বিচিত্র মানুষের মুখ ও মন

রবার্ট ফ্রস্ট ট্রেইলের সোনালি পরাগ-এ বলা হয়েছে এসব বিচিত্র মানুষের কথা
রবার্ট ফ্রস্ট ট্রেইলের সোনালি পরাগ-এ বলা হয়েছে এসব বিচিত্র মানুষের কথা

ইফফাত মালিক হয়তো ভার্জিনিয়ায় যাবেন না। যদিও তাঁর আগ্রহ আছে হাইকিংয়ে। বনানীতে ছুটে বেড়ানোর সব পরিকল্পনা সেরে ফেলেছেন মঈনুস সুলতান। ইফফাতের দোলাচল তাঁকে বিমর্ষ করে ফেলে। একটা ছোট্ট পুরোনো কুপার গাড়িতে তিনি একাই ছুটে যাচ্ছেন ম্যাসাচুসেটস থেকে ভার্জিনিয়ার দিকে। যেতে যেতে চেনা হয় অনেক অজানা মানুষ। অদ্ভুত রহস্যময় কত চরিত্র। নির্জন পাহাড়ে হেঁটে যাওয়ার দুরন্ত ইচ্ছায় গাঁথা হয় গল্পের ভেতর গল্প।
সুলেখক মঈনুস সুলতানের অসাধারণ আরেকটি ভ্রমণপুস্তক রবার্ট ফ্রস্ট ট্রেইলের সোনালি পরাগ-এর মধ্যে আছে এ রকম অনেক কাহিনি, অজস্র চরিত্র।
একদা সুলতান হেঁটে বেড়িয়েছেন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস, ভরম্যান্ট ও ভার্জিনিয়ার শ্যানানডোয়া ন্যাশনাল পার্ক পেরিয়ে ওল্ডর‍্যাগ মাউন্টেনের উঁচু পথ। রাতের বেলা হ্রদের ধারে তাঁবু ফেলে ক্যাম্পিং করেছেন একা। সেই সব গল্পে ঠাসা এই বই পড়লে চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে ওই সব স্থান।

রবার্ট ফ্রস্ট ট্রেইলের সোনালি পরাগ মঈনুস সুলতান প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪৪ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।
রবার্ট ফ্রস্ট ট্রেইলের সোনালি পরাগ মঈনুস সুলতান প্রচ্ছদ: এরফান উদ্দিন আহমদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪৪ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।

হাইকিং রক্তে মিশে গেছে লেখকের। এ জন্য তাঁর ছিল দীর্ঘ সময়ের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি। রেড ইন্ডিয়ান নারী মিমোজা ও তাঁর সুহৃদ কেলভিনের সহায়তায় তিনি প্রস্তুতি নিয়েছেন দীর্ঘ যাত্রাপথের। ম্যাসাচুসেটসের বার্কশায়ার টাউনের কাছে নির্জন বনানীতে তাঁদের আলাদা নিবাস। লেখক জানাচ্ছেন, চিরোকি ও হিস্পানিকদের মিশ্রিত রক্ত কেলভিনের ধমনিতে। যদিও ইতিহাস বলে, স্পেনীয়রাই প্রথম আসে এই ভূখণ্ডের বহিরাগত শক্তি হয়ে। সেই অতীত শক্তিমত্তার গল্প নয় এটা। বরং আমরা আগ্রহী হতে পারি এই যৌথতার বংশধর কেলভিন বা অদম্য রেড ইন্ডিয়ান মিমোজাকে নিয়ে।
মোট ১৫টি গল্প যুক্ত বইয়ের তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে হাইকিং প্রশিক্ষণের বিবরণ। শুধু বিবরণ বললে কম বলা হয়, রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক, তাদের সংস্কার, জীবনদর্শন—সবটাই যেন জীবন্ত হয় গল্পে। টাইটোনিক ক্রেস্ট ট্রেইলের তুষার হাইক থেকে শুরু হয়ে এটা শেষ হয় ড্রিম ওয়াকে। মাঝে ‘ব্লু হিলসের কপারহেড সাপ’ অধ্যায়ে দেখা যায় হাইকাররা অতিক্রম করছে বিষধর পিট ভাইপার সাপ, হালকা তুষারপাত, ভালুকের ডেরা।
ব্যাকরোড ধরে নিউইয়র্কের দিকে ছুটছে গাড়ি। গন্তব্য হলো ভার্জিনিয়া। এই সব সড়কে গাড়ি চালাতে হয় সতর্কতার সঙ্গে। সড়কে স্ট্রিট ল্যাম্প নেই, গতি কমিয়ে দেখেশুনে যেতে হয়। ‘ব্রেকডাউন কার’ নামের অধ্যায়টি থেকে শুরু হয় রোমাঞ্চকর এক গল্প। স্ট্রিপার গার্ল চম্পো ও তাঁর প্যাট্রন মিস্টার গোল্ডস্টিন এসে হাজির হন কাহিনির ভেতর। ব্যাপারটা ঘটে যখন যাত্রাপথে নষ্ট হয় গাড়ি। তাঁরা এগিয়ে আসেন ত্রাতা হয়ে। গোল্ডস্টিন নৌবাহিনীর লোক। গাল্ফ ওয়ারে মিসাইল ছুড়ে দেশে ফিরেছেন।
আর চম্পো? তাঁর কথা বললে এটা বলতে হবে যে তাঁর জন্ম কম্বোডিয়ায়। গৃহযুদ্ধে তাঁর বাবা পঙ্গু হলে মায়ের সঙ্গে শরণার্থীশিবির ঘুরে তাঁর ঠাঁই হয় আমেরিকায়। এরপর আছে এক বেদনাময় আখ্যান। আর ‘হাউস অব মিরর’, ‘বার্ক লেক ক্যাম্পিং’, ‘দ্বীপে চম্পাই ও প্রজ্ঞাপারমিতা’—এসব আখ্যানে ঘুরেফিরে এসেছে চম্পোর বেড়ে ওঠা, সিহানুকের হয়ে তাঁর বাবার যুদ্ধে যোগদান, পরিণতিতে পঙ্গুত্ববরণ ও শরণার্থী ক্যাম্পের জীবন।
এর পরের পাঁচটি গল্প একটু ভিন্ন রকম। শ্যানানডোয়ায় ‘স্কাইলাইন ড্রাইভ’-এ ব্যাককান্ট্রি ক্যাম্পিংয়ের বর্ণনা আছে। এ সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য, এটা হলো গড়পড়তা ক্যাম্পিংয়ের চেয়ে আলাদা। গড়পড়তা ক্যাম্পিংয়ে আছে নির্দিষ্ট ক্যাম্প গ্রাউন্ড, বাথরুম ব্যবহারের বন্দোবস্ত ইত্যাদি। তবে ব্যাককান্ট্রি ক্যাম্পিংয়ে পাওয়া যাবে না এসবের কিছুই। কেবল বনানীর ভেতর ঢুকে যেতে হয় ট্রাকিং করে। জরুরি প্রয়োজনে সাহায্য নিয়ে ছুটে আসে না পার্ক রেঞ্জার।
এভাবে তথ্যের পর তথ্য, ছবির পর ছবি তৈরি করে রবার্ট ফ্রস্ট ট্রেইলের সোনালি পরাগ-এ একের পর এক গল্প বলেন মঈনুস সুলতান। বইয়ের অন্যান্য গল্পের মতো ‘ওল্ডর‍্যাগ মাউন্টেন’, ‘খনিজ খোঁজা হাইকার’, হাইকার্স সার্কেল’, ‘উপত্যকায় চিলযুদ্ধ’ প্রভৃতি—এসব গল্পে আমরা দেখি বিচিত্র মানুষের মুখ। আবিষ্কারের করি তাঁদের। পড়তে পড়তে বুঝে ফেলি তাঁদের মনও।