাষা প্রসঙ্গ তখন এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিল, যার একটা বর্ণনা দিলে সহজে বোঝা যাবে। সরকারি সাহিত্য পত্রিকা মাহে নও-এ একটি ছোটগল্প ছাপা হয়েছিল, যার একটি বাক্য এ রকম: ‘লেবাসের অন্দরে তার তামাম তনু পোসিনার তরবতর।’
ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যেকোনো আন্দোলনকেই পাকিস্তানি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হতো হয় ভারতের দালালি নয়, কমিউনিস্টদের কারসাজি। এখানে লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘ছাপ্পান্ন সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলেও, দালালদের সহায়তায় পাকিস্তান সরকার তাদের আমলের শেষ পর্যন্ত বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল।’ এ বইটি তারই প্রামাণ্য দলিল।
বাঙালি সংস্কৃতির অতীত-বর্তমান আলোচনা করতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ আরও অনেকের গান ধরে আলোচনা করেছেন, যা খুবই কৌতূহলোদ্দীপ্ত। এরপর ছায়ানট, উদীচীর কথা, গণসংগীতের আলোচনা, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাত বারোটা পার করে টেলিভিশনে পাকিস্তানি পতাকা প্রদর্শন ইত্যাদির উপভোগ্য বর্ণনা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ, বৈরী সময়, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, প্রজন্ম ’৭১-এর জন্মের প্রসঙ্গ এনে তিনি শেষ করেছেন এই প্রবন্ধ।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম আর সংস্কৃতিসাধনা’য় বাঙালি সংস্কৃতি বিষয়ে নানা ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ এসেছে। এখানে নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যে বুলবুল একাডেমী অব ফাইন আর্টস বা বাফার ভূমিকা, ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ নিয়ে আলোচনাটি প্রণিধানযোগ্য। নাটক, ভাস্কর্যশিল্প, আবৃত্তিশিল্পকেও তিনি তাঁর এ আলোচনায় রেখেছেন।
আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ রয়েছে, যা উৎসুক পাঠকের জানার তৃষ্ণা মেটাবে।
‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে বাঙালি জাতিসত্তার সন্ধান’ প্রবন্ধে মুক্তচিন্তার অধিকারী সাহিত্যিকদের ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সংগ্রামময় সময়টি এসেছে এখানে, রবীন্দ্রনাথ কীভাবে বাঙালির আন্দোলনে বেগ সঞ্চার করেছেন, তার উদাহরণ রয়েছে।
‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন (১৯৬১-৭১)’ প্রবন্ধে অনেক বিষয়ের মধ্যে ’৬১ সালে চট্টগ্রামে মহাপ্লাবনের পর ছায়ানটের স্বেচ্ছাসেবীদের উপদ্রুত এলাকায় যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। সেখানে সন্‌জীদা খাতুন বলছেন, ‘সবার উপলব্ধি হয়েছিল মানুষের জন্যই সংস্কৃতি, তাদের প্রতি মনোযোগ না করে সংস্কৃতির সবা হতে পারে না।’ এই প্রবন্ধটিতে একাত্তরে সংস্কৃতিজগতের অবদানের স্বীকৃতি রয়েছে।
এ ছাড়া আরও কয়েকটি ছোট ছোট প্রবন্ধের পর ‘প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ’ নামের লেখাটি দিয়ে বই শেষ হয়েছে।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রবন্ধগুলো রচিত হওয়ায় পুনরাবৃত্তি রয়েছে। ‘প্রাক-কথন’-এ লেখক তা স্বীকারও করেছেন। তবে মূলত এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি-সংকট খুব ভালোভাবেই উঠে এসেছে বইয়ে। বইটি হয়ে উঠেছে সংস্কৃতি সংগ্রামের নির্ভরযোগ্য দলিল। সহজ-সরল ভাষার কারণে সাধারণ পাঠকও সহজে বইটি পড়ে নিতে পারবেন। গবেষকদের জন্যও বইটি হয়ে উঠতে পারে তথ্যের আকর।
বইটি প্রকাশ করেছে ভারতের কলকাতার ‘মনফকিরা’। ঢাকায় বইটি পাওয়া যাবে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে এবং ধানমন্ডি ১৫ সড়কের ‘বুবুক’-এ।