তাঁর স্মরণে, তাঁকে নিবেদন

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (১ মে ১৯২৭—৯ মে ২০১৮), ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (১ মে ১৯২৭—৯ মে ২০১৮), ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
>গত ৯ মে প্রয়াত হয়েছেন লেখক, সম্পাদক ও জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখা।


আমাদের কালের একজন বিশিষ্ট ও প্রাতিস্বিক মানুষ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম চলে গেলেন চিরদিনের মতো। চলে গেলেন বটে কিন্তু রেখে গেলেন অতুলনীয় কিছু বৈভব, অনুপম কিছু সৃষ্টি। লেখক, গবেষক, সম্পাদক, সংস্কৃতিকর্মী, সমাজচিন্তক—সর্বোপরি একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে সমকালে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। উত্তরজীবনে টেলিভিশন-উপস্থাপক হিসেবে পেয়েছিলেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম সারথি। এমন একজন গুণী মানুষকে হারিয়ে আমরা বিপন্ন, বিষণ্ন, বিহ্বল।

১৯২৭ সালের ১ মে ইতিহাসখ্যাত মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক মাটি গায়ে মেখে করতোয়ার তীরে জন্ম নিয়েছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। কালের দীর্ঘ পরিক্রমা শেষে একানব্বই পূর্ণ করে বিরানব্বই বছরে পদার্পণের পরপর তিনি চলে গেলেন অনন্তের পথে। চলে যেতে হবে বলেই বোধ করি বেশ আগেই ভাবনাচিন্তা করে আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন নিবেদন ইতি। শিরোনাম বলে দিচ্ছে সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রসঙ্গটা।

পিতা সা’দত আলী আখন্দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেছেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। এরপর তিনি কাটিয়েছেন এক বর্ণাঢ্য জীবন। সে বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক পরিচয়ে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট। করাচি, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। শেষ জীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। শিক্ষকতা পেশায় অনন্য অবদানের জন্য অলংকৃত করেছিলেন জাতীয় অধ্যাপকের পদ। তিনি যেমন শিক্ষকতা করেছেন তিন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তেমনি শিক্ষার্থীও ছিলেন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর, লন্ডন বিশ্ববিদ্যারয় থেকে পিএইচডি। এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের শিক্ষকতা-জীবনকে বর্ণাঢ্য করে তুলতে সাহায্য করেছে। জীবনে তিনি বহু ছাত্র তৈরি করেছেন, জাতির শিক্ষা-উন্নয়নে রেখেছেন অনন্য অবদান। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর চেতনায় তিনি সঞ্চার করতেন আধুনিক মানুষ হওয়ার বীজমন্ত্র। ভালো ছাত্র তৈরি করার চেয়ে ভালো মানুষ সৃষ্টি করার দিকেই ছিল তাঁর মৌল লক্ষ্য। এ জন্যে শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীর বোধে-চেতনায় সঞ্চার করতেন ইতিবাচক জীবনবোধ ও প্রগতিশীল বিশ্ববীক্ষা।

একজন গবেষক হিসেবে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের অবদান বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। ‘বেঙ্গলি মুসলিম পাবলিক ওপিনিয়ন অ্যাজ রিফ্লেক্টেড ইন বেঙ্গলি প্রেস’ বিষয়ে ১৯৭১ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এই অভিসন্দর্ভ তাঁকে উচ্চমানের গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। মুসলিম সমাজচেতনার স্বরূপ অনুধাবনে এখন এই বই পালন করছে আকর গ্রন্থর ভূমিকা। তাঁর এই অভিসন্দর্ভটি বেঙ্গলি মুসলিম পাবলিক ওপিনিয়ন শিরোনামে প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। একই ধারার তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা দুখণ্ডে রচিত সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত (প্রথম খণ্ড, ১৯৭৭; দ্বিতীয় খণ্ড, ২০০৫)। বিপুলায়তন এই বইয়ে সাময়িকপত্রে প্রতিফলিত জীবন এবং এ অঞ্চলের মানুষের নানামাত্রিক মত-অভিমত সংকলিত হয়েছে।

সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ১৮৩১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত মুসলিম ব্যক্তিবর্গ সম্পাদিত মোট একচল্লিশটি সাময়িকপত্র থেকে জীবন ও জনমত-বিষয়ক রচনা সংকলিত হয়েছে। রচনাগুলোকে শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম, আত্মচেতনাবোধ ও আত্মজাগরণ, মুসলিম বিশ্ব, রাজনীতি, হিন্দু-মুসলমান, অর্থনীতি, ভাষা ও সাহিত্য এবং বিবিধ—এই দশটি শাখায় বিন্যাস করে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখাই বাহুল্য যে, যে সময়ে বসে গবেষক এই কাজ করেছেন, তখন অনেক পত্রপত্রিকাই দুষ্প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম করে নানা জায়গায় ঘুরে বহু মানুষের সহযোগে তিনি রচনা করেন এ বই। প্রসঙ্গত স্মরণীয় লেখকের নিম্নোক্ত ভাষ্য:

১৮৩১-১৯৩০ শতবর্ষ কালে প্রকাশিত সকল পত্রপত্রিকার সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। কেননা অধিকাংশই ইতিমধ্যে দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। বেশ কিছুসংখ্যক পত্রিকা সম্বন্ধে বিভিন্ন সূত্রে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ করা গেছে বটে, কিন্তু সবগুলির মূল ফাইলের সাক্ষাৎ আমরা পাইনি। তবু যাই হোক, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রক্ষিত যে সকল পত্রিকা দেখবার সুযোগ আমরা পেয়েছি, তা থেকে মোট একচল্লিশটি পত্রিকা নির্বাচন করে বর্তমান গ্রন্থে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রন্থমধ্যে বহুল উদ্ধৃত কয়েকটি সাময়িকপত্রের এখানে নামোল্লেখ করা গেল—আল-এসলাম, ইসলাম-দর্শন, ইসলাম-প্রচারক, কোহিনুর, ছোলতান, নবনূর, নূর-আল-ইমান, প্রচারক, বঙ্গনূর, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, বাসনা, মাসিক মোহাম্মদী, মিহির ও সুধাকর, মোয়াজ্জিন, মোসলেম দর্শন, রওশন হেদায়েৎ, শরিয়ত, শরিয়তে এসলাম, শিখা, সওগাত, সাম্যবাদী ইত্যাদি।

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত সুন্দরম পত্রিকার প্রচ্ছদ
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত সুন্দরম পত্রিকার প্রচ্ছদ

বিভিন্ন সাময়িকপত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যাবলি গবেষক যেভাবে দশটি শাখায় বিন্যাস করেছেন, তা থেকে প্রতিটি স্বতন্ত্র বিষয় সম্পর্কে জনমত বিকাশের ক্রমধারা সমন্ধে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব। বিষয়ের এই ক্রমবিন্যাস ধারাটাই এ বইয়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত-এর দ্বিতীয় খণ্ডে ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম ব্যক্তিবর্গ সম্পাদিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে নির্বাচিত অভিমত সংকলিত হয়েছে। এই খণ্ডে প্রধানত যেসব সাময়িকপত্র থেকে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে—সওগাত, শিখা, মাসিক মোহাম্মদী, ছুন্নত অল-জামায়াত, মোয়াজ্জিন, শরিয়তে এসলাম, ইমাম, আল-ইসলাহ্, হেদায়াত, ছায়াবীথি, বুলবুল, গুলিস্তাঁ, নওরোজ, নেদায়ে ইছলাম, জয়তী ইত্যাদি। দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়সমূহকে গবেষক এগারোটি ধারায় বিভক্ত করে বিন্যাস করেছেন। ধারাগুলো এ রকম—শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম, জাগরণ, মুসলিম চেতনাবোধ, হিন্দু-মুসলমান প্রশ্ন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষা-সাহিত্য, মুসলিম দুনিয়া, আন্তর্জাতিক এবং বিবিধ। একটি বিশেষ কালখণ্ডে দেশবাসীর মনোভাব কেমন ছিল, কেমন ছিল তাদের চিন্তাভাবনা, সে বিষয়টা আলোচ্য গ্রন্থ রচনার মূল লক্ষ্য বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য লেখকের এই ভাষ্য:

...বর্তমান গ্রন্থ-প্রস্তুতির প্রধান উদ্দেশ্য—ইতিহাসে পাঠ-গ্রহণ। ধারাবাহিকতার একটি চিহ্নিত কালপর্বে স্বদেশের, দেশবাসী মানুষের অবয়ব কেমনতর ছিল, এবং নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সমন্বয়ে অবয়বটি কেমনভাবে নির্মিত হয়ে উঠেছিল সেই ইতিহাসের সন্ধান নিতে চাই।...গভীরে-বিস্তারে ব্যাপকতায় পটভূমি রয়ে থাকে। সেইখানে নানান স্রোতের উথালি-পাথালি। অতঃপর ধারাবাহিকতায় সবটা বহমান।

মুস্তাফা নূরউল ইসলামের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই সমকালে নজরুল ইসলাম (১৯৮৩)। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকপত্রে নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্ম-বিষয়ক রচনার সংকলন এটি। নজরুল-গবেষণায় এ এক আকর বই। কেননা, যেসব সাময়িকপত্রে নজরুলবিষয়ক রচনা প্রকাশিত হয়েছে, তার অধিকাংশই এখন দুর্লভ। তাই এ বইয়ের শরণ ছাড়া উত্তরকালীন গবেষকদের কোনো বিকল্প নেই। গবেষক হিসেবে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও প্রযত্নের ছাপ আছে এই বইয়ে।

গবেষণার বই ছাড়াও বিভিন্ন শাখায় আরও কিছু পুস্তক লিখেছেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। আছে তাঁর বেশ কিছু সম্পাদিত বই। মুস্তাফা নূরউল ইসলামের বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখখোগ্য: শিশু-কিশোর সাহিত্য: ভীষণ প্রতিশোধ (১৯৫৫), জাপানি ভূত (১৯৫৫) ; গবেষণা/প্রবন্ধ: মুসলিম বাংলা সাহিত্য (১৯৬৮), মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লা (১৯৭০), সময়ের মুখ, তাঁহাদের কথা (১৯৯৭), আপন ভুবন (২০০১) নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০৪) ; সম্পাদনা: নজরুল ইসলাম (১৯৬৯), উচ্চ শিক্ষায় এবং ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার প্রয়োগ (১৯৭৬), আমাদের মাতৃভাষা চেতনা ও ভাষা আন্দোলন (১৯৮৪), বাংলাদেশ: বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে (১৯৯০), নজরুল ইসলাম: নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১), আবহমান বাংলা (১৯৯৩), আমাদের বাঙালিত্বের চেতনার উদ্বোধন ও বিকাশ (১৯৯৪), পূর্বমেঘ: নির্বাচিত প্রবন্ধ (যৌথ, ২০০২), শিখা সমগ্র (২০০৩), সেরা সুন্দরম (২০০৭); আত্মজীবনী: নিবেদন ইতি (পূর্বখণ্ড ২০০৫, উত্তরখণ্ড ২০০৬) ; অনুবাদ: কাউন্ট অব মন্টোক্রিস্টো (১৯৫৫), বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস এবং সমস্যা (১৯৬৯) ইত্যাদি। 

তাঁর বইয়ের মধ্যে আত্মজীবনী নিবেদন ইতির কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। এটি তাঁর ব্যক্তিজীবনের কথা, তাঁর হয়ে ওঠার কাহিনি। তবে এ কথা, এ কাহিনি যতটা তাঁর নিজের, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর কালের, তাঁর সময়ের স্বদেশের। বস্তুত, আত্মকথার আড়ালে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তুলে ধরেছেন তাঁর সময় ও সমকালকে, দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন তাঁর স্বদেশকে। এ বইয়ে লেখকের ‘আপন কথায় স্বভাবতই এসেছে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা, অপর পক্ষে প্রাসঙ্গিক সম্পৃক্ত পটভূমিতে বহমান কালের যাত্রা।’ এ বইয়ে লেখক নিজে কথা বলেছেন, নাকি বলব কাল বা সময়ই তাঁকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিয়েছে? বাংলাদেশের ইতিহাস আর সংস্কৃতির সঠিক পরিচয় পেতে বইটি পাঠককে সাহায্য করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ভুবন। তিনি সংবাদ পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মিল্লাত-এর, যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত বেগম পত্রিকার সঙ্গে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত বিখ্যাত অগত্যা (১৯৪৯)-এর সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথাও সুবিদিত। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত পূর্বমেঘ (১৯৬০) সাময়িকপত্রের কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ষাটের দশকে পূর্ববাংলায় উন্নত সাহিত্যরুচি বিকাশে পূর্বমেঘ পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৬০ থেকে ১৯৭১—একটানা এগারো বছর এ পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম।

সুন্দরম (১৯৮৬) সম্পাদনা তাঁর সাহিত্য সাধনার এক অনন্য কীর্তি। সুন্দরম-এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে থাকত তাঁর মেধা মনন রুচি আর প্রযত্নের স্বাক্ষর। প্রায় একাই তিনি পত্রিকার গোটা কাজ করতেন। নিপুণ হাতে সম্পাদনা করতেন। প্রবীণ-নবীন—উভয় ধরনের লেখকের রচনা ছাপা হতো সুন্দরম-এ। এ পত্রিকায় লেখা মুদ্রিত হওয়া একসময় তরুণ লেখকদের কাছে ছিল আনন্দ আর আবেগের উৎস। এমন ঝকঝকে রুচিশীল পত্রিকা দুই বাংলায় ছিল একেবারে হাতে গোনা। কম-বেশি যাই হোক না কেন, সুন্দরম-এ প্রকাশিত প্রতিটি রচনার জন্য তিনি সম্মানী দিতেন। এটাও তাঁর কাছ থেকে একটা শিক্ষণীয় বিষয়।

রেডিও-টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তিনি রেখে গেছেন এক স্বকীয়, বৈশিষ্ট্য। তাঁর উপস্থাপনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মুক্তধারা’ কিংবা ‘বাঙালির বাংলা’, এটিএন বাংলার ‘কথামালা’ অনুষ্ঠান ছিল অতি জনপ্রিয় শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় তাঁর স্বকীয়তা ছিল সবিশেষ আকর্ষণীয়। আর অনুষ্ঠানের বিষয়-নির্বাচন তো ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর এবং কৌতূহলোদ্দীপক। ভাবা যায়, অনুষ্ঠানের বিষয় ‘তুমি’, ‘বাজে কথা’, ‘গুজব’ কিংবা ‘কি কথা তাহার সাথে’! ষাটের দশকে বেতারে নানা অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় মুস্তাফা নূরউল ইসলাম রেখেছেন তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর।

মুস্তাফা নূরউল ইসলামের কর্ম ও সাধনার সংক্ষিপ্ত কথা লিখতে লিখতে মনে পড়ছে তাঁর সঙ্গে আমার সংযোগের কথা। সুন্দরম পত্রিকায় লেখা দেওয়া সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। সেই ১৯৮৬ থেকে ২০১৮—দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় স্যারের নিবিড় সান্নিধ্য ও সাহচর্যে ধন্য আমি। সুন্দরম পত্রিকায় লেখা সংগ্রহের দায়িত্ব দিতেন আমাকে স্যার—কোন লেখা যাবে কি যাবে না তা-ও হতো আমাদের আলোচনার বিষয়। ইন্দিরা রোডের স্যারের ভবন ‘আকাশ প্রদীপ’-এ কতবার যে গেছি, তার কি কোনো সংখ্যা আছে? মনে আছে পূর্ববঙ্গে প্রগতি লেখক সংঘের ইতিহাস বিষয়ে আমাকে দিয়ে স্যার কী প্রয়োজনীয় একটা কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন।

‘কথামালা’ আর ‘বাঙালির বাংলা’ অনুষ্ঠানে আমি জড়িয়ে ছিলাম নানাভাবে। ‘কথামালা’র বিষয়-নির্বাচন আর বক্তা ঠিক করার ব্যাপারে স্যার আমার সঙ্গে কথা বলতেন—এ কথা ভেবে এখন গৌরব বোধ করছি। ‘কথামালা’ আর ‘বাঙালির বাংলা’র কত অনুষ্ঠানে যে আমি অংশগ্রহণ করেছি। স্যার কেন জানি ভরসা করতেন আমার ওপর। এমনও দেখা গেছে, কোনো বক্তা হয়তো হঠাৎ করে অনুষ্ঠানে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন, কিংবা বন্ধ করে দিয়েছেন যোগাযোগ-সূত্র, সঙ্গে সঙ্গে স্যার আমাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আছে তাঁর সাধনা ও সৃষ্টি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তিনি গড়তে চেয়েছেন তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীদের—এই যে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। তিনি সব সময় থাকবেন আমাদের সঙ্গে, অনাগতকাল ধরে আমাদের বলে যাবেন এগিয়ে যাবার যথার্থ পথ, দূর থেকে জানিয়ে যাবেন জাতিসত্তার প্রকৃত ঠিকানা।